বুক ভরা স্বপ্ন নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছিল আবু বকর সিদ্দিক। ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হওয়া মেধাবী আবু বকরের আশা ছিল দেশের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক হবার। কিন্তু মাথা ভেদ করে যাওয়া বুলেটে সমাধিস্থ হয় তার সকল স্বপ্ন এবং সম্ভাবনা। স্বাধীন মুক্তচিন্তা চর্চার জায়গা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ক্রমেই হয়ে পড়ছে সন্ত্রাসের অভয়ারণ্য। ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তার এবং অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফলাফল হিসেবে অস্ত্রবাজী এবং হত্যার সংস্কৃতিতে সাম্প্রতিক সময়ে প্রাণ বিসর্জন প্রায় দেড় শতাধিক মেধাবি শিক্ষার্থী। হল দখল, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজির ফলাফল এই নিহত শিক্ষার্থীদের হত্যার কোন বিচার হয়নি, হয়নি প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিকভাবে এই অপসংস্কৃতি রোধে কোন বড় ধরণের চেষ্টা।
রাষ্ট্রের শীর্ষ চার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাস, হল দখল , হত্যা, রক্তের স্রোত প্রায় নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। ১৯৭২ -২০১২ এই সময়ে এই চার বিশ্ববিদ্যালয়ে নোংরা ছাত্ররাজনীতির বলি ১২৯টি মেধাবী মুখ। প্রতিটি হত্যার পরেই তদন্ত কমিটি নামক তামাশা সাজানো হয়েছে, যাদের রিপোর্ট রাজনৈতিক পুতুল নাচের খেলার ফলে কখনোই আলোর মুখ দেখেনি।
প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো বহুবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ক্যাম্পাসকে সন্ত্রাসমুক্ত রাখার। কিন্তু 'ওয়াদা ভাঙার জন্যই ওয়াদা করা হয়' নীতিতে বরাবরই তারা মঞ্চস্থ করেছে ধর্ষণ ও হত্যার নাটক।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের ৩৭ তম আবর্তনের ছাত্র জুবায়েরকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগের কিছু কর্মী ৯ জানুয়ারী, ২০১২ সালে। ১৯৯৭সালে ছাত্রলীগ নেতা আনন্দ কুমারকে পয়েন্ট ব্লাক রেঞ্জ থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়। শওকত কবীর দিপুও হয়েছিলেন রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের বলি। ১৯৭৩ সালে জাকসু'র জিএস রোকনকে এবং নভেম্বর ১২, ১৯৭৪ সালে জাকসু'র ভাইস প্রেসিডেন্ট মোজাম্মেল হককে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই কোন হত্যাকান্ডেরই বিচার হয়নি। বাংলাদেশে ছাত্র হত্যার বিচার একটি প্রহসন হয়েই আছে এখনো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কুখ্যাত সাত ছাত্র হত্যার মামলায় তৎকালীন ছাত্রলীগ সেক্রেটারি শফিউল আলম প্রধান সহ আসামীদের যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিয়েছিলো আদালত, কিন্তু সামরিক শাসক জিয়া ক্ষমতায় এসেই তাদের মুক্তি দিয়ে দেন। জুবায়ের হত্যাকান্ডের পর সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের তীব্র আন্দোলনের মুখে অনিচ্ছুক প্রশাসন যখন বিচার করতে বাধ্য হয়, তখনও দেখা গেছে আসামীরা পুলিশি প্রহরার মাঝেও আদালত থেকে পালাচ্ছেন কিংবা হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে এই ক্যাম্পাসেই দিব্যি ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছেন। তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে বিচার চলার পরে মামলায় অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় অভিযুক্তদের মধ্যে পাঁচজনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ছয়জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় আদালত। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে আমরা লক্ষ্য করছি যে, এখনো পর্যন্ত সেই রায় কার্যকর করা হয়নি। রায় কার্যকর করার কোনো তৎপড়তাও দৃশ্যমান নেই। এমনকি জুবায়ের নিহত হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের আন্দোলনের মাধ্যমে জুবায়ের হত্যার বিচার দাবির পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দূর করার যে দাবি জানানো হয়েছিলো, সে দাবিও উপেক্ষিত রয়ে গেছে। রায় কার্যকর করার এই বিলম্ব আরেকটি জুবায়ের হত্যাকান্ডেরই ইন্ধন দেয়। এখনও ক্যাম্পাসে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের বিভিন্ন গ্রুপে নিয়মিত সশস্ত্র ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলে, বিভিন্ন স্থানে গুলির আওয়াজ পাওয়া যায়, হলগুলো দখলে রেখে অমানবিক গেস্টরুম প্রথা প্রকাশ্যে চলমান রেখেছে সরকারী ছাত্রসংগঠন, বিভিন্ন ছাত্রনেতার রুমে অস্ত্রের মজুদের বিষয়টাও ক্যাম্পাসে ওপেন সিক্রেট হয়ে আছে। প্রশাসন বরাবরের মতোই এসব ইস্যুতে নিশ্চুপ।
এই নোংরা সংস্কৃতি একদিনেই তৈরি হয়নি আর সমাধানের পথটাও খুব সোজা নয়। ছাত্রসংগঠনগুলো কোন রাজনৈতিক দলের সাথেই সরাসরি জড়িত নয়। তারা মূলত ব্যবহৃত হয় মূল দলের টেন্ডারবাজি, অস্ত্রবাজি, আধিপত্য বিস্তার, দখলদারিত্বসহ বিভিন্ন স্বার্থসিদ্ধির কাজে। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা বিশ্বজিৎ হত্যার মতো নির্মম হত্যাকান্ড দেখেছি। আর অস্ত্রসহ ছাত্রনেতাদের শোডাউন তো রাজপথের নৈমত্তিক ঘটনা। এখন তার সাথে যুক্ত হয়েছে শিক্ষক রাজনীতির নোংরা একটা চক্র যারা ছাত্রদের ব্যবহার করছে নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধি করতে, ভিসি প্রোভিসি হবার সিঁড়ি হয়ে দাঁড়িয়েছে ছাত্ররা।
মেধাবীদের কাছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ক্রমেই ভয় আর বিভীষিকার এক নাম হয়ে উঠছে। যার দরুণ ছাত্ররা বিদেশে উচ্চশিক্ষায় অধিক আগ্রহী হচ্ছে এবং প্রতিবছর মেধাবীদের বিরাট একটা অংশ দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। রাষ্ট্র হারাচ্ছে মেধাবী এবং দক্ষ জনসম্পদ।
রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের ক্ষমতায় যাবার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করছে ছাত্রদের। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, হল দখল, অস্ত্রবাজি এগুলো সবই ইন্ধন দিয়ে টিকিয়ে রেখেছে ক্ষমতালোভী রাজনীতিবিদেরা। ফলশ্রুতিতে নেতৃত্বশূন্য হচ্ছে ছাত্ররা, রাষ্ট্রও পাচ্ছে না নতুন নেতৃত্ব। সরকারি মদদে একটা গোষ্ঠী অতিশয় সরব ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবীতে, এবং ছাত্রদের মাঝে বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়া মহামারীর মতো ইতোমধ্যে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন তারা। ফলশ্রুতিতে পলিটিকাল ভিউ হিসেবে আই হেইট পলিটিক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সবচে পরিচিত আইডেন্টিটি। অথচ ইতিহাস সাক্ষী এই ভূখন্ডের সবগুলো ইতিবাচক পরিবর্তনে চালকের ভূমিকায় ছিলো ছাত্ররাজনীতি।
কোন বিশ্ববিদ্যালয়েই বিরোধী দলের ছাত্রসংগঠনের সাংগঠনিক কাঠামো নেই বা থাকলেও প্রকাশ্য অস্তিত্ব নেই। জাতীয় নির্বাচনের পরের দিন পরাজিত রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীরা হল এবং ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যাবে এ যেন এক অলিখিত নিয়ম। প্রশাসনের দলীয়করণ প্রত্যেক সরকারেরই অন্যতম নৈমত্তিক কাজ, আর তাদের ইন্ধনেই সন্ত্রাস করে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠন। লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি আমাদের শিক্ষাঙ্গনকে কলুষিত করে ফেলছে। শিক্ষার্থীদের অধিকারের আন্দোলনে ছাত্র সংগঠনগুলোকে পাওয়া যায় না। কিন্তু আন্দোলন দমাতে তারা সক্রিয়তার পরিচয় দেয়। ছাত্রলীগ কিংবা ছাত্রদল অথবা শিবির, এই সব সংগঠনই দলের প্রতি দায়বদ্ধ, শিক্ষার্থীদের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নয়। তারা মূল সংগঠনের লেজুড়ে পরিণত হয়েছে। মূল সংগঠনের নেতারা তাদের প্রভাব-বলয় ঠিক রাখার জন্য ছাত্রনেতাদের পৃষ্ঠপোষকতা দেন।
মেধা এবং সুস্থ রাজনীতির চর্চা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে প্রায় হারিয়ে গেছে। কিন্তু এখনও সুস্থ ধারার ছাত্ররাজনীতি করে যাচ্ছে এমন সংগঠন বিরল নয়, কিন্তু তারা সংখ্যায় কম, তেলাপোকার মতো অস্তিত্ব রক্ষা করছেন নিজেদের বিলুপ্ত অতিকায় হস্তির ছায়ায়।
এছাড়া সাধারণ ছাত্ররাও সন্ত্রাস এবং মাদকের ছড়াছড়ির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে পারছে না। সন্ত্রাসমুক্ত শিক্ষাঙ্গন গড়ার প্রতিশ্রুতি আমরা উপরমহল থেকে বহুবার শুনেছি, কিন্তু সন্ত্রাসের ইন্ধন বন্ধ হয়নি। শিক্ষাঙ্গনকে সন্ত্রাসমুক্ত করতে হলে হল থেকে দল থেকে সন্ত্রাসীদের বিতাড়ন করতে হবে। এ ব্যাপারে জনমত গঠন এবং তীব্র ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলা জরুরী। আমরা আর কোন জুবায়েরের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে লাশ হয়ে ফিরে যাওয়া দেখতে চাই না।
রাষ্ট্রীয় রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন যখন চরমে, ক্ষমতাসীনেরা নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে দেশের তেল গ্যাস খনিজ সম্পদসহ ভূমি পর্যন্ত বৈদেশিক শক্তির হাতে তুলে দিচ্ছে, আইনসভার অধিকাংশ সিট যখন রাজনীতিবিদ ছেড়ে ব্যবসায়ীদের হাতে, বিচারহীনতার সংস্কৃতি যখন প্রবলভাবে চলমান, শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস যখন শেকড় গেঁড়ে বসেছে, বিরোধীদল যখন কোন যৌক্তিক আন্দোলন করতে ব্যার্থ, তখন দেশ আবার ফিরে তাকাচ্ছে ছাত্রদের দিকে। এই ছাত্ররাই ভাষার জন্য আন্দোলন করেছে, দেশের জন্য যুদ্ধ করেছে, স্বৈরাচার প্রতিহত করেছে। এই ছাত্ররাই পারবে …।