জাবি প্রশাসনের স্বেচ্ছাচারিতা ও ছাত্রদের বিরুদ্ধে মিথ্যে মামলার ভোগান্তি

নাঈম বিশ্বাস
Published : 5 June 2017, 02:00 AM
Updated : 5 June 2017, 02:00 AM

আমাদের দুজন বন্ধু মারা গেলো রোড এক্সিডেন্টে, সেই শোকে আমরা রাস্তা আটকাইনি, আরো শোক যাতে পোহাতে না হয় সেজন্যে আটকেছি। নিরাপত্তার অজুহাতে নিহত দুজন ছাত্রের জানাজা বিশ্ববিদ্যালয় আঙিনায় হতে দেয়নি প্রশাসন, আমরা ক্ষোভ জানিয়েছি এই নিরাপত্তার প্রহসনের বিরুদ্ধে।

এই রাস্তাটা একটা মৃত্যুকূপ, বিগত বছরগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়কে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ শোক উপহার দিয়েছে রাস্তাটা, সেজন্যে আমরা দাবি করেছি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গাড়ির গতিসীমা বেধে দিতে, স্পিডব্রেকার ও ফুট-ওভারব্রিজ নির্মাণ করতে।

একথা সত্য যে ভিসি আশ্বাস দিয়েছেন দাবি মেনে নেবার, তারপরেও কেন ছেলেমেয়েরা রাস্তায় ছিলো সে নিয়ে যথেষ্ট ক্ষোভ জানিয়েছেন প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা। আমরা অতীতের ঘটনাপ্রবাহ থেকে উপলব্ধি করেছি যে প্রতিটি সড়ক দুর্ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এমন আশ্বাস দিয়েছে, আশ্বাসগুলো বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি কখনো, সেজন্যে আমরা দাবি করেছি তৎক্ষণাৎ রাস্তায় স্পিডব্রেকার বসানোর কাজ শুরু করতে হবে।

একটা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে প্রশাসনের মদদপুষ্ট ছাত্রসংগঠনের ক্যাডাররা হামলা চালিয়েছেন, ভিডিও ফুটেজে স্পষ্ট প্রমাণ আছে। আমরা সে হামলার বিচার চেয়েছি, ভিসি মহোদয় আমাদের দাবি মানলেন না। খেয়াল করে দেখুন, পুরো সময়ে একটা গাড়িও ভাঙচুর করা হয়নি, এম্বুলেন্স রাখা হয়েছে অবরোধের আওতার বাইরে। আমরা কিছুতেই ভাবতে পারিনি এই আন্দোলনে পুলিশ গুলি চালাবে। কিন্তু আমাদের যে প্রতিনিধিদল ভিসির সাথে কথা বলতে গিয়েছিলো, সমঝোতা করতে গিয়েছিলো, তারা ফিরে আসার আগেই পুলিশ আমাদের উপর নির্বিচারে টিয়ারশেল ও রাবারবুলেট নিক্ষেপ করে। ছাত্ররা ক্যাম্পাসের ভেতরের দোকানগুলোতে আশ্রয় নিলে সেখানেও টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করে এবং ক্যাম্পাসের ভেতরের দিকে ছাত্রদের লক্ষ্য করে রাবারবুলেট ছুঁড়তে থাকে। উত্তেজিত ছাত্ররা ভিসির বাসা অবরোধ করার সিদ্ধান্ত নেয়।

একটি বেশ বড় মিছিল জড়ো হয় ভিসির বাসার সামনে, ছাত্রদের উপর পুলিশ কেন গুলি চালালো সেই ক্ষোভ নিয়ে। অথচ তালাবন্ধ বাসাটা খোলার কোন উদ্যোগ ভেতর থেকে না নেওয়ায় ছাত্ররা দেয়াল টপকে বাসার ভেতরে প্রবেশ করে ও দরজা খুলে দেয়। এসময় ছাত্ররা দুটো কাঁচের জানালা ও বাগানের টব ভাঙচুর করে। ছাত্রদের উপর যখন পুলিশ হামলা চালায় তখন কোনো শিক্ষক সেখানে ছিলেন না, আহত ছাত্রদের মেডিকেলে দেখতেও তখনো কেউ যাননি। অথচ ভিসির দরজায় হুট করে জনা বিশেক শিক্ষক নাজিল হন, যারা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসিপ্রদত্ত বিভিন্ন বৈধ-অবৈধ সুবিধাভোগী হিসেবে চিহ্নিত।

ছাত্ররা তাদেরকে আন্দোলনে সহমর্মিতা জানানোর আহবান জানায়, তারা নির্বিকার দাঁড়িয়ে থাকেন ও ছাত্রদের চলে যেতে বলতে থাকেন। তখন উত্তেজিত ছাত্রদের কারো কারো ক্ষোভ চিৎকার হয়ে বেরিয়ে আসে যে এই শিক্ষকেরা দিনভর ভিসির বাসা ও অফিসে যাতায়াত ও অবস্থান করেন, অথচ ক্লাসে যান না। ইনারা অধিকাংশ অবৈধ নিয়োগ ও পদন্নোতির জোরে এখানে এসেছেন, ইনারা কেউ কেউ স্ত্রী বা পরিবারের অন্যদের অবৈধভাবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পাইয়ে দিয়েছেন। ইনারা ক্লাসে পড়াতে পারেন না ইত্যাদি ইত্যাদি।

পরবর্তীতে মিডিয়া ও আদালতে এগুলো সেইসব শিক্ষকদের বয়ানে অশ্রাব্য গালিগালাজ হিসেবে উঠে আসবে। আর অভিযোগগুলোর সত্যতার ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগগুলোতে খোঁজ নিতে পারেন, দেশে কোন রাজনৈতিক বা দূর্যোগঘটিত সংকট না থাকা সত্ত্বেও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ বিভাগ সেশনজটে ভুগছে।

একটা কাঁচের টেবিলের উপর শিক্ষকেরা কমনসেন্সের অভাব দেখিয়ে জনে জনে গিয়ে বসছিলেন। ভার সইতে না পেরে টেবিলটা ভেঙে যায়, কেউ কেউ আহত হোন। ছাত্ররাও এসময় শিক্ষকদের উপর ফুল ছুঁড়ে মারে। এই ফুল হয়ে যায় কাঁঠাল ও নিজ দোষে ভাঙা টেবিল হয়ে যায় ছাত্রদের মার। এই প্রবল মিথ্যাচারের বন্যায় তারা সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ভাসিয়ে দেন।

পুরো এলাকাজুড়ে সিসিটিভি ক্যামেরার কাভারেজ থাকায় ছাত্রদের বিরুদ্ধে তাদের এই অভিযোগ ধোপে টেকেনি, বরং যে ফুটেজটি তারা প্রচার করছেন খেঁটেখুঁটে বের করে তাতে দেখা যায় মামলায় অভিযুক্ত আসামিরাই দু'হাত প্রসারিত করে উত্তেজিত ছাত্রদের সামনে শিক্ষক রক্ষার জন্যে মানবঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছেন।

উল্লেখ্য যে মামলার এক নম্বর আসামী জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক এবং একজন নাট্যকর্মী। অন্যান্য আসামীরাও মূলত প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মী। এই ছাত্রদের বিরুদ্ধে তাই শিক্ষকদের দিকে কাঁঠাল ছুঁড়ে মারার অভিযোগ কেবল লোক হাসিয়েছে। ক্যাম্পাসের ইতিহাসে বিভিন্নসময় শিক্ষক লাঞ্ছিত হবার বিরুদ্ধে এই ছেলেরাই প্রতিবাদে প্রথম সারিতে ছিলো। এরা শিক্ষকদের দিকে কাঁঠাল ছুঁড়ে মেরেছে এই বক্তব্যটা স্বয়ং গোয়েবলস দিতেও লজ্জা পেতেন।

অতীতে বিভিন্ন আন্দোলনে ভিসি আন্দোলনকারীদের সাথে কথা বলেছেন, সমঝোতায় এসেছেন বা আন্দোলনকারীদের বুঝিয়ে আন্দোলন থেকে নিবৃত্ত করেছেন। অতীতের সমস্ত রেকর্ড ভেঙে এই ভিসি বাসা থেকে বের হলেন না, ক্যাম্পাসে পুলিশ ঢুকালেন। পুলিশ এসে আন্দোলনকারীদের গান থামিয়ে দিয়ে চিৎকার করে বললো, খামোশ, কোন শব্দ না করে গাড়িতে উঠ।

পুলিশের যে সদস্যরা আমাদের সমবয়সী ছিলেন, আমাদের অবাক করে দিয়ে তারা কোন দুর্ব্যবহার করলেন না, আমাদের আশ্চর্য করে দিয়ে আমাদের গায়ে হাত তুললো বয়স্ক পুলিশসদস্যরা। ঘাড়ে কিল ঘুষি চড় দিয়ে বাবার বয়সী দাঁড়িপাকা পুলিশসদস্যরা আমাদের গাড়িতে তুললেন যেভাবে ঈদের বাজারে গরু সাজানো হয় ট্রাকে সেভাবে। তিনটে গাড়ি ছুটে চললো ক্যাম্পাস ছেড়ে, আমাদের শিক্ষকেরা ও ভিসি তাকিয়ে রইলেন আনন্দচিত্তে।

আমাকে নেওয়া হয় ধামরাইয়ের কাওয়ালিপাড়া পুলিশ ফাঁড়িতে। ক্রসফায়ারের জন্যে এই ফাঁড়ির কুখ্যাতি আছে। সারাটা রাত এই তীব্র গরমেও মাথার উপর জ্বলেছে একশো ওয়াটের হলদে বাতি। পোকামাকড় ও মশার অত্যাচারে একশেষ, প্রস্রাবের দুর্গন্ধে শ্বাস নেওয়া দায়। পরদিন দুপুর পর্যন্ত ছিলাম এই নরকে, একদানা খারাবও আসেনি আমাদের জন্যে। দুপুরে যখন কোর্টে চালান করার জন্যে আমাদের হাতে হাতকড়া পরানো হচ্ছিলো তখন একজন কনস্টেবল সহানুভূতির স্বরে বললেন মূলা চুরির অপরাধে আপনাদের ফাঁসি দেওয়া হলো।

প্রিজন ভ্যানে করে আমাদের কোর্টে নেওয়া হলো, ওখানে নিয়েও হাজতে রাখা হলো কোর্টে উঠানোর আগ পর্যন্ত। হাজতে যাদের সাথে ছিলাম তাদের একজনকে শুধু জিজ্ঞেস করেছিলাম তিনি কি অপরাধে জেল খাটছেন, তিনি জবাব দিলেন ধর্ষণ, কষ্টে ও যন্ত্রণায় অন্যদের অপরাধ জিজ্ঞেস করবার ইচ্ছে আর আমার হলো না।

মহামান্য আদালত আমাদের জামিন দিলেন। আমরা চাইলাম এই হয়রানিমূলক মিথ্যে মামলা প্রত্যাহার হোক, সিন্ডিকেটের মিটিং বসলো বিশ্ববিদ্যালয়ে, মামলা প্রত্যাহার হলো না। আমরা নিরাপদ সড়ক চেয়ে আন্দোলন করেছিলাম, আমরা ক্যাম্পাসে পুলিশি আক্রমণের জবাব চেয়েছিলাম। আমরা এখন মামলার আসামী, ঘুষি খাওয়া ঘাড়টা এখনো আমি স্বাভাবিকভাবে নাড়াতে পারি না।

কিভাবে আমাদের শিক্ষকেরা পারলেন আমাদের পুলিশের হাতে তুলে দিতে, আমাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে? আমরা কি খুনী, নাকি ধর্ষক? আমরা কি অন্যায় কোনো দাবী করেছি? আমরা কি চাঁদাবাজি টেন্ডারবাজি করেছি? শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করাও এদেশে অপরাধ? ছাত্রদের উপর এই নির্মম পুলিশি হামলার বিরুদ্ধে দিল্লীতে মানববন্ধন হয়েছে, কলকাতায় বিজ্ঞজনেরা বিবৃতি দিয়েছেন, চট্টগ্রামে মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে, পত্রিকা ও মিডিয়ায় সচেতন মানুষেরা নিন্দা জানিয়েছেন। অথচ প্রশাসনের লজ্জা হয়নি, প্রশাসনের শুভবুদ্ধির উদয় ঘটেনি।

আরো প্রহসন ঘটিয়েছে প্রশাসন তদন্ত কমিটির নামে। যে সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত মেনে ছাত্রদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে সেই সিন্ডিকেটের সদস্যরাই আবার তদন্ত কমিটির সদস্য। মানে মিথ্যে অভিযোগ যিনি দিয়েছেন এবার বিচারের দায়িত্বও তারই ঘাড়ে।

এইবার ঈদে আপনারা যখন প্রিয়জনদের সাথে মেতে থাকবেন, ঘন্টায় ঘন্টায় প্রেশার চেক করবেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৩ জন ছাত্রছাত্রী তখন মামলা মাথায় নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগবে, চার তারিখে তাদের আবার কোর্টে হাজিরা দিতে হবে।

এই আমার বিশ্ববিদ্যালয়, এই কুচক্রীর উল্লাসমঞ্চ আমার ক্যাম্পাস। শোষকের স্বেচ্ছাচার ও হয়রানির স্বর্গরাজ্য। ভাল জনে জেল ঘুরে আসে, মন্দজনে সিংহাসনে বসে আছে।