শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অপপ্রচার কেন?

নাজমা আক্তার রোজী
Published : 15 Feb 2018, 03:06 AM
Updated : 15 Feb 2018, 03:06 AM

জিয়ার অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে দুর্নীতিবাজ সাব্যস্ত করে ৬৩২ পৃষ্ঠার রায়ে ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারায় ক্ষমতায় থেকে অর্থ আত্মসাতের মাধ্যমে 'অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গের' কারণে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছে বিচারিক আদালত। আর এতেই বিএনপির নেতাকর্মীসহ কতিপয় সুশীল নামধারী ব্যক্তি রংচং মিশিয়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অপপ্রচারে উঠেপড়ে লেগেছে। লণ্ডনে বিএনপির কতিপয় নেতাকর্মী বঙ্গবন্ধুর ছবির প্রতি অবমাননা করে তাদের নোংরা মন-মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। এটা শুধু দুঃখজনকই নয়; এটা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অপসংস্কৃতি যা বিএনপি তাদের ২০০১ থেকে ২০০৬ আমলে দেখিয়েছিলো এবং আজও তারা পেট্রোল বোমায় মানুষ হত্যার বর্বরতা থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি বলে প্রতীয়মান করে।

তত্ত্ববধায়ক সরকারের সময় দুদকের করা মামলায় এখানে শেখ হাসিনা ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কী দোষ যে তাদের ঘিরে সমালোচনা ও ছবিকে নিয়ে অবমাননা করতে হবে? আর যদি শেখ হাসিনার সরকার এই মামলায় কোনও ধরনের হস্তক্ষেপ করত তাহলে (১) দীর্ঘদিন ধরে চলমান এই মামলার সকল সুযোগ-সুবিধা থেকে খালেদা জিয়া বঞ্চিত হত, (২) খালেদা জিয়ার সর্বোচ্চ শাস্তিই বিচারিক আদালত কর্তৃক প্রদান করা হতো।

একটু লক্ষ্য করলে দেখবেন, দীর্ঘ এই বিচার প্রক্রিয়ার মধ্যে মামলার বিচার শেষ করতে মোট ২৬১ কার্যদিবসে বসেছে আদালত। এর মধ্যে ২৩৬ কার্য দিবসে রাষ্ট্রপক্ষ হতে ৩২ জন সাক্ষ্য দিয়েছে এবং আসামিরা আত্মপক্ষ সমর্থন করে বক্তব্য দিয়েছে ২৮ কার্য দিবস পর্যন্ত।

শুধু তাই নয়, দশ বছরেরও অধিক সময়ের এই বিচার প্রক্রিয়ায় মামলা থেকে রেহাই পেতে খালেদা জিয়া উচ্চ আদালতে গেছেন বার বার। তাঁর অনাস্থার কারণে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তিনবার এ মামলার বিচারক বদল করেছে। শুনানিতে হাজির না হওয়ায় তিনবার খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করেছে আদালত। খালেদা জিয়া যেভাবে চেয়েছে আদালত একজন সাবেক প্রধামন্ত্রী হিসেবে খালেদা জিয়ার সকল কথার গুরুত্ব দিয়েছে। বিচারিক আদালত সচ্ছ ও স্বাধীনাভাবে কাজ করেছে। মামলার সাথে সম্পৃক্ত নয়-এই ধরনের বক্তব্যও খালেদা জিয়ার মুখ থেকে ধৈর্য সহকারে শুনেছে।

এটা আমার মনগড়া কথা না, বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদেই বলা আছে। খালেদা জিয়ার আইনজীবীসহ খোদ বিএনপির সিনিয়র নেতাকর্মীরাও জানে না প্রকৃতপক্ষে এতিমখানা কোথায় বা আদৌ এতিমখানা হয়েছে কীনা! আবার অন্যদিকে অনুসন্ধানি সংবাদকর্মীরাও কবে, কীভাবে, কোন ব্যাংকে, কোন অ্যাকাউন্টে, কতটাকা, কে কীভাবে লোপাট করেছে তার বিস্তারিত বিবরণও তুলে ধরেছে। তাহলে কেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি নিয়ে ঔদ্ধত্য দেখানো হবে? কেন শেখ হাসিনাকে নিয়ে অপপ্রচার-মিথ্যাচার করা হবে? কেন বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের ভাবমুর্তি নষ্ট করার ষড়যন্ত্র হবে?

কারণ, এখানে বিচারহীনতার সংস্কৃতি বাস্তবায়ন করতে পারেনি বলেই বিএনপির সিনিয়র-জুনিয়র নেতাকর্মীর সাথে-সাথে খোদ খালেদা জিয়াও এ নিয়ে মিথ্যাচার করে জনগণকে বিভ্রান্ত করার ষড়যন্ত্র করেছে। যারা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেও ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে, যারা জাতীয় চার নেতাকে জেলখানায় বন্দি রেখে নিমর্মভাবে খুন করে খুনির বিচারকে নিষিদ্ধ করে; তারা আর যাই হোক আইনের শাসন মানতে পারে না। বিচারহীনতার সংস্কৃতি যাদের ব্যক্তি ও রাজনৈতিক আদর্শ; তারা দেশের বিচার ব্যবস্থাকে বার-বার প্রশ্নবিদ্ধ করার অপকৌশল গ্রহণ করবে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করে।

দুঃখজনক হলেও সত্য, বিএনপি কতটুকু বিচারহীনতার সংস্কৃতির গভীরে গিয়েছে যখন তাদের নেতা জেনারেল জিয়াউর রহমানের হত্যার বিচারের ব্যবস্থা থেকে আজও দূরে থাকে। খালেদা জিয়া শুধু একজন বিএনপির চেয়ারপার্সনই নয়, তিনি জেনারেল জিয়াউর রহমানের স্ত্রীও। তিনিও তার স্বামী হত্যার বিচার করেনি। অন্যদিকে তারেক জিয়া হাওয়া ভবনে লাশের ষড়যন্ত্র করলেও তার বাবাকে যারা লাশ বানিয়েছে সেই অপরাধীদের খুঁজে বের করার বিপরীতে শেখ হাসিনার মত মমতাময়ী নেত্রীকে হত্যা করে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূণ্য করতে চেয়েছিল! বঙ্গবন্ধু পবিত্র রক্তকে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র করেছিল।

জিয়ার অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছে- এটা শুধু জাতির জন্য দুঃখজনক নয়, এটা শেখ হাসিনার জন্য দুঃখজনক। কারণ তিনিও একজন নারী। আর নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় শেখ হাসিনার রয়েছে উজ্জল দৃষ্টান্ত। শেখ হাসিনা শুধু দেশের প্রধানমন্ত্রী নন, তিনি জাতির জনকের কন্যা। তিনি আইনের শাসনে বিশ্বাসী। ২১ আগস্ট গ্রেনেড ছুড়ে হত্যার ষড়যন্ত্রের কথা, ৭৫-এর ১৫ আগস্ট তার বাবাসহ পরিবারের ছোট্ট রাসেলকে পর্যন্ত হত্যার কথা, দেশে আসতে না দেওয়ার যন্ত্রণার কথা, স্বাধীনতাবিরোধীদের রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠার কথা ক্ষণিকের জন্য ভুলে গিয়ে সন্তানহারা মা খালেদা জিয়ার বাড়িতে গিয়েছিল তার মমতা আর ভালোবাসা নিয়ে।

লজ্জাজনক হলেও সত্য, বাড়ির দরজা থেকে রীতিমত দূর-দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিল বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে। অবহেলা, অপমান করেছিল দেশের প্রধানমন্ত্রীকে। তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছিল একজন মা হয়ে আরেকজন মা'র মমতাকে। সেদিন যারাই এই দৃশ্য অবলোকন করেছে, সবাই ছিঃ ছিঃ করেছে। কাকে একটা সময় দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভোট দিয়েছে? কার নেতৃত্বে একটা সময় বাংলাদেশ পরিচালিত হয়েছে? এই ধরনের কথাগুলোর সাথে অনেকেই নিজের সাথে নিজের তর্ক করেছে!

আদালতে খালেদা জিয়ার সাজা হয়েছে। সামনে আপিলের ব্যবস্থা আছে। সুপ্রিম কোর্ট আছে। তারপরে রিভিউ আপিলের সুযোগ আছে। বিএনপির উচিত হবে আইনি প্রক্রিয়ায় এগিয়ে যাওয়া। হতাশ না হয়ে মামলা কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা। মিথ্যাচার, অপপ্রচার বন্ধ করে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখা।

এই বয়সে এসেও খালেদা জিয়া আজ অসহায়। শুধু গৃহপরিচালিকা ছাড়া তার পাশে এখন কেউ নেই। যেমনি ছিল না একটা সময় স্বামী জিয়াউর রহমান ও স্বামীর সংসার। এখন উপলব্ধির সময়। যে বঙ্গবন্ধু তাকে নিজের মেয়ে বলে সম্বোধন করে তার স্বামী ও স্বামীর সংসার উদ্ধার করেছিল, যে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পেরেছে, সে বঙ্গবন্ধু হত্যার দিনে মিথ্যা জন্মদিন পালন থেকে বেরিয়ে আসা, ক্ষমা চাওয়া।

মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, ত্রিশ লক্ষ শহীদ ও দুই লক্ষ ধর্ষিতা নারীর প্রতি সম্মান-শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে সকল ভুল থেকে নিজেকে এবং বিএনপিকে মুক্ত করে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া। রাজাকার-স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গ ত্যাগ করে দেশ ও দেশের জনগণের জন্য রাজনীতি করবে এটাই সকলের আশা।

মনে রাখতে হবে, শেখ হাসিনা প্রতিহিংসার রাজনীতি অতীতেও করেনি, ভবিষ্যতেও করবে না। কারণ তিনি জানেন, সব কিছু ভালোবাসা দিয়েই অজর্ন করতে হয়। শেখ হাসিনা ও তার বিশাল কর্মীবাহিনী আরেকটি ২১ আগস্ট সৃষ্টি করেনি। বাংলাভাই সৃষ্টির মাধ্যমে আরেকটি ১৭ আগস্ট সিরিজবোমা হামলা করে জাতিকে জিম্মি করার ষড়ন্ত্র করেনি। দেশে-বিদেশে এত জনপ্রিয়তা থাকার পরেও বিরোধী রাজনৈতিক দল-মতকে নিশ্চিহ্ন করতে আরেকটি হাওয়া ভবন তৈরি করেনি।

মিথ্যাচার, অপপ্রচার শুধু জাতিকে ভিভ্রান্তই করে না, একটা সময় নিজের গ্রহণযোগ্যতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে। আধুনিক এই সভ্যতায় মানুষ অনেক দূর এগিয়েছে। বিএনপির নেতাকর্মীদেরও এগিয়ে যেতে হবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা বিএনপির নেতাকর্মীদের শুধু গ্রহণযোগ্যতাই বাড়াবে না, সভ্যতার বহিঃপ্রকাশও ঘটাবে। আর সেটাই জাতির প্রত্যাশা।

লেখক : সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম (বোয়াফ)