ভেঙে যাক মেন্সট্রুয়াল কাপ নিয়ে যত ট্যাবু

নাহিদ দিপা
Published : 3 Oct 2019, 10:52 AM
Updated : 3 Oct 2019, 10:52 AM

যখন আমি অনেক ছোট, কোনো এক ঈদে গ্রামে গেলাম। বাংলাদেশের দক্ষিণে একেবারে সুন্দরবনের লাগোয়া শরণখোলায় আমার বাবার আদি বাড়ি। আমার সাথে একই ক্লাসে পড়া আমার ফুপাতো বোনের বই নিয়ে একসাথেই পড়তে বসতাম তখন। ওর সাধারণ গনিত বই নিয়ে অংক করতে বসে খেয়াল করলাম, পাটিগনিতের বইয়ে যেসব অংকে 'মাসিক' কথাটা আছে, সেগুলো লাল কালি দিয়ে দাগ দেওয়া।

প্রথমে আমলে না নিলেও পরে বোনকে জিজ্ঞেস করলাম, এর কারণ। ও বললো, মেয়েদের যে প্রতি মাসে 'ইয়ে' হয় মানে 'রক্ত' পড়ে তুই জানিস? স্বাভাবিক ভাবেই আমি বললাম, না। আরো জানতে চাইলাম- তোর বইয়ে এগুলো এমন করে দাগ দেওয়া কেন? বললো, ওর ক্লাসের ছেলেরা করেছে। টিফিনে যখন ওরা মেয়েরা বাইরে যায়, তখন ক্লাসের ছেলেরা এই কাজ করে। আমার মাথায় তখন দ্রুত ঘুরপাক খাচ্ছিল, কী এগুলো? মাসিক কী? সেগুলো লাল কালিতে কেন দাগ দিতে হবে? কোনো উত্তর পাচ্ছিলাম না।

নিজের মাসিক যেদিন প্রথম হয়, সেদিনও জানতাম না বিষয়টা কি। মেয়েদের শরীর শুধু না, এই ধরিত্রীর সবচেয়ে বড় স্বাভাবিক বিষয়টা চূড়ান্ত অস্বাভাবিকভাবে আমার সামনে উপস্থাপিত হল কোনো রকম প্রস্তুতি ছাড়া। কারো সাথে আলাপ তো দূরের কথা, কি এক নিষিদ্ধ জীবনে প্রবেশ করলাম, নিজে নিজে তাই শুধু ভাবতাম।

খালাতো বোনের হাত ধরে বিশেষ সেই দিনগুলোর জন্য প্রথমে এল কাপড়, তারপরে তুলা…এই ছিল আমার সঙ্গী। স্যানিটারি প্যাডের সাথে আমার পরিচয় হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে। কি অবাক ব্যপার, তাই না? খরচের কথা মাথায় ঘুরতো, দুই প্যাকেট প্যাডের দামে সারা মাসের হলের খাবারের বিল দেওয়া যেত। তাই প্যাড কেনা বিলাসিতা মনে হতো। প্যাডের উপর টয়লেট টিস্যু তাই হলো আমার খরচ বাঁচানোর উপায়।

বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার দশ বছর পর, আজ কাজ করছি এমনই একটি সংস্থায়, যেখানে 'মেন্সট্রুয়াল হাইজিন' বা মাসিক কালের স্বাস্থ্য সচেতনতা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি আলোচনার বিষয়। দুদিন আগে একটা স্কুলে প্রায় শতিনেক কিশোর-কিশোরিদের সামনে আমি কথা বলছিলাম, এই মাসিক চলাকালে কী করতে হবে, আর কী করতে হবে না সেই বিষয় নিয়ে। জানালাম, যদি বাসা-স্কুল কোথাও জানতে না পারে এই 'মাসিক' এর ব্যপারে, তাহলে বিনামূল্যে ফোন করতে পারে কিছু সরকারি/বেসরকারি নম্বরে (জাতীয় স্বাস্থ্য বাতায়ন-১৬২৬৩, মেরী স্টোপস কল সেন্টার-০৮০০০২২২৩৩৩)।

অবাক হলাম, আমার ছেলে শ্রোতারা গভীর আগ্রহ নিয়ে শুনছে। তারা বলছে, ক্লাসে শিক্ষকরা তাদের এই সম্পর্কে বলে, সচেতন করে। ক্লাসে একই সাথে ছেলেমেয়েরা থাকলেও কতটা স্বাভাবিক ভাবে তারা এটা নিয়ে আলোচনা করে।

আমাদের সংস্থার একটা প্রজেক্ট থেকে বরগুনা, পাথরঘাটার ১৪টা স্কুল আর ১৬টা মাদ্রাসাতে ১২ প্যাকেট করে স্যানিটারি প্যাড দেওয়া হয়েছে। যাতে কোনো মেয়ে স্কুলে বা মাদ্রাসায় পিরিয়ড হলে সে তা ব্যবহার করতে পারে। একটা প্যাড বের হয়ে গেলে ছেলে-মেয়েরা টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে তা দিয়ে প্যাড কিনে আবার কিনে রেখে দেয়। এই চেইন চলছে সফলভাবে। এসব দেখি, শুনি আর ভাবি…কী দিন কাটিয়েছি আমি। এখন মাসিক নিয়ে কথা বলা কত সহজ। হাতের কাছেই কত সুন্দর সমাধান। যে স্যানিটারি প্যাড কেনা আমার জন্য ছিল বিলাসিতা, সেটা যে শুধু আমার জন্যই ছিল, তা কিন্তু না।; আমার আশে-পাশে অনেকেরই ছিল। এখন আমি এই অভাবের নাম জানি, একে বলে 'পিরিয়ড পোভার্টি'।

বাংলাদেশে যেখানে বেশিরভাগ পরিবারেই বাবা, স্বামী কিংবা ভাই-ই অর্থের যোগানদাতা তাদের কাছে এটি প্রয়োজনীয় মনে হয় না খুব একটা। আবার অনেক নারীই মনে করেন, আমরা সবাই-ই তো এই কাপড় ব্যবহার করেছি সারা জীবন ধরে, তাহলে এই হালের স্যানিটারি প্যাডের কী দরকার? শুধু শুধু বাড়তি খরচ। কিন্তু এটা যে সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করে, সে চিন্তা ক'জনে করে?

নতুন অফিসে এসে আরো দুইটা স্যানিটারি উপকরণের সাথে পরিচয় হল আমার। একটা হলো টেম্পুন, অন্যটা মেন্সট্রুয়াল কাপ। অনেক পড়াশোনা করার পর, মেন্সট্রুয়াল কাপে আগ্রহী হয়ে উঠলাম। অনেক খুঁজে খুঁজে কিনেও ফেললাম। ব্যবহার শুরু কীভাবে করবো, সেটা ভেবে, ইউটিউব ঘাঁটাঘাঁটি করে কত দিন গেল তার হিসাব নেই। কিন্তু মনস্থির করলাম, না ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেলে হবে না। আমার চেয়ে আমার অর্ধেক বা তারও কম লেখাপড়া জানা গার্মেন্টসে কাজ করা মেয়েটাও দেখি বেশি সাহসী; সে তো ট্যাম্পুন ব্যবহার করে। আমি তো তাও জানতাম না।

ততদিনে বাংলাদেশের গার্মেন্টসকর্মী নারীদের টেম্পুন ব্যবহার করার একটা পরিসংখ্যান আমার হাতে; গাজীপুরের ১৭টা গার্মেন্টসে ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ নারী কর্মীরা টেম্পুন ব্যবহার করে। সে যদি টেম্পুন পড়ার সাহস করতে পারে, তাহলে আমি নই কেন? এই জেদ নিয়েই শুরু হলো মেন্সট্রুয়াল কাপের সাথে আমার পথচলা। বিংশ শতাব্দির মাঝামাঝি এই মেন্সট্রুয়াল কাপ আবিস্কৃত হলেও তা আজো ততটা প্রচার পায়নি  ট্যাবু বা সংস্কারের জন্য।

বিশ্বের সেরা ব্র্যান্ড অরগানি কাপ ২০১২ সাল থেকে বিপণন করে আসছে বাজারে। তারা তাদের ৭ লাখ ব্যবহারকারীর উপর জরিপ চালিয়ে দেখেছে ৯৪ শতাংশ মেয়েরা যারা একবার মেন্সট্রুয়াল কাপে অভ্যস্ত হয়েছে তারা আর অন্য কিছু ব্যবহার করতে চায় না।

সিলিকনের তৈরি একটি কাপ ঠিকঠাক মতো ব্যবহার করলে যেখানে ১০ বছর পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়। একই সাথে একটা অর্থসাশ্রয়ী, স্বাস্থ্যকর আর আরামদায়ক। পার্বত্য অঞ্চলে, যেখানে পানির অভাব কিংবা বিল বা হাওড় বা বন্যা প্রবণ এলাকার মেয়েদের জন্য মেন্সট্রুয়াল কাপ একটি দারুণ সমাধান হতে পারে। প্রতিমাসে স্যানিটারি প্যাড কেনা বাবদ একজন মেয়ের গড়ে প্রতিবছর ছয় হাজার টাকা খরচ হয়। তার তিনভাগের একভাগ টাকা, মানে দুই হাজার টাকায় বিশ্বমানের একটি কাপ কিনে ১০ বছর ব্যবহার করা যায়।

এখন যখন পেছনে ফিরে তাকাই, তখন দেখি, কি ভয় আর দ্বিধা নিয়েই না আমি আমার মেয়েবেলা কাটিয়েছি। এই কিছুদিন আগেও কাটাতাম। যে কোনো কিছু প্ল্যান করার আগেই মাথায় থাকতো, ওই সময় পিরিয়ড থাকবে না তো! পিরিয়ড শুরু মানে আমি খেলতে যেতে পারছি না, মিটিং বা যে কোনো কিছুতে অফিসের বাইরে না যাওয়ার বাহানা খোঁজা।

এসব কিছুকে পেছনে ফেলে, প্রথম পিরিয়ড শুরুর ২৫ বছর পর আমি জানি, এখন পিরিয়ডের দিনগুলা অন্য আর দশটা স্বাভাবিক দিন। মেন্সট্রুয়াল হাইজিনের সবচেয়ে আধুনিক আবিস্কারের সাথে আমার পথ চলছি। মেন্সট্রুয়াল কাপ যে কোনো সর্বাধুনিক ইলেক্ট্রনিক গ্যাজেটের চেয়ে বেশি মূল্যবান এখন আমার কাছে।