লিবিয়ার পথে পথে

ডাক্তারের রোজনামচা
Published : 8 Jan 2012, 02:10 PM
Updated : 8 Jan 2012, 02:10 PM

বেশকিছু দিন যাবত কোনো কিছুই লিখতে পারি নি। প্রফেশনাল ব্যস্ততা ও অন্যান্য আরো কিছু কারণে সময় বের করে নেটেও বসা হয় নি। যখন ল্যাপটপ খোলার একটু সময় পাওয়া, পুরানো ছবিগুলো দেখতে দেখতে উপরের ছবিটি দেখে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলাম।

ছবিটি আমি যখন লিবিয়াতে কর্মরত ছিলাম, তখনকার তোলা। সবার বামে আছেন ইউক্রেনিয়ান ইউরোলজিস্ট ডাঃ ইউরি, এরপর বাংলাদেশের ডাঃ নিয়াজ (আমি, আর কী!), রুমানিয়ান জেনারেল সার্জন (নাম মনে করতে পারছি না), সুদানীজ জেনারেল সার্জন (উনার নামও মনে করতে পারছি না, আমার স্মরণশক্তি যে এতো খারাপ হয়ে গেছে, আমি আগে বুঝতে পারি নি, রীতিমত আতংকের ব্যাপার!) এবং সবশেষে লিবিয়ান জেনারেল সার্জন ডাঃ আলী। ইউরোপ, এশিয়া এবং আফ্রিকা! সাদা, কালো এবং নিগ্রো! কিন্তু সবাই আমরা মানুষ, মানুষ এবং মানুষ!

আমি ছিলাম গারিয়ান টিচিং হাসপাতালের স্পেশালিস্ট নিউরোসার্জন। গারিয়ান শহরটি আমাদের দেশের বান্দরবনের মতো, এক বিশাল পর্বতশ্রেণির গা বেয়ে উঠে যেতে হয়। পর্বতশ্রেণিটি নাফুসা মাউন্টেন রেঞ্জ নামে পরিচিত। লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপলী থেকে প্রায় আশি কিলোমিটার দক্ষিনে অবস্থিত নাফুসা মাউন্টেন এরিয়া লিবিয়ান সিভিল ওয়ারে খুব গুরুত্বপূর্ণ এক ভূমিকা রেখেছে। অনেক কাল থেকেই নাফুসা মাউন্টেন এরিয়া লিবিয়ার উপজাতি মানুষদের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ছিলো, কিন্তু গাদ্দাফীর শাসনামলে তাদের এই বৈশিষ্ট্য চাপা পড়ে, তাই যখন গণ আন্দোলন শুরু হয়, প্রথম থেকেই এই এলাকার জনসাধারণ বিদ্রোহীদের সমর্থন দেয়। ১৮ই আগষ্ট, ২০১১-তে বিদ্রোহী বাহিনী যখন গারিয়ান দখল করে, ত্রিপলী দখল করা তখন সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ত্রিপলীর পতন ঘটে ২৩ আগষ্ট, ২০১১।


নাফুসা মাউন্টেন রেঞ্জ

গারিয়ান টিচিং হাসপাতাল একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ছিলো। হাসপাতাল এরিয়াটি ছিলো বিশাল বড়ো। পর্বতশ্রেণির গা বেয়ে যখন আমাদেরকে নিয়ে (ওহ হো, বলাই হয় নি, লিবিয়াতে আমি একা যায় নি, আমার পিছু পিছু আমার অর্ধাঙ্গিনীও তাড়া করেছিলো) লিবিয়ান ড্রাইভার প্রাইভেট কারটাকে ঝড়ের গতিতে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো, আমি ভয় পাচ্ছিলাম না। মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছিলাম আর বাংলায় চিৎকার করে বলছিলাম, 'অসাধারণ! আমি মুগ্ধ!' লিবিয়ান ড্রাইভারটি আমার দিকে তাকিয়ে আরবিতে কী বললো, বুঝতে পারি নি, শুধু বুঝতে পেরেছি সেও আমার উচ্ছ্বাসের সাথে উচ্ছ্বসিত!

গারিয়ান শহরটিকে দেখে আমাদের খুব ভালো লেগে গেলো। বাংলাদেশের মফস্বল শহরের মতো, কিন্তু ছিম ছাম, সাজানো-গোছানো। পুরো নাফুসা মাউন্টেন রেঞ্জের লোক সংখ্যা চার লক্ষের বেশি হবে না, গারিয়ানে সেটা এক লক্ষের মতো। অথচ শহরটা আয়তনে প্রায় ঢাকার এক-চতুর্থাংশ হবে। পাহাড় গুলোর মাঝে দিয়ে মসৃন রাস্তা দিয়ে যখন আমরা সাঁ সাঁ করে যাচ্ছিলাম, কেনো জানি না, অসম্ভব ভালো লাগায় মনটা আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছিলো। গাড়ির স্পীডোমিটারে গতি তাই ১৩০ কিলোমিটার পার হয়ে গেলেও মনে হচ্ছিল আরেকটু জোরে গেলে ক্ষতি কী!

আমাদের ড্রাইভার মহাশয়টি ইংরেজী জানে না, আর আমরা আরবী জানি না। আমি আজও অবাক হয়ে যাই, কীভাবে ত্রিপলী এয়ারপোর্ট থেকে গারিয়ান হাসপাতাল পর্যন্ত এক ঘন্টার জার্নিতে আমরা একসাথে এসেছিলাম! হোক সে আরবীভাষী, হোক আমি বাঙ্গালি, হোক সে সাদা আর হোক আমি কালো, আমরা মানুষতো! পথে সে যখন গাড়ি থামিয়ে একাকী একটি রেস্টুরেন্টে ঢুকলো, স্বীকার করছি, তখন কিন্তু মনে হয় নি সে মানুষ! আমি আর আমার স্ত্রী তখন গাড়িতে বসে দোয়া দরুদ পড়ছিলাম, আর ভাবছিলাম সে কী সত্যি সত্যি গারিয়ান হাসপাতালের ড্রাইভার! একটু পরে যখন দুই হাতে দুইটা নেসক্যাফের গ্লাস কফি ভর্তি করে নিয়ে এসে বত্রিশখানা দাঁত বের করে আমাদের দুই জনকে দিলো, তখন মনে হলো, এই পৃ্থিবীতে তার চেয়ে আর ভালো মানুষ হয় না।

একটু পরে বুঝতে পারলাম, সে ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজী জানে, যেমন, My name Yakub. I am fine. Your Name?- এই রকমের ভাঙ্গা ইংরেজীতেই সে আমাদেরকে জানালো, আগামী বছর সে বিয়ে করবে, একজন ইউক্রেনিয়ানকে। ছবিও দেখালো, মেডিটারিয়ান সাগরের তীরে তোলা সেই ছবি দেখে আমার স্ত্রী একটু লজ্জাই পেয়ে গেলো। কিন্তু লোকটির সরলতা দেখে লিসার লজ্জা পেতেই লজ্জা লাগছিলো! ওহ হো, লিসা কে তা তো বুঝতে পারছেন, তাই না? লিসা হচ্ছে আমার তিনি! ড্রাইভার যখন লিসার নাম শুনে বার বার লিজা লিজা বলছিলো, তখন কিছুটা বিব্রত হয়ে গেলাম। কিন্তু তার সরল হাসি দেখে কিছুক্ষন পরে আমি নিজেই লিজা লিজা ডাকা শুরু করলাম।

অবশেষে হাসপাতাল কম্পাউন্ডের ভিতরে প্রবেশ করলাম। প্রথম দেখাতেই এই বিশাল হাসপাতালকে খুব ভালো লেগে গেলো। হাসপাতালের প্রবেশ পথেই বিলবোর্ডে গাদ্দাফীর বিশাল এক ছবি দেখলাম, যা প্রায় পুরো রাস্তাতেই কিছু পর পর ছিলো। ছবিতে সানগ্লাস পরিহিত গাদ্দাফীর পাশে আরবীতে কী লেখা ছিলো সেটা বুঝতে না পারলেও বড় করে ইংরেজীতে লেখা 40- এর জন্যই বুঝতে পারছিলাম এই বছর গাদ্দাফীর শাসনের চল্লিশ বছর পূর্তি হচ্ছে।


গারিয়ান টিচিং হাসপাতালের সামনে চল্লিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে গাদ্দাফীর বিশাল বিলবোর্ড

২০১১-তে গাদ্দাফীর 42 বছর পূর্ণ হতো। সবগুলো বিলবোর্ডে 40 এর জায়গায় 42 লেখা ছিলো। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! ১৯৬৯ সালের ১লা সেপ্টেম্বর রাজা ইদ্রিসের কাছ থেকে এক রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের বিয়াল্লিশ বছর পূর্ণ হবার আগেই, ২০১১ সালের ২৩শে আগস্ট গাদ্দাফী নিজেই ক্ষমতা হারালেন!

(চলবে)