লিবিয়ার পথে পথেঃ ২

ডাক্তারের রোজনামচা
Published : 13 Jan 2012, 11:37 AM
Updated : 13 Jan 2012, 11:37 AM

আমার জন্য লিবিয়ায় যাওয়াটাই ছিলো এক অদ্ভুত ব্যাপার। একদিন পত্রিকায় লিবিয়ান স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের অধীনে ডাক্তার নেবার বিজ্ঞপ্তি দেখে অনেকটা খেয়াল বশেই আমি আর লিসা ঢাকার হোটেল ইশা খাঁতে ভাইভা দিতে গিয়েছিলাম। ভাইভা নেবার জন্য লিবিয়ান স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের তিনজন কর্মকর্তাও ঢাকায় এসেছিলেন। ভাইভাতে মেডিকেল জ্ঞান সংক্রান্ত তেমন কোনো প্রশ্ন করা হলো না। তারা আমাদের কাগজপত্র দেখলেন। কিছু টুকটাক প্রশ্ন করলেন। আমরাও কিছু জিনিস জানতে চাইলাম। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো বেতন নির্ধারন নিয়ে। মাছের বাজারে গিয়ে মাছ কেনার অভিজ্ঞতা না থাকলেও কীভাবে যেনো সেদিন মাছের বাজারের মতোই দরদাম করেছিলাম, চিন্তা করলে আজো অবাক লাগে! শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো মেডিসিনের মেডিকেল অফিসার হিসেবে লিসা এবং নিউরোসার্জারীর রেজিস্ট্রার হিসেবে আমি যোগদান করবো।

আমরা চাকরী ফাইনাল করে ফেললাম, কিন্তু যেতে পারবো কী না তখনো সেটা নিশ্চিত ছিলাম না। কারণ, আমরা জানতাম, আব্বু কখনোই আমাদেরকে দেশের বাইরে যেতে দিবেন না। সত্য কথা বলতে গেলে, লিবিয়ার ব্যাপারটা আব্বুকে বলারই সাহস পাচ্ছিলাম না। এভাবে প্রায় এক মাস চলে গেলো। ভিসার জন্য আমরা পাসপোর্টও জমা দিয়ে ফেললাম, অথচ তখনো আব্বু কিছুই জানতেন না।

লিবিয়াতে কেনো যেতে চাচ্ছিলাম সেটা এক বিশাল ব্যাপার। কারণ, ভাইভা পরীক্ষা দিয়েছিলাম শুধুমাত্র খেয়ালের বশে। চিন্তা করেছিলাম, ভাইভাতে চান্স পেলেও যাবো না। ঠিক এই সময়ে এডহকের মাধ্যমে প্রায় সাড়ে চার হাজার ডাক্তার নিয়োগ দেবার ঘোষনা দেন প্রধানমন্ত্রী। আব্বুর ইচ্ছা ছিলো যাতে আমরা এডহকে যোগদান করি। এই ব্যাপারে উনি আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী কিছু নেতার সাথে কথাও বলেছিলেন। আসলে এডহকের নিয়োগ ছিলো রাজনৈতিক, যতোই সেটা সরকার অস্বীকার করুক। এডহকের সময় প্রতিটি মেডিকেল কলেজ থেকে কয়েকটা লিস্ট করা হয়। সক্রিয় আওয়ামী পন্থী, মধ্যপন্থী (এদের ভিতরে ছিলো যারা দুর্বলভাবে বিএনপি করতো, এবং অন্যান্য বামপন্থী), কালো তালিকাভুক্ত (এই গ্রপে ছিলো জামায়াত শিবিরের সমর্থকরা এবং যারা সক্রিয়ভাবে ছাত্রদল বা বিএনপি করতো) এবং দলমত নিরপেক্ষ। তালিকার বাইরে ছিলো তদবিরকারীদের দল। আমার মেডিকেল কলেজের সিনিয়ররা আমাকে কোন তালিকাভুক্ত করেছিলো, আমি জানতাম না, আসলে জানার চেষ্টাও করি নি। দুই একদিন স্বাচিপ অফিসে গিয়েছিলাম, সেখানে গিয়ে স্বার্থান্বেষীদের ভীড় দেখে পরে আর যেতে ইচ্ছে করলো না। সবচেয়ে অবাক হয়েছিলাম নিজের কিছু ব্যাচমেটদের আচরণ দেখে। সদ্য গজিয়ে উঠা এই সব লীগ পন্থীদের মধ্যে আমি অনেককেই জানতাম যারা বিএনপির আদর্শের অনুসারী। এডহক নিয়ে যে নোংরা খেলা শুরু হয়েছিলো, আমাদের এডহকে নিয়োগ নিশ্চিত জেনেও আমি খুব হতাশ ছিলাম।

লিবিয়ার ভাইভা দিয়ে আসার পর আমি লিবিয়ার সম্পর্কে জানতে শুরু করলাম। প্রাচীন কিছু সভ্যতার কেন্দ্র, ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত এই দেশ সম্পর্কে যতই জানতে থাকলাম, ততই মুগ্ধ হতে লাগলাম। আর্কিওলজিকাল দিক থেকে লিবিয়া অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী একটা দেশ। ছোটবেলা থেকেই এইসব ব্যাপারে আমার প্রচন্ড একটা ঝোঁক ছিলো। ক্রমেই লিবিয়া যাওয়ার ব্যাপারে আমি ও লিসা উৎসাহী হয়ে উঠি। সর্বোপরি, বেতনের পরিমানটাও ছিলো আমাদের লিবিয়া যাওয়ার ব্যাপারে প্রধান একটা কারণ।

অবশেষে, সিদ্ধান্ত নিলাম আব্বুকে জানাবো। আমি তখন ঢাকার বাইরে থাকতাম। সিরাজগঞ্জের খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারী বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে সেখানে ভালোই ছিলাম। আমরা কয়েকজন তরুন ডাক্তার একযোগে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতাল থেকে এসে সেখানে নিউরোসার্জারী বিভাগ চালু করেছিলাম। ঠিক করলাম, পরবর্তী সপ্তাহে ঢাকায় গিয়ে আব্বুর সাথে কথা বলে লিবিয়ায় যাওয়ার ব্যাপারে আমাদের সিদ্ধান্তের কথা জানাবো। আব্বুর প্রতিক্রিয়া কী হবে, সেটা নিয়ে খুব চিন্তায় ছিলাম।

মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক। ঢাকায় যাবার দুইদিন আগে এক প্রচন্ড ব্যস্ত দুপুরে, লাঞ্চের সময় আমার ছোট বোন ফোন করে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললো আব্বু আর এই পৃ্থিবীতে নেই! সকালে স্বরাষ্ট্রসচিবের সাথে এক গুরুত্বপূর্ণ সভায় যোগদানের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে এসে করিডোর দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ করে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মেঝেতে পড়ে যান। সামনের দরজাতে মাথায় আঘাত লেগে রক্তপাতও শুরু হয়। দ্রুত নিকটবর্তী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরী বিভাগে নেওয়া হলে কর্তব্যরত ডাক্তার তাঁকে মৃত ঘোষনা করেন। তাঁর একমাত্র ছেলে আমি ডাক্তার হয়েও তাঁর জন্য কিছুই করার কোনো সুযোগ পেলাম না। আমাকে এই বিশাল পৃ্থিবীতে সম্পূর্ণ একা রেখে উনি আম্মুর সাথে দেখা করতে চলে গেলেন!

আব্বুর মৃত্যুর পর আনুষঙ্গি্ক কাজগুলো সারতে প্রায় একমাস হয়ে গেলো। এই সময় জানলাম আমাদের লিবিয়ায় যাওয়ার ভিসা হয়ে গেছে। যে কথা আমরা আব্বুকে জানাতে ভয় পাচ্ছিলাম, আল্লাহ আমাদেরকে সেই কথা তাঁকে জানাতেই দিলেন না। হয়তো আল্লাহ চেয়েছিলেন, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আব্বু যাতে জেনে যেতে পারেন তাঁর ছেলে তাঁর পাশেই আছেন। লিবিয়ার ফ্লাইটের আগের দিন হোটেল শেরাটনে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন আমাদের হাতে লিবিয়ার ভিসাসহ পাসপোর্ট তুলে দিলেন। এডহকের ভাইভার আগের দিনই ছিলো আমাদের ফ্লাইটের তারিখ!

বামেঃ প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে ফুলের তোড়া দিয়ে স্বাগতম জানাচ্ছে লিসা, পাশে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ের সচিব
ডানেঃ মন্ত্রীর কাছ হতে পাসপোর্ট নিচ্ছি আমি