লিবিয়ার পথে পথে (৩)

ডাক্তারের রোজনামচা
Published : 23 Jan 2012, 06:59 PM
Updated : 23 Jan 2012, 06:59 PM

ত্রিপোলি যাবার জন্য ফ্লাইট ঠিক করে দিয়েছিলো লিবিয়ান সরকারের বাংলাদেশী এজেন্ট। তারা প্রথম ফ্লাইটের জন্য আফ্রিকিয়া এয়ারলাইন্সের টিকেট কেটেছিলো। প্রথম ব্যাচে আমরা প্রায় তিরিশ জনের মতো ডাক্তার এবং সত্তর জনের মতো নার্স একসাথে গিয়েছিলাম। আমাদের ফ্লাইট ছিলো রাতের বেলা। আফ্রিকিয়া এয়ারলাইন্সে ল্যাগেজ বহন করার ক্ষেত্রে আমরা এক সুবিধা পেয়েছিলাম, আর সেটা হলো প্রতিজনে প্রায় ষাট কেজির মতো মালামাল বহন করার সুবিধা। আমি পৃথিবীর আর অন্য কোন এয়ারলাইন্সে এরকম সুবিধা দেখিনি।

এতো বেশি মালামাল বহন করার সুযোগ পেয়ে লিসা এর পূর্ণ ব্যবহার করতে চাইলো। কোত্থেকে যেনো সে শুনলো লিবিয়াতে এখন শীত, অতএব সারা দিন রাত ঢাকার বিভিন্ন মার্কেট ঘুরে ঘুরে বাংলাদেশের গরমের দিনে লিবিয়ার শীতের জন্য কাপড় কেনা কাটা শুরু করলো! আর আমি বাধ্যগত স্বামীর মতো ওর পিছনে আঠার মতো লেগে রইলাম। মেডিকেলের কোনো বইও বাদ গেলো না। ওর দেখাদেখি আমিও সাহসী হয়ে উঠলাম, আমার ডিভিডির সংগ্রহও এখানে রেখে যেতে মন চাইলো না।

যাত্রার দিনে ঢাকা হযরত শাহজালাল এয়া্রপোর্টে পৌঁছে দূর থেকে টারমাকে বিমানটিকে দেখে কেমন যেনো অনুভূতি হচ্ছিল। এতদিনের পরিচিত সমাজ ব্যবস্থা, মানুষ জন, আত্নীয়-স্বজন সব ছেড়ে নতুন এক সমাজে, নতুন এক পরিবেশে, নতুন এক সংস্কৃতির মধ্যে যাচ্ছি, মনে মনে ভাবছিলাম ভুল করছি না তো! এয়ারপোর্টে বোনদের কান্না, আত্নীয়দের বেদনা বিধুর চেহারা দেখে খুব খারাপ লাগছিলো, ঠিক করেছিলাম সবার সামনে কিছুতেই আমি ভেঙ্গে পড়বো না। তারপরও চোখ অশ্রুসজল হওয়াটা কেউ ঠেকাতে পারেনি।

আফ্রিকিয়া এয়ারলাইন্স লিবিয়ান সরকারের সরাসরি মালিকানাধীনে পরিচালিত একটি রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থা। ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত এই এয়ারলাইন্সের লোগো হচ্ছে 9.9.99 যা 'সিরতে ঘোষনা'-র দিনকে স্মরন করে করা হয়েছে, যে ঘোষনা 'আফ্রিকান ইউনিয়ন' প্রতিষ্ঠার ভিত্তি ছিলো। গাদ্দাফীর ইচ্ছে ছিলো আফ্রিকিয়াকে এমিরেটসের মতো একটি সংস্থায় পরিণত করা, যেটা ত্রিপোলীকে কেন্দ্র করে পুরো আফ্রিকা মহাদেশের এয়ারলাইন্সে পরিণত হবে। এখানে একটু 'সিরতে ঘোষনা' নিয়ে লেখার লোভ সামলাতে পারছি না। ১৯৯৯ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর গাদ্দাফীর জন্মস্থান সিরতে আফ্রিকার সরকার প্রধানদের এক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই শীর্ষ সম্মেলনেই আফ্রিকার নেতারা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মতো আফ্রিকান ইউনিয়ন গঠন করার ব্যাপারে একমত হোন। তারা ২০০০ সালের মধ্যে আফ্রিকান ইকোনমিক কমিউনিটি (African Economic Community), আফ্রিকান সেন্ট্রাল ব্যাংক (African Central Bank), আফ্রিকান মানেটারী ইউনিয়ন (African Monetary Union), আফ্রিকান কোর্ট অব জাস্টিস (African Court of Justice) এবং প্যান- আফ্রিকান পার্লামেন্ট (Pan-African Parliament) গঠন করার ব্যাপারেও ঐকমত্যে পৌঁছান। এবং এইসমস্ত ব্যাপারে লিবীয় নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফির ভূমিকাই ছিলো সবচেয়ে বেশি। আসলে মনের গহীনে তার আফ্রিকার রাজা হবার এক সুপ্ত বাসনা খেলা করছিলো।

আমাদের বিমানটি ছিলো একটি A330 মডেলের এয়ারবাস, আর টিকেট ছিলো ইকোনমি ক্লাসের। ঢাকা থেকে ত্রিপোলী যাবার পথে কোনো যাত্রা বিরতি নেই, সময় লাগবে প্রায় এগার ঘন্টা। সিটের অবস্থা দেখে আমরা প্রমাদ গুনলাম। এই দীর্ঘ যাত্রায় এই ধরনের আসন ব্যবস্থা খুবই কষ্টকর। টিকেটে কোনো নির্দিষ্ট আসন নম্বর ছিলো না, যে যেভাবে পেরেছে, বসেছেন। আমি আর লিসা দ্রুত জানালার পাশে দুইটি আসন দখল করতে সক্ষম হয়ে বিজয়ের হাসি দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি, আসনটি বিমানের ডানার পাশে! লিসার চেহারা দেখে খুব কষ্ট লাগছিলো, তারপরো ওকে সান্তনা দিলাম এই বলে যে, সারা রাত তো ঘুমাবে!

পুরো একোনমি ক্লাসটিকেই কোনো এক শ্রেণী কক্ষের মতো মনে হচ্ছিল। একই উদ্দেশ্যে, একই গন্তব্যের দিকে যাওয়া প্রায় একশ জন নারী পুরুষের কল কাকলীতে খুব একটা খারাপ লাগছিলো না। আমাদের পাশের আসনেই বসেছিলেন এক বয়স্ক ডাক্তার, নাম সাইদুর রহমান, যাচ্ছেন একজন পেডিয়াট্রিক্স ডাক্তার হিসেবে। তাঁর পাশেই বসেছিলেন ডাঃ ফরিদ, যিনি সরকারী চাকরী ছেড়ে যাচ্ছেন একজন জিপি (জেনারেল প্রাকটিশনার) হিসেবে। তাঁর পিছনে বসেছিলেন একজন কার্ডিওলজিষ্ট, এভাবে আরো অনেকে। বিমানেই পরিচিত হচ্ছিলাম দুইজন মহিলা ডাক্তার সাবিনা আপা এবং ফরিদা আপার সাথে। ফরিদা আপা যাচ্ছেন একা, তাঁর মনে আশা কয়েক মাস পর স্বামী আর মেয়েকেও নিয়ে যাবেন সেখানে। দেখা হলো আরো অনেক পরিচিত নার্সদের সাথেও। মোবাইল ফোনে সবার শেষ মুহূর্তের কথা বলা দেখে আমার কষ্ট লাগা অনুভূতিটা আস্তে আস্তে মুছে যেতে লাগলো।

বিমানবালারা ছিলো সব লিবিয়ান। আমি আবার সবসময়ই সুন্দরীর পূজারি, পাশে যতোই লিসা থাকুক! বার বার আড়চোখে তাদের দিকে তাকাতে তাকাতে মনে মনে ভাবলাম- এই এগার ঘণ্টার যাত্রা নিশ্চয়ই খারাপ যাবে না! একসময় যখন বলা হলো, সবার সীট বেল্ট বাঁধতে, মোবাইলের সুইচ অফ করতে, দেখতে পেলাম লিসা আমার হাতটি শক্ত করে ধরলো। ফিস ফিস করে বললো, "বাংলাদেশ ছেড়ে যাচ্ছি! আবার কবে আসবো!" জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালাম, ডানার আড়াল দিয়ে দেখতে পাচ্ছি বিমানটি নীল আকাশের দিকে উড়াল দিচ্ছে।