এডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন: মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়, কারণে-অকারণে বদলায়

-নিঝুম মজুমদার
Published : 25 Dec 2011, 02:46 PM
Updated : 25 Dec 2011, 02:46 PM

এডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন। সুপ্রীম কোর্ট আইনজীবি সমিতির (বি এন পি সমর্থিত) সভাপতি। তার জীবনের এই ৭০ পেরুনো বয়সে যত শক্তি রয়েছে, ঠিক তার চাইতেও বহুগুন শক্তি দিয়ে তিনি লড়ে চলেছেন নিজামী, সাঈদী, গোলাম আজম, কামারুজ্জামান, কাদের মোল্লা, সাকা তথা যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত আসামীদের পক্ষে। সুপ্রীম কোর্ট, হাইকোর্ট, আমেরিকা, লন্ডন, অস্ট্রেলিয়া, কোথায় নেই তিনি?? "সূর্যের থেকে বালি গরম" কথাটির মর্ম প্রতি দিনেই তিনি বুঝিয়ে দিচ্ছেন বাংলাদেশের প্রত্যেকটি মানুষকে। ২০১০ সালের ২৫ শে মার্চ তারিখে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনাল শুরু হবার আগের থেকে আজ পর্যন্ত তিনি তার মুখ দিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন রাত দিন এসবের হিসেব না করেই।

আজও যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক একটি খবরে জানতে পারলাম যে, ট্রাইবুনালে মাহবুব হোসেন যুদ্ধাপরাধে আটক সাঈদীর পক্ষ হয়ে, "নিজামুল হক নাসিম বিষয়ে" আদালতে বক্তব্য দিয়েছেন। এই খবরটি পড়েই বেশ নস্টালজিক হয়ে গেলাম। চলে যেতে ইচ্ছে হলো আজ থেকে প্রায় ৪০ বছর আগের একটি ঘটনায়। যে ঘটনাতে খন্দকার মাহবুব এই বিচারালয়েই ছিলেন চীফ পাবলিক প্রসিকিউটর হিসেবে। দালাল আইন ১৯৭২-এ লড়েছেন রাজাকারদের বিপক্ষে। বক্তব্য দিয়েছেন তাদের অপরাধের কথা বলে, তাদের ঘৃণ্য কর্মকান্ডের কথা উদ্ধৃত করে। যার এডভোকেসিতেই রাজাকার-আলবদরদের যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয়েছে, ফাঁসি হয়েছে, বছরের পর বছর শাস্তি হয়েছে, সেই মাহবুব হোসেন আজ সেই একই মুখ দিয়ে বলছেন রাজাকারদের পক্ষে। সেই একই মানুষ।

আসুন ১৯৭২ সালে খন্দকার মাহবুব হোসেনের ওকালতিতে শাস্তি হওয়া কয়েকটি মামলার সংক্ষিপ্ত রায় জানিঃ

১) সেপ্টেম্বর ৮, ১৯৭২ সাল। দৈনিক সংবাদের একটি রিপোর্টে জানা যায়, হানাদার বাহিনীর দালালী ও অগ্নিসংযোগ অভিযোগের দায়ে দুই জনের যাবদজ্জেবন কারাদন্ড। (ট্রাইবুনালের স্থানঃ কালিগঞ্জ। বিচারকঃ জনাব আব্দুল হান্নান চৌধুরী। আইনের ধারাঃ ১৯৭২ সালের দালাল আইন এর ১(খ) এবং বাংলাদেশ দন্ডবিধির ৪৩৬ নাম্বার ধারা।

২) ২৯ নভেম্বর ১৯৭২ সালের দৈনিক বাংলার একটি রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে,২৮ শে নভেম্বর তারিখে খুনী রাজাকার আব্দুর রহমানের মৃত্যুদন্ড ঘোষনা করে ট্রাইবুনালের জজ খোরশেদ আলী। খুনী রাজাকার আব্দুর রহমান নারায়নগঞ্জ পৌরসভার কর্মচারী গোলাম মোস্তফাকে তার রাজাকার বাহিনী নিয়ে নির্মম ভাবে গুলি করে হত্যা করে। এই মামলায় রাজাকারদের বিপক্ষের উকিল ছিলেন এই তৎকালীন স্পেশাল পিপি খন্দকার মাহবুব হোসেন। তার এডভোকেসিতেই ফাঁসির হুকুম হয় রাজাকার আব্দুর রহমানের।

৩) ১ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩ সালের দৈনিক বাংলার একটি রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, হত্যার উদ্দেশ্যে ব্যাক্তিকে অপহরণ, দখলদার বাহিনীর দালালী ও বস্তিবাসী বহু বাঙালীক মেয়েকে ধর্ষন করার দায়ে অভিযুক্ত শাহাজানপুর কলোনীর ত্রাস রাজাকার কমান্ডার শাহাজান ওরফে মুন্নাকে মৃত্যুদন্ড দেবার রায় ঘোষনা করেছেন স্পেশাল ট্রাইবুনালের জজ জনাব এস এম মাহমুদ। এই মামলাতে রাজাকারদের বিপক্ষ আইনজীবি হিসেবে মামলা পরিচালনা করে স্পেশাল পি পি খন্দকার মাহবুব হোসেন।

অথচ..।

উপরের ভিডিওটিতে কিংবা দেশের সকল পত্র-পত্রিকাতে আজ আদাজল খেয়ে নেমে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে কি বলছে খন্দকার মাহবুব হোসেন, এই কথাটি আজ সকলেই জানেন।

উপরের ভিডিওটিতে একের পর এক মিথ্যাচার করে গ্যাছে খন্দকার মাহবুব। সবচাইতে বড় যে মিথ্যেটি বার বার উল্লেখ করেছে মাহবুব সেটি হলো- বর্তমানে আটককৃতদের কারো বিরুদ্ধেই নাকি তখন কোনো মামলা ছিলো না।

কিন্তু ইতিহাস যে তা বলে না… মাহবুবের কথা যে মিথ্যা, সেটির উদাহরণ মাত্র দুইটি মামলা দিয়েই সহজেই প্রমাণ করা যায়।

ক) রাজাকার কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার পর প্রথম মামলা হয় ১৯৭২ সালে। মামলার নম্বর হচ্ছে- (৫)৭২, জি আর নং- ২৫০ (২) ৭২।মামলা করেন শহীদ বদিউজ্জমানের ভাই হাসানুজ্জামান। উল্লেখ্য যে, কামারুজ্জামান তখন পলাতক আসামী ছিলো।

খ) সাকা চৌধুরীর নামে ১৯৭২ সালে দালাল আইনে চট্রগ্রাম জেলার হাট হাজারী থানায় ১৩/৪/১৯৭২ তারিখে ১৭ নং মামলা দায়ের হয়। রাউজান থানা ৪১(১)৭২ নং এবং ৪৩(১)৭২ নং মামলা দায়ের করা হয়।

নতুন চন্দ্র সিংহ হত্যা মামলা হয়েছিলো ১৯৭২ সালে। নতূন চন্দ্র সিংহ এর পূত্র সত্যরঞ্জন সহ মোট ১২ জন সাক্ষী ছিলো ছিলেন এই মামলায়। মামলার এফ আই আর নাম্বার হচ্ছে- ইউ/এস/৩০২/১২০(১৩)/২৯৮ দন্ডবিধি। আসামীদের মধ্যে সাকা সহ আরো ৫ জন পলাতক ছিলো এবং সাকার বাবা ফকা সহ অন্য আসামীদের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে বলে চার্জশীটে বলা হয়েছিলো।

উপরের এসব উদাহরন দিতে দিতে আমি ক্লান্ত। আর কত মিথ্যাচারের মুখোশ উন্মোচন করা যায়? আর কত জবাব দেয়া যায় মিথ্যের? একটি দেশে এতগুলো মানুষকে ধরে ধরে মেরে ফেলা হয়েছে আর সেটির জন্য, সেটির বিচারের বাঁধা দূর করবার জন্য সবচাইতে বড় যুদ্ধ করতে হচ্ছে এই দেশেরই কিছু ভ্রষ্ট আর নষ্ট হয়ে যাওয়া মানুষের বিপক্ষে। যারা এই দেশেরই আলো বাতাসে জন্ম নেয়া বেঈমান। এই দুঃখ আমি কই রাখি?

খন্দকার মাহবুব আজকে বদলে গ্যাছেন ক্ষমতার লোভে, প্রতিপত্তির লোভে। অথচ এই লোকটিই ১৯৭২ সালের শুরু হওয়া দালাল আইনে এজলাসের সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলেছেন রাজাকার-আলবদরদের বিপক্ষে। যে লোকটি গরু চোর, ছাগল চোর, মানুষ হত্যাকারী, ধর্ষনকারী রাজাকারদের শাস্তি নিশ্চিত করাবার জন্য মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ওকালতি করে গিয়েছিলেন, সেই লোকটি-ই আজ সেই একই কন্ঠে রাজাকারদের বিচার বন্ধের সবচাইতে বড় অগ্রদূত। পৃথিবীর কাঠিন্য দেখতে দেখতে এতই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি যে, আজ নৈতিকতার এত বড় পতন দেখেও যতটা অবাক হবার ততটা হতে পারিনা। যতটা বিষ্মিত হবার, ততটা বিষ্মিত হতে পারিনা।

নিজেকে বুঝাবার চেষ্টা চালাই। নিজেকে বলি, ১৯৭২ সালে মাহবুব পাবলিক প্রসিকিউটর হিসেবে শুধু মাসিক সেই সরকারী ৩০০ টাকার জন্যই রাজাকারদের বিরুদ্ধে লড়েছে। আজ সময়ের ব্যাবধানে হয়ত এই মাহবুব ৩০ কোটি টাকার পেয়েই আবার যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে বলেছে। কাল হয়ত এই মাহবুবকে আরো কোটি খানেক বাড়িয়ে দিলে তার মায়ের বিরুদ্ধেই আদালতে বলবে।

ইনফ্যাক্ট… বলছেই তো!!! মা আর দেশ কি আলাদা???