যে কারনে বিদেশী আইনজীবীরা ট্রাইবুনালে লড়তে পারছেন না

-নিঝুম মজুমদার
Published : 10 Jan 2012, 02:03 PM
Updated : 10 Jan 2012, 02:03 PM

যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনালের ক্ষেত্রে বিদেশী আইনজীবিরা নাকি বাংলাদেশের কোর্টে মামলা লড়তে পারছেন না, এবং তাদের সে সুযোগ নাকি দেয়া হচ্ছে না। এবং এই আইনজীবিদের লড়তে দেয়া হলে নাকি তারা মোটমুটি সব কিছু উল্টিয়ে এবং পালটিয়ে ফেলত বলে ইদানীং শোনা যাচ্ছে জামাত ও বি এন পির সমর্থক ও ব্লগারদের কল্যাণে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, যিনি চাইবেন, তিনিই কি বাংলাদেশের লোয়ার কিংবা আপার কোর্টে প্র্যাক্টিস করতে পারবেন? এটা কি সম্ভব?

আসুন একটু আইন ও নীতিমালাগুলো জানি-

বাংলাদেশের বার কাউন্সিলে প্রতি ডিসেম্বর ও ফেব্রুয়ারীতে লোয়ার কোর্টে পরীক্ষা হয় এবং তারপরে অনুষ্ঠিত হয় ভাইবা। এসব পরীক্ষায় সফল ভাবে উত্তীর্ণ হলেই একজন ব্যাক্তি বাংলাদেশের আদালতে প্র্যাক্টিস করতে পারবেন। এই যে আমি পরীক্ষা আর ভাইবার কথা বললাম, সেটা হোলো লোয়ার কোর্টে প্র্যাক্টিস করবার নিয়ম। এই সার্টিফিকেট পেতেই লেগে যায় এক বছর থেকে দড় বছরের মতন।

প্রথমতঃ লোয়ার কোর্টে আইনজীবি হিসেবে প্র্যাক্টিস করবার নীতিমালা আমাদের জানতে হবে। নীচের এই বর্ণিত ডকুমেন্টস গুলো জমা দিতে হবে সংশ্লিষ্ঠ ব্যাক্তি বা অফিসের কাছে।

এগুলো হচ্ছেঃ

ক) এগ্রিমেন্ট লেটার
খ) এফিডেভিট
গ) ব্যাঙ্কের রশিদ

১৯৭২ সালের বার কাউন্সিলের রুলের ৩(১১) ধারা মতে এই এগ্রিমেন্ট লেটারে লেখা থাকবে যে আলোচ্য ব্যাক্তি যে কোর্টে প্র্যাক্টিস করতে চায় সেই কোর্টের নাম, ১০ বছর প্র্যাক্টিসের অভিজ্ঞতা রয়েছে এমন আইঞ্জীবির সাথে আলোচ্য ব্যাক্তির ( যিনি লোয়ার কোর্টে প্র্যাক্টিসের জন্য আবেদন করছেন) একটি চুক্তিপত্র যেখানে উল্লেখ থাকবে যে এই আইনজীবির সাথে তিনি কাজ করতে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। ১৫০ টাকার নন-জুডিশিয়াল একটা স্ট্যাম্পে এই চুক্তিপত্র লিখিত থাকতে হবে যেখানে অভিজ্ঞ আইনজীবির তত্ত্বাবধানে উল্লেখিত ব্যাক্তি যে কমের পক্ষে ৬ মাস তার সাথে আইন চর্চা তথা তাঁর সাথে কাজ করবেন সেটি লিখিত থাকবে।

এরপর এফিডিভিট করতে হবে ৫০ টাকা দামের নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে । একটা ব্যাপার মাথায় রাখতে হবে এই ক্ষেত্রে যে, এই কাগজ পত্র জমা দিতে হবে প্রথমে এবং পরে যখন প্রার্থী ৬ মাসের তার প্র্যাক্টিস বা পিউপোলেজ (ইন্টার্নির মতন) শেষ করবেন ১০ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন আইনজীবির সাথে তখনই তিনি লিখিত পরীক্ষার জন্য বিবেচ্য হবেন। এই লিখিত পরীক্ষার পর তার ভাইভা অনুষ্ঠিত হবে। এবং এই সবগুলো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে ও উত্তীর্ণ হলেই তিনি আমাদের লোয়ার কোর্ট/ জজ কোর্টে প্র্যাক্টিসের সুযোগ পাবেন।

উল্লেখ্য যে, এই লিখিত পরীক্ষা দেবার জন্যও আবার অনেক ডকুমেন্টস সাবমিট করতে হবে। যেমন-

১) এপ্লিকেশন ফর্ম

২) ক্যারেক্টার রেফারেন্স (ফার্স্ট ক্লাস অফিসার থেকে)

৩) এফিডেভিট

৪) এল এল বি'র সার্টিফিকেট

৫) মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের সার্টিফিকেট

৬) ফি প্রদানের রিসিট

৭) একটা পাস্পোর্ট সাইজ ফটোগ্রাফ

৮) ৫ টা সিভিল মামলা ও ৫টা ক্রিমিনাল মামলাতে অংশ নিয়েছেন আলোচ্য ব্যাক্তি, সেটার প্রমান ও লিস্ট

এই লোয়ার কোর্টে আবার দুই বছর প্র্যাক্টিস করে আসতে হবে আপার কোর্টে। সেখানকার আমাদের এই যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনালকে যেহেতু আপার কোর্টের একটি ডিভিশানের মানে হাইকোর্ট বিভাগের সম মানের বলে সূচিত করা হয়েছে, সুতরাং এই আদালতে মামলা লড়তে হলে কি কি যোগ্যতা থাকা লাগবে একজন আইনজীবির? সেখানেও রয়েছে কিছু রুল এবং প্রসিডিওর। ১৯৭২ সালের বার কাউন্সিলের ৬০ নাম্বার রুল অনুযায়ী এখানেও সাবমিট করতে হবে কিছু কাগজ পত্রঃ

যেমন-

১) আবেদন পত্র

২) ৫,৫০০ তাকার ব্যাঙ্ক ড্রাফট

৩) যেই কোর্টে প্র্যাক্টিস করেছেন প্রার্থী সেই বারের প্রেসিডেন্ট/স্ক্রেটারীর থেকে প্রত্যয়ন পত্র

৪) কমের পক্ষে ২৫ টা সিভিল ও ক্রিমিনাল মামলা প্রার্থী পরিচালনা করেছেন তার প্রমান ও লিস্ট

৫) লোয়ার কোর্টের এনরোলমেন্টের সনদ

৬) দুইটা পাস্পোর্ট সাইজ ছবি

৭) এল এল এম এর সত্যায়িত নম্বর পত্র ইত্যাদি

এইসব নিয়ম কানুন ফলো করেই বাংলাদেশের লোয়ার কোর্ট এবং আপার কোর্টে একজন ব্যাক্তিকে প্র্যাক্টিস করবার লাইসেন্স নিতে হয়। ব্যাপারটা এমন নয় যে, আমি একজন বিদেশী, আমার চামড়া সাদা, তাই স্যার স্যার করতে করতে আমাকে প্র্যাক্টিস করতে দেয়া হবে দেশের আদালতে। নিয়ম সবার জন্যই সমান ও এক।

কিন্তু দুঃখ জনক হলেও সত্য যে জামাত ও বি এন পি'র এক্টিভিস্টরা বলে বেড়াচ্ছে যে, সরকার নাকি বিদেশী আইনজীবিদের মামলা পরিচালনা করতে সুযোগ দিচ্ছেন না। কিন্তু তারা এক্টিবারও এই নিয়ম বা নীতির কথা ভুলেও মুখে আনছেন না।

এ বিষয়ে বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল বাসেত মজুমদার বলেন,

একটি বিধিবদ্ধ সংস্থা হিসেবে বার কাউন্সিলের কিছু বিধিবিধান রয়েছে। এ দেশে কারা আইনি প্র্যাকটিস করবে, কারা করবে না তা আইনে লেখা আছে। বিদেশী আইনজীবী নিয়োগের বিষয়টি বার কাউন্সিলের আইন সমর্থন করে করে না। এ অবস্থায় আমরা বিদেশী আইনজীবী নিয়োগের অনুমতি দিতে পারি না। তাই আজ কাউন্সিলের সভায় সর্বসম্মভাবে আবেদনটি নাকচ করা হয়েছে।

এই নিয়ম যে আমাদের দেশে শুধু তা না। এই নিয়ম সব দেশেই রয়েছে। যেমন –

আমরা হতে পারি একটি অর্থনৈতিক ভাবে একটি দরিদ্র দেশ কিংবা অবকাঠামোগত ভাবে একটি উন্নয়নশীল দেশ। কিন্তু তাই বলে কি আমাদের দেশে বিদ্যমান নিয়ম নীতি ভেঙ্গে কাউকে সুযোগ করে কোর্টে প্র্যাক্টিস করবার অনুমতি দিতে হবে? যদি তাই হয় তাহলে দেশে-বিদেশে যে লক্ষ লক্ষ এল এল বি পাশ করা বাংলাদেশী ভাই-বোনেরা রয়েছেন তাদেরকেও সমান সুযোগ করে দিতে হবে।

ইংল্যান্ডে ব্যারিস্টার রয়েছেন ভুরি ভুরি। দয়া করে একটু খোঁজ নিয়ে দেখুন তারা মেইন স্ট্রিমে প্র্যাক্টিস তো দূরের কথা, নিজের নামের শেষে ব্যারিস্টার পর্যন্ত ব্যাবহার করতে পারে না। আর যারা ২০০০ সালের আগে ব্যারিস্টার হয়েছেন তারা শুধু ব্যারিস্টার লিখলেও বাধ্যতা মূলক ভাবে নট প্র্যাক্টিসিং শব্দটি লিখেন। এই ইংলিশ কোর্টে প্র্যাক্টিস করতে হলেও অনেক নিয়ম কানুন মেনে তা করতে হয় যা মোটামুটি একজন বিদেশী নাগরিকের জন্য অসম্ভব ব্যাপার।

বিএনপি আর জামাত শুধুমাত্র নিজের সুবিধার জন্য দেশের বিদ্যমান আইন কানুনকে যে ধুলোয় লুটিয়ে দিতে দ্বিধা করেনা এই বিদেশী আইনজীবি নিয়োগের দাবী তার বড় একটি প্রমাণ।

আশা করি এই লেখার মাধ্যমে আমি বুঝাতে পেরেছি যে, যে কেউ চাইলেই বাংলাদেশের কোর্টে নিয়ম আর নীতি ব্যাতিরেকে প্র্যাক্টিস করবার আলাদা সুযোগ পায় না। যদি তা পেতে হয় তবে সঠিক নিয়ম কানুন মেনেই তা করতে হবে।