ক্ষমতাহীন, শক্তিহীন, বিত্তহীন এক নিরুপায় গর্দভ

-নিঝুম মজুমদার
Published : 9 March 2012, 03:44 AM
Updated : 9 March 2012, 03:44 AM

খুব বেশী দিন দূরে যেতে বলি না। ১৯৪৭ না, ১৯৫২ না, ১৯৬৯ না, ১৯৭১ না। কষ্ট করে ১৯৭২ সাল থেকে মনে করবার কথা বলি। ১৯৭২ থেকে আজ ১৭ অক্টোবর ২০১১ সাল কত বছর হয়? কত দিন হয়? কত বছর? কত মাস? কত সপ্তাহ? কত মিনিট? কত সেকেন্ড? সেই শুরু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আর তার ফাটা কপাল আর আমাদের জনতার ফাটা কপালে জোটা কম্বল চোরা মোস্তফাকে দিয়ে, শেখ মনিকে দিয়ে, মোস্তাককে দিয়ে। যুদ্ধাপরাধী, রাজাকারদের বিচারের চেষ্টা, কিন্তু বিফলে যায় সহস্র ষড়যন্ত্রে। ঠিক আজকেরই মতন।

তারপর ৭৫ এর এক রাতে নিভিয়ে দেয়া হয় সব। সামান্য আশটুকুও। গুলি-রক্ত-হত্যা এবং ফারুক-রশীদ-ডালিম দের লুটপাট, হত্যা আর অস্ত্রের রাজনীতি। এই রাত শেষ হলে হয় সায়েমের সাম্রাজ্য, কিছুদিন বাদেই খুনী জিয়ার মঞ্চ। খুনে আর রক্তে, রক্তে আর খুনে, রাজাকার আর আলবদর আর রাজনীতিকে কঠিন করণ প্রক্রিয়া। মরে যায় বীর তাহের। মরে যেতে হয় বীর তাহেরকে। খুন করে ফেলা হয় তাঁকে। সেই রক্তের স্রোত যখন আমাদের বুক ফালি ফালি করে বিবর্ণ করে দিচ্ছিলো তখন খুন হতে হয় খুনীকেই। আসে চির লম্পট এরশাদ। একজন সত্যকারের বরাহ শাবক। ধূর্ত শার্দূল। একজন সত্যকারের অমানুষ।

তার সাথে যুক্ত হয় গৃহপালিত আরেক ভাঁড় আসম আব্দুর রব। সাথে থাকে নীরু, অভি, লবন চোরা দিল মোহাম্মদ, চিনি চোরা জাফর, হায়েনার মত মওদুদ, আবুল মাল,রাজাকার সাকা, রাজাকার আনোয়ার জাহিদ, রুহুল আমিন হাওলাদার, টাকার কুমির নাজিউর রহমান মঞ্জুর। ৯ টি বছর বাঙালীর রক্ত খেয়েছে এরশাদ খুনে জোঁকের মতন, আজো খায় প্রতিটি মূহূর্তেই। তারপর নূর হোসেনের রক্ত। ৯১ এর মিসেস খালেদা ম্যাডাম, রাজাকার,খুনী আর ডাকাতের সর্দার। শুরু আরেক কালো যুগের। ফালুরা জন্মালো, আব্বাসরা জন্মালো, দুলু, নোমান, সাকারা আরো বেড়ে উঠলো। একদিন ভোর হতেই দেখি মাথায় কালো কাপড় বাঁধা আরেক অভিনেত্রীর প্রতিচ্ছবি। ২১ বছর পর তার মসনদে আগমন। অধিপতি হাসিনা। জানলাম খুনী-চোর-দূর্নীতিবাজ- হাজারীকে, হাজী সেলিমকে, মকবুল কে, শামীম ওসমানকে, কামাল মজুমদারকে, মায়াকে, হাসনাত আব্দুল্লাহকে। জানতে জানতেই আবার ম্যাডাম। সেই রাজনৈতিক গুবরে পোকা। এবার তিনি পরিচয় করালেন হাওয়া ভবন, তারেক, হারিছ, মামুন, বাবর আর সেই চির শত্রু রাজাকার আলবদর। ২ বছর আবার জলপাই। আবার অস্ত্র। আবার বিপন্ন বিষ্ময়। আর গত তিনবছরের কথা কি বলবার প্রয়োজন আছে আদৌ?

কি পেয়েছি গত ৩৯ বছরে? শিক্ষা, চিকিৎসা, রাস্তাঘাট, অবকাঠামো, বাসস্থান, খাদ্য, এমনকি সুস্থ ভাবে মরতে পারবারও অনুমোদন মিলেনি। আমাদের ঘরে আগুন নেই, ঘরে আলো নেই। অথচ গ্যাস, বিদ্যুৎ বেচে দেয়া হচ্ছে শুধু একটি পাজেরোর বিনিময়ে। লক্ষ কোটি টাকার গ্যাস পুড়িয়ে সাদা চামড়ারা চলে যায় বুড়ো আঙ্গুল উঁচিয়ে, লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের, মানুষের বুকে পাড়া দিয়ে। আদমজীর সব শ্রমিকেরা আজ কোথায়? কেন বন্ধ আদমজী? কেন বন্ধ শিল্প কারখানা? অথচ উৎপাদিত হয় কেরু, আমদানী হয় আফটার শক, জ্যাক ড্যানিয়েল। গড়ে উঠে গুলশানের শাহী মেয়েদের রাতের নৃত্যখানা, পুরুষদের নিঃশ্বাস নেবার আর হালকা হবার স্থান। আব্দুল্লাহ আল হারুন, আজাদ, সালাম মুর্শেদী, সালমান এফ রহমান, সালাউদ্দিন কাদের, গিয়াসুদ্দিন কাদের, সোহেল এফ রহমান, হাশেম, আব্দুল আউয়াল মিন্টু, রাজাকার মুসা বিন শমশের বিলিয়নিয়ার থেকে ট্রিলিয়নিয়ার হয়, অথচ রাস্তা ঘাটে কুত্তার মত মরি আমরা, আমাদের মায়েরা, আমাদের বোনেরা। হাই কোর্টের সামনে কেন থাকবে ভিক্ষুক, কেন শেয়ার মার্কেটের সামনে গরীব তরুনেরা কেরোসিন নিয়ে বসে থাকবে মরে যাবার চেষ্টায়? কেন মন্ত্রী এম্পিরা শত শত কোটি বানাবে, কেন তাদের সন্তান সন্ততিরা আরামে আমেরিকা, কানাডা, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ায় মধু চন্দ্রিমায় ব্যাস্ত থাকবে আমার, আপনার ট্যাক্সের টাকায়? কেন তারা ফিরে এসেই হবে এম্পি? মন্ত্রী কিংবা দেশের নেতা?

কেন তারেক রহমানের এত অর্থ হবে, কোন ক্ষমতায় হবে? কিভাবে হবে? কেন কোকোর এত দাপট? কেন তার এত ক্ষমতা? কোন যোগ্যতায় জয় আমেরিকায় ৬ টি বাড়ী কেনে যেখানে সেই একই বছরে একজন ছাত্র হিসেবে ৭৬ হাজার ডলার দিয়ে ভর্তি হয় হার্ভাডে? সেই বছরই কি এই জয় নিজের ব্লগেই বলেনি, যে সে চাকরী খুঁজে বেড়াচ্ছে? তাহলে ৬ টি বাড়ি, ফেরারী গাড়ি, ৭৬ হাজার ডলার খরচ করবার মত অর্থ কোথায় থেকে আসে?

শোনা যায় আজ নানক ৫০০ কোটি টাকার মালিক। কিভাবে? কিভাবে পিন্টু এম্পি হয়? এনি এম্পি হয়? কিভাবে শামীম ওসমান নির্বাচনে দাঁড়ায়, কোন সাহসে শেখ সেলিম সংসদে কথা বলে? যেই সেলিমের ইউ টিউব ভিডিও আজও বাজারে চলমান। কান পাতলেই শুনবেন কি করে, কিভাবে তারা মানুষ খুন করেছে, ধর্ষন করেছে এই বাংলাদেশকে। কোন স্পর্ধায় আজ এরশাদ বাংলাদেশের মাটিতে বেঁচে বর্তে থাকে? বক্তৃতা দেয়? সমাবেশ করে? এম্পি শাওন মানুষ হত্যা করে কিভাবে শাস্তি পায়না? ঘরে ঢুকে মেরে ফেলা হয় সাগর আর রুনিকে, আর একা পড়ে থাকে তাদের ৫ বছরের নিষ্পাপ শিশু? কিভাবে রাজাকার আলবদরেরা আমার দেশের পতাকা নিয়ে গাড়িতে চড়ে? কেন আমাদের দেশের ছেলেরা চাকুরী পায় না? কেন ভারত আমাদের একের পর এক জমি, মানুষ নিয়ে চলে যাবে? কেন তারা মেরে মেরে আমাদের সন্তানদের ঝুলিয়ে রাখবে মৃত গরুর মতন, মৃত পশুর মতন? কেন তারা ন্যাংটা করে পেটাবে আমার ভাইকে? আজ খালেদা জিয়া প্রকাশ্যে দিনের আলোতেই তার সকল লজ্জার মাথা খেয়ে লক্ষ জনতাকে নিয়ে মার্চ করতে করতে ঢাকায় আসতে চায় যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে। যে কথা এতদিন ছিলো লজ্জার, ঘৃণার, অপমানের, সেই কথাই খালেদা আজ বলেন প্রকাশ্যে, নির্দ্বিধায়। একাত্তরের পশুদের বাঁচাতে আজ সামরিক অফিসারের সেই স্ত্রী'র ঘুম নেই।

হেলাল হাফিজের একটা কবিতা পড়েছিলাম আজ থেকে পনেরো বছর আগে। একটি কবিতার কিছু লাইন ছিলো এমন-

"মিছিলের সব হাত কন্ঠ পা এক নয় । সেখানে সংসারী থাকে, সংসার বিরাগী থাকে, কেউ আসে রাজপথে সাজাতে সংসার । কেউ আসে জ্বালিয়ে বা জ্বালাতে সংসার, শাশ্বত শান্তির যারা তারাও যুদ্ধে আসে অবশ্য আসতে হয় মাঝে মধ্যে অস্তিত্বের প্রগাঢ় আহ্বানে"।

এই কবিতাটি আমার কাছে শ্বাশত মনে হয়। মনে হয় এক অব্যার্থ কথার মতন এক প্রজ্জ্বলিত সত্যের মতন। লন্ডনের এই আরাম দায়ক আবহাওয়াতে আমি ভালোই আছি। গরম কফির কাপের উত্তাপে ঠোঁট দিয়ে পায়ের উপর পা তুলে নিশ্চিন্ত জীবন যাপন করছি বলেই অনেকে বলেন। বলেন এইসব বাল ছাল লিখে রাজনৈতিক আশ্রয় চাইব আমি। সে আশাতেই লিখি। কেউ বলেন, আমি পন্ডিত, আমি নির্বাচন করতে চাই। কেউবা বলেন ভন্ড। কেউবা বলেন আমি সুযোগের অভাবে নীতির বুলি কপচাই। কাছের মানুষ বলেন, আমি নাকি খামাখাই রাজনীতিবিদের পাছায় আঙ্গুল দিয়ে নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনি।

সেসব শুনে চুপ করে থাকি মাঝে মধ্যেই। আসলেই তো, লিখে কি হয়? কে বদলায়? কে শোনে? ঘরে বসে ইচ্ছে করলেই নিত্য নতুন পর্ন দেখে হস্ত মৈথুন করা যায়, স্ত্রীকে নিয়ে হিন্দী ছবি কিংবা ইংরেজী ছবি দেখা যায়, অথবা তারেক ভাই, জয় ভাই বলে ঝুলে পড়া যায়। তাই, মাঝে মধ্যেই পিন পতন নিরবতায় নিজের দীর্ঘ;শ্বাসে চমকে উঠি। হয়ত এসব কথার উত্তর দেবার সময় আসেনি। আম্মার ২৫ লাখ টাকার ঋণ, পড়ালেখা শেষ করবার চাপ, সন্তান, স্ত্রী'র চাহিদা সবকিছু মিলিয়ে খেই হারাই মাঝে মধ্যেই। ৩১ বছরের এই জীবন খুব গ্লানির হয়ে উঠে প্রায় প্রতিদিনই।

সারাদিন নিজের শরীরের ঘাম বিক্রি করে যখন আমার জন্ম হওয়া দেশটার দিকে তাকাই, তখন ব্যাক্তিগত সেসব গ্লানি ভেদ করে দেশটা বড় বেশী হত্যা করে আমাকে। নিরীহ দেশটার গোঙানি শোনা যায় কান পাতলেই। একচল্লিশ বছরের নির্যাতন এই শুধু আমার নয়, ১৬ কোটি সাধারণ জনগণের প্রতি রক্ত কনিকাতে গভীর হয়ে ডুবে রয়েছে। মিছিলের সেই সব ভিন্ন কন্ঠের মত আমিও একজন। সোনার চাঁদ পিতলা ঘুঘু, কিংবা সোনা-জাদু-মনি বলে শত শত বিখ্যাত মানুষেরা বলে গ্যাছেন। বলে গ্যাছেন সাধারণ মানুষ আব্বা বলে, আম্মা বলে, লক্ষী সোনা বলে। হুমায়ুন আজাদ লিখে গেছেন "রাজনীতিবিদগণ" কিংবা "আমরা কি এমন বাঙলাদেশ চেয়েছিলাম", তিনি উলঙ্গ করে দিয়েছেন রাজনীতিবিদদের সে বুই দু'টিতে। তারপরেও রাজনীতিবিদেরা শোনে নি। তারা শুধু ধরে ধরে আমাদের ধর্ষন করেছে। প্রত্যেকটি জনতাকে। প্রত্যেক হৃদয়কে তারা হত্যা করেছে প্রকাশ্যে, দিনের আলোতে।

ক্ষমতাহীন, শক্তিহীন ও নিরুপায় এই গর্দভ আমি সুযোগ পেয়েই নিজেকে উজাড় করে দেই। ওদের বরাহ শাবক বলি, বলি সারমেয় শাবক।

এই শব্দ চয়ন আমার নয়। এই শব্দ আমার ছিলোও না কখনো। আজ সেসব শব্দ আমার হয়েছে, আমাদের সকলের হয়েছে। এই উচ্চারণ আমার গ্লানির, আমার কষ্টের, আমার দুঃখের।