হাত খরচ দিন, পদত্যাগ করব না

নীলকন্ঠ
Published : 14 July 2012, 01:44 AM
Updated : 14 July 2012, 01:44 AM

এলাকার সজ্জন মানুষ হিসেবে ভালই পরিচিতি ছিল। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতাম ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে।অতএব, জনপ্রিয়তা যে আমার আছে তা উপলব্দি করতাম।জনসেবার জন্যই শেষে নির্বাচনে নামলাম। বিপুল ভোটে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হলাম।

০১। শ্বশুর বাড়ীর নতুন জামাইয়ের মতই নির্বাচনী এলাকায় প্রথম প্রথম আমার কদর ছিল।সুযোগ পেলে যখনই এলাকায় যেতাম, মানুষ স্বতঃস্ফুর্তভাবে আমাকে ঘিরে ধরত।ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করত। অভিযোগ অনুযোগ যা করতো তা সমাধানের চেষ্টা করতাম।সৎ এবং সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে যে দেশসেবা করা যায় তার একটা উদাহরন সৃষ্টি করব বলে দিন গুনতাম।

০২। অভিযোগের খাতা দিন দিন যেন বেশ দ্রুত ভারী হয়ে চলল। এলাকায় একটা শ্রেনী তৈরী হতে লাগলো যারা রাজনৈতিক দলের কর্মী পরিচয়ে প্রভাব এবং অর্থ আদায়ের পথে নামল। বেশ কতগুলোকে পুলিশে ধরিয়ে দিলাম।এবার বুঝুক মজা।

০৩।নির্বাচনী এলাকার বেশ কয়েকজন চেয়ারম্যান একদিন দেখা করলো।তারা আমার শুভাকাংখী হিসেবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করলো।আর যে জিনিসটা তারা আমাকে বুঝাতে সক্ষম হলো তা হলো আমি যে হারে দলের নেতা কর্মীদেরকে পুলিশের হাতে তুলে দিচ্ছি তা ঠিক হচ্ছে না। এলাকার মানুষ আমাকে দেখে যে কয়টা ভোট দিয়েছে তার চেয়ে বেশী দিয়েছে নির্বাচনী প্রতীক দেখে। অতএব আমার অধিকার নেই এই হারে দলের কর্মীদেরকে নাজেহাল করার। আমি বুঝলাম না এটা আমার প্রতি হুমকী কিনা।

০৪। এরপর দেখা গেল বেশ মারাত্নক ঘটনায় ও সন্ত্রাসীদেরকে ধরার জন্য পুলিশকে অনুরোধ করলে তারা কেন যেন অনীহা দেখায়। আমার অনুরোধ রাখতে গিয়ে তারা নাকি দুই কর্নে উত্তম মধ্যম শব্দশ্রুত হয় আর যাদেরকে গ্রেফতার করলো তারা বুক ফুলিয়ে ওদের সামনে দিয়েই বের হয়ে আসে।কেন্দ্র বুঝে গেছে এলাকার ভোট আমার উপর নির্ভর করেনা। নির্ভর করে এদের উপর।

০৫। কেন্দ্রের নির্দেশ, নেতা আসবে। লোক সমাগম চাই।এলাকার কেউ আমাকে তেমন পাত্তা দিলনা।শেষে দেখলাম, আমার প্রতিদ্বন্ধি ব্যক্তির বড় বড় ছবি সহ আমার নির্বাচনী এলাকার হাজার হাজার সমর্থক হাজির। আমার নামে কেউ একটু মিছিল করলনা। সবই প্রতিদ্বন্ধির নামে।

০৬।এলাকার কোন বিচার আচারে আমার রায় এখন কেন জানি কেউ মানেনা। বরং চেয়ারম্যানের রায়ই সর্বেসর্বা। এলাকার উন্নয়ন কাজতো সরকার করছে।

এতদিনে বুঝলাম। প্রভাবশালী সিংহমার্কা জনপ্রতিনিধি হয়ে এলাকা শাষন বা সেবা করতে হলে এলাকায় একটা চোর, ছিনতাইকারী, চাঁদাবাজ আর জুলুমবাজের একটা দলকে অলিখিত সুযোগ দিতে হবে যাতে তারা ইচ্ছেমতো সবকিছু করতে পারে। এদেরকে সবসময় বুকে আগলে রাখতে হবে, পুলিশ, বিচার ব্যবস্থা যাতে এদেরকে নাগালে না পায় তার ব্যবস্থা করতে হবে। তবেইতো এরা আমার ইশারাকে এলাকায় বাস্তবে রূপ দিয়ে ছাড়বে। এরা আমার আগমনে শুভেচ্ছা স্বাগতম বলতে বলতে কন্ঠ চৌচির করে ফেলবে।

বুঝলাম আমার রাজনৈতিক গুরু চিনতে ভুল হয়েছে। কেন আমি ক্লাস কমিটি, ষ্টিয়ারিং কমিটির আদলে এলাকায় কমিটি তৈরী করে দিয়ে সাধারন মানুষকে শোষনের ব্যবস্থা করে দিই নাই। আমার সামনে তো উদাহরণ কম ছিলনা। জায়গায় জায়গায় নতুন নতুন নামের সাইনবোর্ড লাগানো আস্তানার মাহীমা কেন আমি আগে উপলব্দি করিনি। কেন অভিযান শুরু হয় অথচ ফুটপাত দখলমুক্ত হয়না। কেন প্রতি বছর নদীগুলো স্লিম হচ্ছে, বনভুমিগুলো দিন দিন উজাড় হচ্ছে। কেন আমি নিবেদিতপ্রান(?) কর্মীগুলোর নিবেদিত কাজে কেবল বাধা দিতে যাই। কেন আমি ভুলে গেলাম যে নিবেদিত জনসেবার (?) আশাতেইতো এরা জানবাজী রেখে সংখ্যালঘুদের ঘরে আগুন দেয়, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে সাপের মতো পিটিয়ে পটল তোলায়।

বুঝতে পেরেছি। এই গ্রুপটার আয় এবং প্রভাব খাটানোর ব্যবস্থা করে দিতে হবে। এরা যে নিবেদিতপ্রান(?) নেতাকর্মী! আমার নির্বাচনী এলাকায় ৩০ টা ইউনিয়ন আছে। প্রতি ইউনিয়ন আমি ১০ জন করে নিবেদিতপ্রান(?) নিয়ে একটা বাহিনী বানাব। এদেরকে আমি নিজে বেতন দেব যাতে তারা এলাকায় মাস্তানী না করে। অন্য মান্তানদেরকে যাতে শায়েস্তা করে। চুরি, ছিনতাই বা মাদক ব্যবসা যাতে বন্ধ হয়ে যায়। জনগন যাতে শান্তিতে থাকে। আমি এলাকায় গেলে যাতে শুভেচ্ছা স্বাগতম বলে। দলীয় মিটিং মিছিলে যাতে লোকের অভাব না হয়। জনগনের জন্য সরকারী বরাদ্দ থেকে যাতে এরা ভাগ না চায়।

প্রত্যেকের বেতন ১০ হাজার করে ধরে মাসিক বেতন দাঁড়ায় তিরিশ লক্ষ টাকা।মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রী, আপনারা সংসদে একটা আইন পাশ করে আমার জন্য তিরিশ লক্ষ টাকা মাসিক হাতখরচ দেয়ার ব্যবস্থা করুন।
অথবা
ক) অপরাধীদের দলীয় পরিচয়ের কারনে কোন প্রকার ছাড় দিবেন না এই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন করুন।
খ) পুলিশ যেন দল না খুঁজে অপরাধ খোঁজ করে। রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা প্রত্যাহার বন্ধ করুন।
গ) কে এলাকা বেশী দখলে রাখতে পারবে তা দেখে নমিনেশন দেয়া বন্ধ করুন।

আমি কাউকে অন্যায় করার লাইসেন্স দিতে পারব না। অতএব হাতখরচ না পেলে এই নিবেদিতপ্রাণ বাহিনীর বেতন দিব কীভাবে? এরা যদি নিবেদিত কাজ আবার শুরু করে তবে পদত্যাগ না করে উপায় কী আমার?