তাহারেই পড়ে মনে

মোঃ তানভীর সাজেদিন নির্ঝর
Published : 11 Sept 2016, 08:15 PM
Updated : 11 Sept 2016, 08:15 PM

চাকুরী থেকে সদ্য অব্যহতি প্রাপ্ত বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর জননন্দিত জাঁদরেল অফিসার ছিলেন জনাব বাবুল আক্তার। ২৪তম বিসিএসে উত্তীর্ণ এ কর্মকর্তা পেশাগত জীবন শুরু করেছিলেন ২০০৫ সালে। পুলিশ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে র‍্যাব-২ থেকে শুরু করেছিলেন চাকুরীজীবন। চাকুরীজীবন সংক্রান্ত ও এর পরের অধ্যায় গুলো সম্পর্কে কমবেশি সকলেরই জানা। সততা,নিষ্ঠা,দ্বায়িত্বের প্রতি আন্তরিকতা ও শ্রদ্ধা এবং অসীম সাহসিকতাপূর্ণ ধারাবাহিক কর্মের দরুন অল্প সময়েই নিজ বাহিনী ও শান্তিপ্রিয় সাধারণ জনগণের দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু তে উঠে আসেন তিনি। চাকুরীজীবনে যেসব অঞ্চলে দ্বায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়েছিলেন, সেসব অঞ্চলের সাধারণ মানুষের জন্য নিজের সবটুকু উজাড় করেই রাষ্ট্র কর্তৃক অর্পিত দ্বায়িত্ব-কর্তব্য নিষ্ঠার সাথেই পালন করে গেছেন আর অন্যদিকে অপরাধীদের জন্য আবির্ভূত হয়েছিলেন যমদূতের বেশে। চাকুরীজীবনের অধিকাংশ সময়েই চট্টগ্রাম অঞ্চলে কেটেছে। সে সুবাদে চট্টগ্রাম অঞ্চলে ঘটে যাওয়া বহু চাঞ্চল্যকর অপরাধের সফল তদন্ততদারক হিসেবে কখনো ব্যর্থ তো হন নি বরং পেশাদার অপরাধীদের মুখোশ উন্মোচিত করে শেকড় পর্যন্ত উপড়ে ফেলেছিলেন কিছু কিছু ক্ষেত্রে।

ব্যক্তিজীবনে সাদামাটা এই যোদ্ধা বরাবরই সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। অসহায় আর নির্যাতিতদের এক অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন বাবুল আক্তার। তার দুয়ারে সাহায্যের আশায় গিয়ে খালি হাতে নিরাশ হয়ে ফিরেছেন এমন মানুষ হয়তো একজনও পাওয়া যাবে না। সামর্থ্যানুযায়ী যা পেরেছেন তাই করার চেষ্টা করেছেন। জানা যায় জীবনে হতে চেয়েছিলেন শিক্ষক কিন্তু বিধাতা যে নির্ধারণ করে রেখেছিলেন তিনি এমনই এক আদর্শনিষ্ঠ কেউ হবেন যার গুণগান ছড়িয়ে যাবে পুরো ভূখণ্ড জুড়ে। যেথায় যাবেন সেথায়ই আদর্শের এমন বীজ বপন করবেন যা বৃক্ষে পরিণত হয়ে একদিন তার অনুজদের অনুপ্রেরণাদায়ক ছায়ায় পরিণত হবে।

কর্মক্ষেত্রে নিজ কৌশল, দক্ষতা এবং অসীম সাহসিকতার সমন্বয়ে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী গোষ্ঠী কে মোকাবেলা করতে গিয়ে জীবনের ঝুঁকিও নিতে হয়েছে বহুবার কিন্তু ইস্পাতকঠিন মনোবল আর দেশপ্রেমের মায়াজালে ওসব উপেক্ষা করেই এগিয়ে গেছেন অপরাধীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে। জঙ্গি সমস্যা যখন এদেশে মাথাচাড়া দিতে শুরু করেছিলো তখনও সেইসব উগ্রপন্থী জঙ্গিবাদ গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে টানা লড়াই চালিয়ে গেছেন মৃত্যুভয় কে উপেক্ষা করে। কোন কোন অভিযানে সহকর্মী দের পাশে ঠেলে দিয়ে একাই মোকাবিলা করেছেন সম্মুখভাগে থেকে। এরই মাঝে বিশ্বশান্তি রক্ষায় এক বছর শান্তিরক্ষী হিসেবে জাতিসংঘ মিশনেও সফলতার সহিত দ্বায়িত্ব পালন শেষে ফিরে আসেন মাতৃভূমি তে। তবে অপরাধ দমনে অন্যতম ও আলোচিত ছিলেন বিধায় তৎকালীন চট্টগ্রামের পুলিশ কমিশনার হেড অফিসে চাহিদাপত্র দিয়ে পুনরায় তাকে ফিরিয়ে নেন সেই চিরচেনা চট্টগ্রামে। ফিরে সেই একই ধারায় একের পর এক দুর্ধর্ষ সব সন্ত্রাসী ও অবৈধ অস্ত্রধারী দের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠার লড়াই চালিয়ে যেতে থাকেন এবং সাফল্যতায় পরিপূর্ণ করতে থাকেন অর্জনের ঝুলি।

রাষ্ট্রের প্রতি যিনি এতো করেছেন তাঁকে এবং তাঁর কৃতকর্ম কে মূল্যায়নে রাষ্ট্রও কোন অংশে কার্পণ্য করেনি। সফলতার স্বীকৃতি হিসেবে লাভ করেন পিপিএম (সেবা), পিপিএম (সাহসিকতা), আইজিপি ব্যাজ এবং বাংলাদেশ পুলিশের সর্বোচ্চ মর্যাদাশালী পুরষ্কার বাংলাদেশ পুলিশ মেডেল বিপিএম (সাহসিকতা)। আর মধ্যেই চারবার অর্জন করেন রেঞ্জের সেরা সহকারী পুলিশ সুপার পদক। এছাড়া বেসরকারি পর্যায়েও সাহসিকতার স্বীকৃতিসরূপ অর্জন করেন আরেকটি মেডেল। সর্বশেষ পদোন্নতি পেয়ে পুলিশ সুপার হয়ে বদলি হয়েছিলেন হেড কোয়ার্টারে।

কিন্তু বিধির কি নির্মম লীলাখেলা! ঢাকায় যোগদানের পরদিনই শুনতে পান প্রিয় সহধর্মিণী অপরাধী দের আঘাতে তাকে ছেড়ে চলে যান না ফেরার দেশে দুটি শিশু সন্তান রেখে। যার জীবন সফলতা আর মানুষের ভালোবাসায় পরিপূর্ণ সেই তিনিই আচমকা হয়ে গেলেন শূন্য। একদিকে দুটি অবুঝ সন্তান বুকে অন্যদিকে সে বুকটিই যে পৃথিবী সমতুল্য ব্যথার বোঝায় ভারাক্রান্ত সেই ইস্পাতকঠিন মন তা প্রকাশের কোন ভাষা বা মাধ্যম ভাগ্যবিধাতা তাঁকে দেন নি। আর তাই তিনি আমাদের মাঝে থেকেও নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন সব কিছু থেকে। অর্ধাঙ্গিনী হারানোর শোকে দৃঢ় মনের বাবুল আক্তার কিভাবে মাতম করেছেন তা দেশের কোটি কোটি মানুষ দেখেছে ও মনের অজান্তে তারাও যে অশ্রুসিক্ত হয়েছে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

এমন একটি আকস্মিক ঝড় এমনভাবে লণ্ডভণ্ড করে দিলো সুখের ঘড়। সন্তান দুটি বুকে জড়িয়ে কিভাবে এ ধকল সয়ে চলেছেন বাবুল ভাই তা সৃস্টিকর্তাই জানেন।  এতকিছুর মধ্যেও মিডিয়া নামক কিছু মনুষ্যত্বহীন বিবেক বর্জিত প্রতিষ্ঠান তাকে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ অনেক সংবাদ প্রকাশ করে আবার নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয়ার মতো জঘন্য কাজটিও বেশ দক্ষতার সাথেই করেছে! জানি না এতে তাদের কি লাভ হয়েছে তবে এতটুকুই জানি এই মিডিয়া নামধারী অমানুষ কর্তৃক পরিচালিত মাধ্যমগুলো সবহারা মানুষের বেঁচে থাকার সর্বশেষ স্থানটুকু কেড়ে নিতে দ্বিতীয়বার ভাবার চেষ্টাও করে না।

এর পরের অধ্যায় আরো বেদনাদায়ক ও স্পর্শকাতর রাষ্ট্রীয় ব্যাপার, যা নিয়ে আমার মতো অতি নগণ্য মাখলুকের কথা বলা একদম মানায় না। কিছুদিন আগে প্রজ্ঞাপন জারি হলো বাবুল আক্তার কে চাকুরী থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এটা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত, তাই এ বিষয়ে ইতিবাচক/নেতিবাচক অযাচিত মন্তব্য করা মোটেই সমীচীন নয়। হতে পারে এর মধ্যে বাবুল ভাইয়ের কল্যাণ নিহিত। রাষ্ট্র তার অনুগত কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিষয়ে যে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার সম্পন্ন। তবে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বাবুল ভাইয়ের বিষয়ে জনগণের ভালোবাসাযুক্ত আবেগ তীব্রভাবে জড়িত। সাধারণ জনগণ প্রচণ্ড আবেগপ্রবণ ও উৎসুক তাই সরকারের উচিৎ এ সিদ্ধান্তের স্বপক্ষে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করা। যেহেতু এখন পর্যন্ত বাবুল আক্তারের বিরুদ্ধে কোন সুস্পষ্ট অভিযোগ প্রতীয়মান নয় যাতে তিনি ভবিষ্যতে দোষী সাব্যস্ত হতে পারেন এবং যতদূর জানি তিনি যেহেতু স্বেচ্ছায় অব্যাহতি প্রার্থনা করেন নি, সেহেতু বিষয়টি নিরপেক্ষ দৃষ্টি তে দেখলে প্রশ্নবিদ্ধ এক বিষয়। আর একটি প্রশ্ন থেকে হাজারটা মনগড়া উত্তর সৃষ্টির দেশ এই বাংলাদেশ। বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী একটি সুশৃঙ্খল শক্তিশালী আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী ও প্রয়োগকারী বাহিনী। এ বাহিনী তে বাবুল ভাইয়ের মতো অনেক অফিসার বর্তমানে কর্মরত আছেন, হয়তো অদূর ভবিষ্যতে এর চেয়েও তেজোদৃপ্ত অফিসারগণ আসবেন এবং আরো শক্তিশালী ভূমিকা রাখবেন দেশের তরে কিন্তু সব কিছু বুঝেশুঝেও তাহারেই(বাবুল আক্তার) পড়ে মনে। তার শূন্যতা আমাদের ব্যথিত করে। তার ব্যক্তি কষ্ট আমাদেরকেও কষ্ট দেয় প্রতিনিয়ত। 'মা' হারানো সন্তান দুটির নিষ্পাপ চাউনি হৃদয়ে কষ্টের ঢেউ হয়ে আছড়ে পড়ে মায়ার তটে।।