যতই জানিবে ততই বাড়িবে যাতনা

বিমূর্ত কবির
Published : 5 April 2015, 07:16 PM
Updated : 5 April 2015, 07:16 PM

আজ সকালে আমার হঠাৎ করিয়াই এই বোধোদয় হইল যে , তুমি যতই জানিবে, শিখিবে এবং জ্ঞানী হইবে ততই তোমার যাতনা এবং বিড়ম্বনা বাড়িবে । যে মানুষ তেমন কিছুই জানেনা বা শিখে নাই তাহার জন্য পাপ-পুণ্য , উচিৎ-অনুচিত , নীতি-নৈতিকতা এবং পরোক্ষে উপকারী কিংবা অপকারী হইবার ভাবনা কাজ করে যৎসামান্যই । ভাল-খারাপের বিবেচনা বোধকরি প্রকৃতিগত ভাবেই তবুও তাহার মধ্যে বিরাজ করে । সেই কারণেই বুঝিবা মহান ঈশ্বর প্রথম মানব-মানবী আদম এবং হাওয়া-কে গন্দম ( জ্ঞান বৃক্ষের ফল ) খাইতে নিষেধ করিয়াছিলেন । কারণ যখনই গন্দম খাইয়া ফেলিলেন তখনই তাহাদের মধ্যে লাজ-লজ্জা , অপরাধ বোধ, উচিৎ-অনুচিত সমস্ত কিছু আসিয়া ভর করিল । কাজেই জ্ঞানী হইতে যাইয়াই যত বিপত্তি বাধাইলেন আমাদের আদি পিতা-মাতা । তাহা না হইলে থাকিতাম তো ভালই । ন্যাংটো হইয়া স্বর্গোদ্যানে হাঁটিয়া বেড়াইতাম , খুধা লাগিলে সুস্বাদু ফল-মূল খাইতাম । পিপাসায় পাইতাম বেহেস্তি নহর । একাকীত্বে কাতর হইলে বেদনা বিহীন সঙ্গী পাইতাম । কামে কোন অপরাধ বোধ থাকিত না । প্রেমের বিনিময়ে কেবল অপার প্রেমই পাওয়া যাইত । আহ: কেবল সুখ-ই সুখ । শুধুমাত্র জ্ঞানী হইতে যাইয়াই সমস্ত কিছু হারাইতে হইল এই মানবের ।

মানুষ যতই জানিল ততই নানামুখী সমস্যায় পতিত হইল । সেই সকল সমস্যা হইতে পরিত্রাণ পাইবার জন্য তাহাকে আরও বেশি জানিতে হইতেছে প্রতিনিয়ত । মানুষ জানিতে যাইয়া দেখিল যে , জীবনের স্বাভাবিক বিষয় গুলিও আসলে স্বাভাবিক নহে । কেন স্বাভাবিক নহে তাহা উদ্ধার করিতে যাইয়া তাহাকে আরও গভীর জ্ঞানী হইতে হইল । আর এইসবের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসাবে সুখ, সম্ভোগ , কাম , প্রেম আরাম সব কিছুই হারাম হইয়া গেল । জানিবার যেন কোন অন্ত নাই । যতই জানিতেছি শিখিতেছি ততই যেন আরও কিছু বাকি রহিল । আর শুধু মাত্র জানিলে বা শিখিলেই-তো হইবে না , সেই শিক্ষার প্রমাণ হিসাবে নামের পাশে বিভিন্ন ধরনের ডিগ্রি-উপাধিও ধারণ করিতে হইবে । আর সেই নিমিত্তে পুরুষ মহিলা সবাইকেই আজকাল দেশে বিদেশে ছুটা ছুটি করিতে হইতেছে । আর পিছনে পরিয়া থাকিতেছে আপন জন , পিতা-মাতা এমনকি সদ্য বিবাহিত স্বামী কিংবা স্ত্রী । এমনকি কখনো নিজের সন্তান পর্যন্ত দূরে রাখিতে হইতেছে । মিলনের সুখের চাইতে একাকীত্বের বেদনাই বাড়িতেছে কেবল । আমার বসবাস একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের এলাকায় হওয়ার কারণে প্রায়শই দেখিতে পাই পি-এইচ,ডি করিবার নিমিত্তে অনেকে এখানে আসিয়াছে সাথে তাহাদের নতুন বিবাহিতা স্ত্রী সহ । কিন্তু জ্ঞানী হইতে এবং গবেষণা করিতে যাইয়া দিনের অধিকাংশ সময় সে কাটাইতেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের 'ল্যাব' নামক একটি কুঠরিতে। এইদিকে তাহার স্ত্রী বেচারি গুটি শুটি মারিয়া গৃহকোণে স্বামীর অপেক্ষায় প্রহর গুনিতেছে । আহারে বেচারি , স্বামীর জ্ঞানী হইবার বাসনা উহার সমস্ত সুখ কারিয়া লইয়াছে । সম্ভবত ভবিষ্যতের দীর্ঘ সুখের আশায় আজকের সুখ বিসর্জন দিতেছে এই আশায় যে স্বামী জ্ঞানী হইলে সেই জ্ঞান কিনিয়া লইবার জন্য তখন অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান চাকুরীর প্রস্তাব করিবে আর তাহাতে তাহার সুখের দিন ফিরিয়া আসিবে । কিন্তু ভগ্নী আমার কি জানে যে এতদিন তাহার স্বামী যাহা শিখিয়াছে সেই জ্ঞানের প্রয়োগ দেখাইতে যাইয়া দিনের অধিকাংশ সময় আবারও গৃহের বাহিরেই থাকিবে ! হাসান নামের আমার অনুজ-প্রতিম এবং স্নেহভাজন এক ছেলে এই ভার্জিনিয়ায় পি-এইচ,ডি করিতেছে । এইবার শীতের ছুটিতে দেশে বেড়াইতে যাইয়া ফিরিবার আগের সন্ধ্যায় বিবাহ কার্জ সমাধা করিয়া ফেলিল । এবং যথারীতি পরের দিন-ই তাহাকে ফিরিয়া আসিতে হইল । আজ সকালে ফেইসবুকে তাহার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীর স্ট্যাটাস দেখিয়া হৃদয় ডুকরিয়া কাঁদিয়া উঠিল । আহারে , আগামী এক বছরে এই স্বামী নামক লোকটির সাথে দেখা হইবার কোন সম্ভাবনা নাই সেই ভাবনায় এখনি সে বিরহে কাতর । যেই লোকটাকে সে চিনিবার মত সময়ও পাইলোনা এখনো, সেই মানুষটার জন্য-ই এখন সে বিরহে কাতর থাকিবে । আজকাল যদিওবা স্কাইপে দেখিবার সুযোগ রহিয়াছে কিন্তু তাহাতেও কি যাতনা কম ! চাইলেই তো একবার তাহার হাতটি স্পর্শ করিতে পারিবে না , তাহার বুকে মাথা রাখিয়া একটু আবেগে কাঁদিতে পারিবে না । এ যেন, হাতের কাছে নড়ে চড়ে তবু ধরা যায়না ।

আর এই সব কিছুর জন্যই দায়ী মানুষের জ্ঞানী হইবার বাসনা । মানুষের আরও বেশি বেশি জানিবার ইচ্ছা ( নাকি ইহা ঈশ্বরের অবাধ্য হইবার কারনে প্রাপ্য শাস্তি!)। সেই কারনেই এখন ভাবিতেছি ,তাহার চাইতে সেই প্রাচীন কাল কি ভাল ছিলনা? সব কিছুর ভার ঈশ্বরের উপর ছাড়িয়া দিয়া নিজে নিশ্চিন্তে সময় পার করিয়া দিতাম । আমি ঈশ্বরের কাছাকাছি জ্ঞানী কোন কালেও হইতে পারিব না । সেই সাধ্য ঈশ্বর আমাদেরকে দান করেন নাই । কাজেই আমার জন্য যাহা কিছু মঙ্গল তাহা ঈশ্বরই নির্ধারণ করিবেন এবং সেইমত তিনি-ই ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন এই বিশ্বাস ও ধারনা লইয়া বেহেসতের বনে বাদাড়ে ঘুরিয়া , প্রিয় মানুষের সংস্পর্শে সুখে-সম্ভোগে দিন যাপন করিতাম ।