আমার সব চাওয়া বিধাতার কাছে

নিতাই বাবু
Published : 20 April 2016, 06:52 AM
Updated : 20 April 2016, 06:52 AM

আমি তখন সিরাজগঞ্জ বেলকুচি চাকরি করি৷ সেটা ২০০৭ ইংরাজী সালের কথা, জায়গার নাম বেলকুচি৷ এখানে টেক্সটাইল মিলের অভাব নাই, যত্রতত্র টেক্সটাইল মিল৷ জাপানী তাঁত ও চায়না তাঁতের সমারোহ৷ সেই তাঁতে তৈরী হতো আমাদের দেশীয় লুঙ্গী, জামদানী, বেনারসী চাদর, ওড়না, নাইলন, সিল্কসহ আরো হরেক রকমের বস্ত্র৷ তার মধ্যে বেনারসী ও লুঙ্গী নজরকাড়া, মেয়েদের সেলোয়ার কামিজের কাপড় চোপড়ও তৈরী হতো বহু মিলে৷ আমি যার মাধ্যমে বেলকুছি যাই, সে হলো আমারই চাকরি জীবনের শেষ শারগেদ (শিষ্য) টিপু সুলতান৷

টিপুর বাড়ি কুষ্টিয়া জেলায়৷ সে নারায়ণগঞ্জে হতে সিরাজগঞ্জ বেলকুছি যেয়ে, সেখাকার সবকটা মিল কন্ট্রাক্ট নিয়ে কাজ করতো৷ আমরা যে কাজটা করতাম সে কাজের প্রচুর চাহিদা ছিল সেখানে, আর কাজও করতাম মনের মত করে, পরিবারবর্গ নারায়ণগঞ্জ৷ ১৫ দিনপর একবার নারায়ণগঞ্জ যেতাম৷ দু'দিন নারায়ণগঞ্জ থেকে আবার জীবিকার সন্ধানে চলে আসতাম বেলকুচি৷ বেলকুচি থাকা অবস্থায় নারায়ণগঞ্জ থেকে আমার ফোন নম্বরে একটা ফোনকল পাই, ফোন করছে আমার স্ত্রী মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে৷ শুধু বললো তাড়াতাড়ি নারায়ণগঞ্জ আসো, মেয়ের বিয়ের কথাবার্তা বলতে হবে৷ আমি তখন চিন্তায় পড়ে গেলাম, ভাবলাম মেয়ের বিয়ের কথাবার্তা! কিন্তু কীভাবে হবে, মেয়ে বিয়ে দিতে চাইলেতো হবে না, টাকা পাবো কোথায়? চাকরি করে যে কটা টাকা বেতন পাই তা দিয়েতো সংসারই চলেনা, মেয়ে বিয়ে দিবো কী করে? আমার সৃষ্টিকর্তাকে ডাকতে লাগলাম, দয়াল তুমি আমায় কৃপা করো৷ তুমি ছাড়া দয়াল আমার কেহ নাই, তোমার দয়া ছাড়া মেয়ে আমি বিয়ে দিতে পারবোনা, ঠিক এভাবেই ডাকতে লাগলাম৷

সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করে বেলকুচি হতে নারায়ণগঞ্জ এলাম, তবে এতটুকু বিশ্বাস আছে যে, ভগবান কারো আশা নিরাশ করেনা৷ নারায়ণগঞ্জ আসার দুদিন পর ছেলে পক্ষ আমার বাসায় আসলো, মেয়ে দেখলো, পছন্দ হলো, আমার মেয়েকে সোনার আংটিও মেয়ের হাতের আঙ্গুলে পড়ায়ে দিয়ে গেল৷ ছেলে পক্ষের কোন দাবিদাওয়া নাই, আমারা যেভাবে পারি সেভাবেই তারা মেনে নিবে৷ ভাবতে লাগলাম কিছু না দেই, বিয়ের কাজটাতো শেষ করতে হবে! যাইহোক, সৃষ্টিকর্তা ভগবানকে ডাকতে লাগলাম, হে ভগবান আমি জানিনা কীভাবে আমি আমার মেয়ের বিয়ে দিব, তুমি আমার সহায় হও দয়াল৷ তুমি ছাড়া আমার আর কেহ নাই দয়াল৷ তখন আমার সৃষ্টিকর্তার নাম স্মরণ করে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের জানালাম, তারা সকলে'ই সাহায্য সহযোগিতা করবে বলে আশা দিলো৷ তারপর চেষ্টা করলাম যেসব মিলে কাজ করেছি সেসব মিলের মালিকদের স্মরণ করলাম, তারাও আশা দিলো বিয়ের চারদিন আগে যাকিছু দেওয়ার দিবে৷ আমার একপ্রকার চিন্তা দূর হলো, বিয়ের কদিন আগেই আমার ভগ্নীপতি দিলো আমার মেয়ের হাতের চুড়ি, আমার ভাগ্নী জামাই দিলো গলার সোনার হার, ঘরে ছিল আটআনা সোনার কানের দুল, মিল থেকে পেলাম নগদ ২০০০০/=টাকা৷

বিয়ের বাকী মাত্র চারদিন৷ তখন সময়টা ছিল ১৪ই আষাঢ় ১৪১৪ বঙ্গাব্দ, ২৮ জুন ২০০৭ ইংরাজী সাল৷ মেয়ের বিয়ের চারদিন আগে থেকে শুরু হলো বৃষ্টি, সেই বৃষ্টি আর থামছেনা৷ তখন থাকতাম চিত্তরঞ্জন মিলের কোয়র্টারে, জায়গাটা ছিল একটু নিচু, বৃষ্টিপাতের কারণে ঘরের ভিতরে হাঁটুপানি জমে যায়৷ সৃষ্টিকর্তাকে ডাকতে লাগলাম, দয়াল তুমি রক্ষা কর৷ দুদিন অনবরত বৃষ্টিপাত৷ বিয়ের দুদিন আগে বৃষ্টি থামলো, ঘরের পানিও সরতে লাগল, বিয়ের দুদিন আগে আমাদের চিত্তরঞ্জন আটপাড়ার স্টাফ কোয়ার্টার এলাকার পানি পরিষ্কার৷ বিয়েতে বাদ্য লাগবে বাদ্য ছাড়া বিয়ে শুদ্ধ হবেনা৷ আমি আমার স্ত্রীকে বুঝালাম যে, বাদ্য ছাড়া বিয়ে হলে কোন অসুবিধা হবেনা৷ আমার স্ত্রী কিছুতেই মানলো না, তার মেয়ের বিয়েতে বাদ্য লাগবেই লাগবে, এখন বাদ্যকর পাবো কোথায়? দয়াল তুমি রক্ষা করো৷ এমন সময় একজন পরিচিত লোক এসে বললো নিতাই দা, আপনার মেয়ের বিয়েতে বাদ্য লাগবেনা? যদি লাগে তবে আমার পরিচিত এক বাদ্যদল আছে, তাদেরকে নিয়ে নেন৷ মনে মনে সৃষ্টিকর্তা দয়ালকে স্মরণ করলাম, আমি লোকটাকে তাদের ডেকে আনার জন্য বললাম, সাথে সাথেই মোবাইল দ্বারা বাদ্যকরের সাথে যোগাযোগ করা হলো, দুদিন দুরাত বাদ্য বাজাবে, তাদের দিতে হবে ২৫শ টাকা৷ বিধাতার কৃপাদৃষ্টিতে বাদ্যও পেয়ে গেলাম হাতের কাছে'ই, বিয়ের আগের দিন "অধিবাস" বিকাল হতে বাদ্যকররা বাদ্য বাজানো আরম্ভ করবে বলে তাদের সাথে কথা পাকাপাকি৷

সেসময় বিদ্যুৎবিভ্রাট ছিলো প্রচুর আমদের সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায়, যায় আর অাসে,আমার ছেলের বন্ধুরা ভিডিও ক্যামেরার ব্যবস্থা করছে ভিডিও করার জন্য, ছেলের বন্ধুরা বললো জেনারেটর আনতে, জেনারেটরতো আনলেই হবেনা? বিদ্যুৎ যদি না থাকে তবে জেনারেটর দিয়ে কী হবে, জেনারেটর কতক্ষণ চববে? আর এত টাকা পাবো কোথায়? নানারকম প্রশ্ন করতে লাগলাম নিজের মনের কাছে৷ তারপর আমি আমার বিধাতার কাছে প্রার্থনা করলাম, দয়াল, হে প্রাণনাথ অন্তরজামী তুমি রক্ষা কর দয়াল৷ পরদিন রাত ১২টায় বিবাহের লগ্ন, আমি সকালবেলা ঘুমথেকে উঠে চলে গেলাম আমার জন্মদাতা পিতার শ্মশানে, সেই ১নং ঢাকেশ্বরী কটন মিলের শ্মশান ঘাঁটে, যেখানে আমার বাবাকে দাহ করা হয়েছিল৷ বাবার শ্মশানে মোমবাতি আগরবাতি জ্বালাইয়া দিয়া বাবার আশীর্বাদ চাইলাম৷ যেন কন্যাদান সম্পাদন সুন্দর ভাবে করতে পারি৷ পরে বাসায় ফিরলাম, বাসায় আসার পর আমার বড়দাদা বললো বিয়ের কার্য সম্পাদনের জন্য যে দূতরাগোটা লাগে সেটা পাই নাই, বহু জাগায় গেছি মিললো না৷ আমি দাদাকে বললাম দাদা চলেন চা দোকানে যাই, চা বিস্কুট খাব, তারপর দেখা যাবে কোথায় পাবো দূতরাগোটা৷

আমারা দু'ভাই চা দোকানে আসলাম, চা দোকানদার আবার আমার খুব পরিচিত৷ আমাদের দেখে চা'দিলো, চা খাইতে খাইতে মনে পড়লো দূতরাগোটার কথা৷ চা দোকানদারের নাম মোঃ জহির, আমি সচরাচর জহির ভাই বলে সম্মোধন করতাম৷আমি বললাম জহির ভাই আপনার বাসার সামনে একটা দূতরাগোটার গাছ ছিলো সেটা কি আছে? তখন জহির ভাই বললো আরে দাদা গতকাল গাছটা উপরে ফেলে দিছে, সেটা এখনো আমার বাসার সামনে পড়ে আছে ,দেখেতো বাসার সামনে আছে কি না! দৌড়ে গেলাম জহির ভাইয়ের বাসার সামনে৷ ভগবানের কী লীলা, তা বুঝে উঠতে পারছিলামনা৷ বিয়ের কার্য সম্পাদন করতে লাগবে ৮টা গোটা, গাছটায় আছেও ৮টা গোটা৷ গোটাগুলো দেখা মাত্রই সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানালাম,বললাম হে,দয়াল তোমার লীলা কে বুঝতে পারে! এই দূতরাগোটা না হলে বিয়ের কার্য সম্পাদনের ত্রুটি থাকতো,আর এই ত্রুটি সবসময় আমার মেয়ের জীবনে অশান্তি বয়ে আনতো৷

কিছু হলেই বলতো, দূতরাগোটা ছাড়া বিয়ে হয়েছেতো তাই এমন হচ্ছে৷ যাক সব দয়ালের ইচ্ছাকৃত ভাবেই হয়, সৃষ্টিকর্তার উপরে কারো হাত আছে বলে আমি মনে করিনা, তিনিই সর্বশক্তিমান তিনিই সকল ক্ষমতার অধিকারি৷ দূতরাগোটা নিয়ে বাসায় আসলাম, রান্না করার জন্য বাবুর্চি বাসায় এসে হাজির, বাবুর্চিকে রান্না করার জন্য সব বুঝিয়ে দিলাম৷ ২০০শ লোকের আয়োজন, দুপুর ২টার মধ্যেই বাবুর্চির সব রান্না শেষ, দুপুর ১টায় আমার নিমন্ত্রন করা লোক আসবে গরীবখানায় ডালভাত সেবা করতে, বরযাত্রী আসবে রাত ৮/৯টায়৷ বর (ছেলে) বাড়ি গোপালগঞ্জ, গোপালগঞ্জ থেকে যাত্রা দিয়ে ঢাকার মীরপুরে অবস্থান করবে কিছুক্ষণ, তারপর রাত ৮টায় রওনা দিবে নারায়নগঞ্জের উদ্দেশে৷ দুপুরে আমার এলাকার নিমন্ত্রন করা মানুষজন সেবা (খাওয়া) শেষ করে যাওয়ার পর বাবুর্চি বরযাত্রীদের সেবা (খাওয়া) করার রান্নার কাজ আরম্ভ করে দেয়৷

বরযাত্রী আসলো রাত ১১টার সময়, এলাকার ও আমার ছেলের বন্ধুরা বাদ্যকর দিয়ে বাদ্য বাজায়ে বরযাত্রীদের গ্রহণ করলো৷ রাত ১২:৩০ মিনিটে বিবাহের কাজ আরম্ভ হয়ে, সকাল ৫টায় শেষ হয়েছে বিয়ের কাজ৷ সকাল ১০টায় মেয়েকে নিয়ে গোপালগঞ্জের উদ্দেশে রওনা দিবে বরযাত্রীরা, তাই হলো, সকাল ১১টায় মেয়ে বিদায় দিলাম। আমার আত্মীয়স্বজন পরিবারবর্গ এলাকাবাসি সবাই কান্নাকাটি করে যখন রাস্তা হতে বাসায় ফিরলো, ঠিক তখন বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন এলাকা৷ এলাকার সবাই তখন অবাক! সবাই বলতে লাগলো নিতাই বাবু কি ইলেকট্রিক সাপ্লাই আফিসের সাথে কন্ট্রাক্ট করেছিল? সারাদিনে বিদ্যুৎ মোটকথা থাকেই না, আর নিতাই বাবুর মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে গত দুদিন একটাবারের জন্যও বিদ্যুত্‌ গেলো না, আবার একফোটা বৃষ্টিও পড়লোনা, কারণটা কি? সবার মুখে-মুখে শুধু এই কথাটা'ই চলছিলো মাসখানেক৷ আমাকে অনেক লোকে জিজ্ঞেসও করছিলো অনেকবার, কি ব্যাপার দাদাবাবু জাদু জানেন নাকি ইত্যাদি ইত্যাদি৷ আমি উত্তর দিলাম সব আমার সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছাকৃত ভাবে'ই হয়েছে অন্যকিছু নয়৷

চাওয়ার মত চাইতে পারলে সৃষ্টিকর্তায় কাউকে নিরাশ করেনা৷ মেয়ে বিয়ে দেবার পর দুবছরের মাথায় এক কন্যা সন্তানের জননী হয়, তার দুবছর পর আবার এক কন্যাসন্তানের জননী হয়৷ সংসারক্ষেত্রেতো আগুন লাগলো পরপর দুই কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়ার কারণে৷ আবারও আমার মেয়ে গর্ভবতী হয়, মেয়েজামাই'র এককথা, এবার যদি তোমার গর্ভের সন্তান মেয়ে হয় তবে এই দু'মেয়ে নিয়ে সোজা চলে যাবে নারায়ণগঞ্জে, আর কোন কথা চলবেনা৷ মেয়ের শশুরশাশুড়ীও একই কথা, সবদোষ আমার মেয়ের৷ আমার সৃষ্টিকর্তাকে ডাকতে লাগলাম, হে দয়াল তুমি কৃপাপূর্ণদৃষ্টি দাও আমার মেয়ের উপর, তুমি ছাড়া আমার মেয়ের আর কেহ নাই দয়াল, একটি ছেলে সন্তান আমার মেয়েকে তুমি দান করো দয়াল৷ আমার বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, পরিচিতজন, সবার কাছে আশীর্বাদ চেয়েছিলাম, আমার মেয়ের সংসারটা যাতে টিকে থাকে৷ আমার দয়াল সৃষ্টিকর্তা এবারও আমার ঢাকে সারা দিলো৷ সৃষ্টিকর্তার কৃপায় ও সকলের আশীর্বাদে আমার মেয়ে কয়েক দিন আগে রাজপুত্রের মত এক ছেলেসন্তান জন্ম দিলো৷ আমার সৃষ্টিকর্তার লীলা কে বুঝতে পারে, চাওয়ার মত চাইতে পারলে, নিশ্চয়ই সে আশা পূরণ করে৷