বাংলাদেশ সমবায় শিল্প সংস্থা (সীঃ) জুট প্রেস

নিতাই বাবু
Published : 22 May 2016, 09:57 AM
Updated : 22 May 2016, 09:57 AM

বাংলার সোনালী আঁশের কথা কার না জানা, ছোট-বড় ছেলে-বুড়ো সবাই জানে বাংলার সোনালী আঁশের কথা। প্রাথমিক শিক্ষা পাঠ্যপুস্তক থেকেই সোনালী আঁশের শিক্ষা শুরু হয়, বাংলার গৌরব গাঁথা এই সোনালী আঁশের ইতিহাস। তার নাম পাট। পাট একটি বর্ষাকালীন ফসল, পাটই বাংলার শত বর্ষের ঐতিহ্য। এই পাটকেই বলা হয় বাংলার সোনালী আঁশ। পাট মূলতঃ দুই ধরনের জন্মায়- (১) corchorus capsularis (সাধা পাট) এবং (২) corchorus olitarius (তোষা পাট ); এটি Tiliaceae পরিবারের অন্তর্গত একটি উদ্ভিদ। পাটকে আরো একাধিক নামে ডাকতে শোনা যায়, যেমন- দেশী পাট, কেনাফ পাট, মোস্তা পাট ও বগি পাট। আর ইংরেজি নামতো সবারই জানা (jute) জুট।

শীতলক্ষ্যা নদী, জাহাজ থেকে কাঁচা পাট গুদামে আনা হচ্ছে।

পাট একটি বর্ষজীবী ফসল। এর জীবনকাল ১০০ থেকে ১২০ দিন পর্যন্ত। চৈত্র-বৈশাখ থেকে আষাঢ় শ্রাবণ। পাট একটি লাভজনক ফসল, যা অধিকতর বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহকারী একটি কৃষিজাত ফসল। এই পাটের সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের দেশের হাজার হাজার নারী-পুরুষ শ্রমিক ও কৃষক-কৃষাণীর আত্মা, তারপর জীবিকা। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে কৃষকেরা জমি থেকে পাটগাছ কেটে আঁটি বেঁধে পানিতে জাঁক দিয়ে ডুবিয়ে রাখে। ১০-১২ দিন পর পানি থেকে উঠিয়ে এনে খুব যত্ন সহকারে পাটগাছ থেকে এই মূল্যবান পাট সংগ্রহ করে শুকিয়ে বাজারজাত করে। দেশের বড় বড় ব্যবসায়ীরা সেই পাট কৃষক থেকে কিনে এনে দেশের বিভিন্ন স্থানে চালান করে, কিংবা ব্যবসায়ীদের নিজস্ব মিলে বা গোডাউনে জমা রাখে বিদেশে রপ্তানী করার জন্য। বিদেশে রপ্তানীর আগে এই পাটকে যাচাই-বাচাই করে বেল আকারে পরিণত করে।

এখানে পাট ওজন করে প্রেসে দেওয়ার জন্য টেনে নেওয়া হচ্ছে।

এমনই কয়েকটি জুট প্রেস আমাদের নারায়নগঞ্জে অবস্থিত। এমন একটি জুট প্রেসের সাথে আমার সম্পৃক্ততা বহু বছর ধরে, যার নাম- বাংলাদেশ সমবায় শিল্প সংস্থা (সীঃ)। এই সংস্থাটি পাটের জন্যই খ্যাত। এই সংস্থাটি নারায়নগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন গোদনাইলে অবস্থিত। বহু প্রাচীন এই সংস্থার অভ্যন্তরে আছে পাট রাখার বিশাল বিশাল গোডাউন, আছে পাট বেল করার জন্য সেই প্রাচীন আমলের প্রেস মেশিন। পাটের ভরা মৌসুমে দেশের বিভিন্ন জেলা, উপ-জেলা থেকে এখানে পাট আসে নৌপথে ও স্থলপথে। নৌকা ও ট্রাক থেকে এই পাটকে নামানো হয় নারী-পুরুষ শ্রমিক দ্বারা দৈনিক মুজরী হিসেবে। সেসব শ্রমিকের কাজের নাম আমদানী কাজ।

কাঁচা পাট বাজার জাত করার জন্য ট্রাক যোগে নেওয়া হচ্ছে দেশের বিভিন্ন জায়গায়।

কাঁচা পাট বাজার জাত করার জন্য ট্রাক যোগে নেওয়া হচ্ছে দেশের বিভিন্ন জায়গায়।

এই পাট নৌকা/ট্রাক থেকে নামিয়ে সোজাসুজি নিয়ে যায় গোডাউনে, গোডাউনে আছে পাট যাচাই করার জন্য শ্রমিক, তাদের বলা হয় "খাতাদার"। খাতাদারের কাজ হলো পাটকে ভাগ করা, ভালো-খারাপ ও মাধ্যম। আবার পাটের গোড়ার শক্ত অংশকে কেটে ফেলা, শক্ত অংশ কেটে পাটকে আনুমানিক ৪০ কেজি ওজনের মত করে বোঝা তৈরি করে রাখা। তখন এই বোঝা নিয়ে যাওয়া হয় প্রেসে, যারা এই বোঝা বহনকারী, তাদের বলা হয় বোঝা ওয়ালা শ্রমিক। প্রেসে নিয়ে যাওয়ার পর আবার ওজনকারীরা ওজন করে প্রেসের শ্রমিকদের কাছে দিতে হয়, যিনি ওজনকারী তার নাম "কয়েলী" শ্রমিক। কয়েলী থেকে আসে প্রেসে। প্রেসের শ্রমিক থাকে ৭/৮ জন, বিরাট বড় প্রেস এটি, এই প্রেসের শ্রমিকদেরও ভিন্ন ভিন্ন নাম থাকে। কাঁচা শ্রমিক, পাকা শ্রমিক ও ছিক গাঁথা শ্রমিক।


বেলগুলো রপ্তানীর জন্য প্রেস থেকে গোডাউনে নিচ্ছে রপ্তানী শ্রমিকরা।

এই প্রেস মেশিনটি সম্পূর্ণ মেবিল তেলের প্রেসারে চলে, আর প্রেস ঘরটা হলো দ্বিতল। নিচেকার জায়গায় শুধু প্রেসের মেশিন আর তেলের ট্যাঙ্ক ও তেলের পাম্প। উপরে শুধু বেল করার জন্য একটা খাঁচা মাত্র। নিচতলার নিচেও আছে আরো ৫০ থেকে ৬০ ফুট গভীর তেলের ট্যাঙ্ক, উপরে প্রেস ড্রাইভার আছে, সেখানে আছে তার কাছে তিনটা গিয়ার সংযুক্ত হ্যান্ডেল। কয়েলীর কাছ থেকে ওজন করা পাট টেনে এনে একটা গর্তের ভিতরে ১৮০ কেজি পাট ঢেলে দেয়, এই ১৮০ কেজি (প্রায় ৫ মন) পাট মনে হয় কোথায় যেন হারিয়ে গেল। প্রেস ড্রাইভার যখন প্রথম গিয়ার টান দেয় তখন আস্তে আস্তে ওই নিচের তেলের ট্যাঙ্ক হতে তেলের প্রেসারে জাহাজের মস্তুলের মত দুইটা সেপ দ্বারা আস্তে আস্তে উপরে এই ১৮০ কেজি পাটকে উপরে উঠতে থাকে। চারিদিক থাকে লোহা দিয়ে আটকানো বাক্সের মত। নিচ থেকে উঠে এসে যখন বেল আকারে হয়, তখন সুই এর মত লম্বা লম্বা ছিকের ভিতরে রশি আটকে কাপড় যেভাবে সেলাই করে, ঠিক সেভাবে বেলটাকে সেলাই করা হয়। এটা হলো বেল হওয়ার প্রথম ধাপ, পরবর্তী ধাপে প্রেস ড্রাইভার আরো একটু বেশি চাপ দেয়া হয়, সেখানে বাধার রশি আরো টাইট ও মজবুত করে দেয় কাচা ওয়ালা খালাসীরা। যারা এই কাজটি করে তাদের বলা হয় "খালাসী"। এই হলো বেলের দ্বিতীয় ধাপ।

প্রেস থেকে বেল পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেলটাকে সরিয়ে ঠেলাগাড়িতে উঠিয়ে দিচ্ছে রপ্তানী শ্রমিক।

দ্বিতীয় ধাপ শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে চলে আসে তৃতীয় ধাপে, এটা বেল হওয়ার সর্বশেষ ধাপ। এই ধাপে থাকে দুইজন শ্রমিক, তারা হলো পাক্কা 'খালাসী'। বেল পুরোপুরি টাইট হয়ে গেলে, দ্বিতল থেকে একটা সুড়ঙ্গ নালা আছে পাক্কা খালাসীদের সামনে, তখন বেলের ঘেরা লোহার ঢালা খুলে দেয় একজন খালাসী, আর একজন খালাসী পা দিয়ে ঠেলে ওই সুড়ঙ্গ পথে ফেলে দিলে বেলখানা সঙ্গে সঙ্গে দ্রুতগতিতে নিচে চলে যায়। নিচে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুইজন 'রপ্তানী শ্রমিক' সেই বেলটাকে দ্রুত সরিয়ে ফেলে সেখান থেকে। (এই প্রেস থেকে প্রতি ঘন্টায় ৬০টি বেল উৎপাদন করে শ্রমিকরা)। তখন এই রপ্তানী শ্রমিকরা রপ্তানী দেওয়ার জন্য বিভিন্ন গোডাউনে এই বেল গুলো নিয়ে সারি সারি করে "খামাল" দিয়ে রাখে। এরপর দেশ-বিদেশে যেকোন যায়গায় কোম্পানীর হুকমতে ট্রাকে কিম্বা জাহাজে এই বেল গুলো ডেলিভারি দেওয়া হয়। চলে যায় দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় আমাদের সোনার বাংলার সোনালী আঁশ।

পত্রিকান্তে দেখা যায় বেশি একটা সুখে নেই এই মূল্যবান সোনালী আঁশের শ্রমিকরা। তবু আশা রাখি জয় হোক এই পাট শ্রমিকদের, তাদের পরিশ্রমে বয়ে আনুক আরো বেশি বৈদেশিক মুদ্রা।