আমি তখন খুব ছোট, বয়স আনুমানিক পাঁচ-ছয় হবে, ক্লাশ ওয়ানে পড়ি। ওয়ান বলতে কী শুধু একটা বাল্যশিক্ষা বই আর একটা খড়ি মাটি। আমাদের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থানাধীন বজরা রেলস্টেশনের পশ্চিমে মাহাতাব পুর গ্রামে। আমাদের বাড়ি থেকে, আমাদের প্রাইমারী স্কুলটা ছিলো প্রায় আধা কিঃমিঃ দূরে। স্কুলে একজন প্রধান শিক্ষক সহ মোট শিক্ষক ছিলো পাঁচজন, সবাই পুরুষ শিক্ষক, প্রধান শিক্ষক ছিলো আমার দূর সম্পর্কে জেঠামশয়। ওই স্কুলে জেঠামশয়ের আপন বলতে আমিই ছিলাম, সেই জন্য আমার প্রতি জেঠামশয়ের খুব নজর ছিল। পড়া না পারলে সাথে সাথে রাগ করতেন জেঠামশয়, আমার খুব রাগ হতো জেঠার প্রতি। সময় সময় কেঁদে কেঁদে মায়ের কাছে নালিশও জানাতাম আমি।
যেদিন স্কুলে মার খেতাম, সেদিন জেঠামশয় বিকালবেলা হাঁটতে হাঁটতে আমাদের বাড়ি আসতেন। দূর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম, মায়ের কাছে কী বলে জেঠামশয়। বলতে শোনা যেত, আরে নিতাই'র পড়া-লেখাতো ভাল হবেরে, অঙ্কে খুব ভাল মাথা ওর, ওকে যদি একটা মাস্টার দিয়ে প্রাইভেট পড়াতে পারতিস তবে পড়া-লেখায় একশতে একশ। মা বলতেন শুনেন দাদামশাই, ভাত খেতে ভাত পাই না, তার উপর ছেলের পড়ার মাষ্টার! মায়ের মুখের বাণী শুনে জেঠামশয় আস্তে আস্তে বসা থেকে উঠে চলে যেতেন। যাবার আগে মা'কে বলে যেতেন, শোন নিতাই'র মা, বিকেল বিকেল আমাদের বাড়ি ওকে পাঠিয়ে দিও আমি পড়াবো ওকে, পয়সাকড়ি লাগবে না।
জেঠার বাড়ি আর আমাদের বাড়ি পাশাপাশি ছিল। মা আর আমার তিন (৩) বড়দিদি প্রতিদিন বিকালবেলা বাল্যশিক্ষা একটা বই দিয়ে পাঠিয়ে দিতেন জেঠামশাইয়ের বাড়ি, সন্ধ্যার আগে আগে আবার চলে আসতাম, কোন দিন যেতাম, আবার কোন দিন যেতাম না। না যাওয়ার পিছনে কারণও আছে, কারণ হলো, সিলেট-পেন্সিল নাই, তার জন্য। আমরা ভাই-বোন সর্বমোট (৬) ছয়জন, আমি সবার ছোট বিধায় আমার প্রতি সবার একটু আদরের নজর। বড়দিদি'রা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে কলম আর কলাপাতার খাতা বানিয়ে দিতেন আমাকে। শুধু আমি কেন! গ্রামের সব শিশুদের একই অবস্থা তখনকার সময়। আমার হাতে খড়ি বাঁশের কঞ্চির কলম আর কলাপাতার খাতা।
সে ১৯৬৮-১৯৬৯ সালের কথা, টাকার খুবই দাম তখন। বাবা তখন নারায়নগঞ্জের চিত্তরঞ্জন কটন মিলে ১৫০ টাকা বেতন পেতেন। বড়দাদা বাবার সঙ্গে নারায়নগঞ্জে কাজের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায়। বাবা বেতন পেলে, ১০০ টাকা দিয়ে বড়দাদাকে বাড়িতে পাঠাতো, বড়দাদা ১০ টাকার মত রেখে বাকী ৯০ টাকা মায়ের কাছে দিতেন। মা এই টাকা দিয়ে সারা মাস অতি কষ্টেসৃষ্টে আমাদের সংসারটা চালাতেন। বড়দাদা যখন বাড়িতে আসতেন তখন আমার আনন্দের সীমা থাকতো না, আমার খুব আনন্দ, কেননা, বড়দাদা আমাকে সাথে করে বাজারে নিতেন, বিস্কুট কিনে দিতেন, আরো কত কী!
বড়দাদা বাড়ি আসতে আমার জন্য একটা কলম এনেছে, খুবই সুন্দর কলমটা। এক মুহুর্তের জন্যও কলমটাকে হাতছাড়া করতাম না, যদি কেহ নিয়ে যায় বা হারিয়ে যায় তাই। কলমটা নিয়ে স্কুলে যেতাম, সেই কলমটা দেখার জন্য সমবয়সী ছাত্রছাত্রীরা ঘিরে ধরতো শুধু কলমটা একটু দেখার জন্য। তখন আমাদের মাহাতাব পুর গ্রামের মধ্যে শুধু আমার বাবা ও আমার বড়দাদাই থাকতেন নারায়নগঞ্জ, তার মানে বিদেশ। বড়দাদা বা আমার বাবা বাড়ি আসলে, সকাল-বিকাল বাড়িতে শুধুশুধু মানুষ আসতেন চা পান করার জন্য। বাবার রেশন কার্ডের গম, চিনি, সরিষার তৈল এগুলি বড়দাদা বাড়ি আসার সময় নারায়নগঞ্জ থেকে বাড়িতে নিয়ে আসতেন। আমার মায়ের চা পান খুব প্রিয় ছিল, মানুষের আগমন টের পেলেই মা চা জ্বাল দিতে শুরু করে দিতেন, দুই-তিনজন গুরু ব্যক্তি মানুষ আসলে সবাইকে কাপে করে চা পরিবেশন করতেন।
তখন'তো আমাদের গ্রামে কারো বাড়িতে কাপ-প্রিজ ছিল না। চা পান করতো নারিকেলের আইছা করে, বা গ্লাসে করে। আমার মায়ের দেখাদেখি ক'জন মানুষ সেই চৌমুহনী টাউন হতে চা'পাতা আর চা'র কাপ কিনে আনতেন। আমাদের বাড়ি থেকে চৌমুহনীর দূরত্ব প্রায় (৪) চার মাইল। এই চার মাইল হেঁটে যেত পয়সাকড়ির অভাবের কারণে। রেলগাড়ি আর নৌকা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না চৌমুহনী যাওয়ার। তখনকার সময় খুব কম মানুষে'ই ছিলো, পয়সা খরচ করে চৌমুহনী যাওয়ার, একেবারে নাই বললেও আমার ভুল হবে না। এই পয়সার অভাবে তখন দেখতাম মানুষকে লেংটি পরতো, লেংটি হলো দোপাট্টা এক টুকরা কাপড়, যা কোমরের সামনে থেকে পিছনে কাইতনে আঁটকাইয়ে গোপনাঙ্গ ঢেকে রাখার কাপড়। আমি নিজেও লেংটি পরতাম, সকালবেলা স্কুলে যাওয়ার সময় প্যান্ট আর সাধারণ একটা জামা, স্কুল ছুটির পর বাড়িতে এসে'ই কিছুক্ষণ হয়তো বস্ত্রহীন হয়ে থাকতাম, পরে মা অথবা বড়দিদি'রা হাতে উঠিয়ে দিতেন সেই লেংটি খানা পরার জন্য। যেমন বনের জংলী মানুষেরা পরিধান করে থাকে, ঠিক তেমনই। এরকম শুধু আমার বেলায় না, আমাদের সমবয়সী সবার বেলায়'ই ছিল এই রীতিনীতি। বুড়ো মানুষের বেলায়ও বহাল থাকতো এই মূল্যবান লেংটি পরার নিয়ম।
প্রিয় পাঠক ভাই ও বোনেরা, এখনে আমার সমবয়সী যদি কোন ভাই-বোন থাকে আমাদের নোয়াখালীর, তবে হয়তো ওইসব ভাই-বোনদের'ই বিশ্বাস হবে এই লেংটির ইতিহাস। সেই লেংটি আবার বাজারে বিক্রী হতো, এই লেংটিকে খুব সযত্নে রাখা হতো, যেন ছিঁড়ে না যায়। আমি যা দেখেছি একটা ধূতি আর একটা গলাকাটা পাঞ্জাবী রাখতো এক জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার জন্য, আর সবসময় পড়তো লেংটি। মহিলাদেরতো ছায়া-ব্লাউজ ছিলোই না, খুব কম মায়েরা'ই ছায়া-ব্লাউজ পরিধান করতো। আমার হাফপ্যান্ট, মা নিজে'ই ঘরের বোটিদাও দিয়ে কেটে সুই-সূতা দিয়ে হাতে সেলাই করে প্যান্ট তৈরি করে দিতেন, আমি পরতাম। গায়ের জামাও আমার মা নিজ হাতে বানিয়ে দিতেন, শুধু আমার মা নয়, আমি দেখেছি, এখনে আমার স্পষ্ট মনে আছে, গ্রামের বেশির ভাগ মায়েরা'ই পরিবারের পোশাক তৈরির কাজটা নিজেরা'ই করতেন।
একটা পয়সা স্কুলে যাওয়ার সময় আমি পাই নাই, যদিও পাঁচ পয়সা বা দশ পয়সা পেতাম, বাবা কিম্বা বড়দাদা বাড়িতে অাসলে, নয়'তো নয়। আমরা যখন ১৯৭২ সালের শেষ দিকে নোয়াখালী ছেড়ে নারায়নগঞ্জে আসি, তখন আমি চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হলাম, নারায়নগঞ্জের বন্দর থানাধীন লক্ষণখোলা ফ্রী প্রাইমারী স্কুলে। স্কুলে যাওয়ার সময় মা পাঁচ পয়সা দিতেন আমাকে, তাও প্রতি দিন নয়। এই পাঁচ পয়সার মধ্যে কোন দিন এক পয়সা ফেরতও আনতাম, পরদিন যদি আবার পয়সা না পাই, তার জন্য। আর এখন যুগের পরিবর্তন ঘটেছে, আমার অফিসের সামনে "নিউ লক্ষীনারায়ন কটন মিলস উচ্চ বিদ্যালয়" যখন স্কুল ছুটি হয় দেখি ৭/৮ বছরের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ১০০/৫০০ টাকার নোটও ভাঙ্গিয়ে দোকান থেকে সওদা কিনে। আর বেশির ভাগ ছেলে-মেয়েদের হাতে তো মোবাইল ফোন আছেই। এসব দেখে সেই আগেকার দিনের স্মৃতি গুলো নিজের মন'কে নাড়া দেয়, হায়রে দিন, ভাবি নাই তুমি যে এত বদলে যাবে।