নারায়ণগঞ্জের পাঠানটুলী গোরস্থানের কবর গেল পুকুরে

নিতাই বাবু
Published : 29 Sept 2016, 12:16 PM
Updated : 29 Sept 2016, 12:16 PM

পৃথিবীতে জন্ম নিলে মরতে হয় সব জীবের, মৃত্যু ছাড়া দুনিয়াতে কোন জীব বা প্রাণী নাই ৷ পিতার মস্তিষ্ক থেকে মাতৃগর্ভে যখন পয়দা হতে থাকি তখন মানুষের কোন নাম বা পরিচয় নেই৷ পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হওয়ার ছয়দিনের দিন, বা নয়দিনের দিন খুব আনন্দ উল্লাস করে নবজাতকের একটা নাম রাখা হয়, এই মানুষ সমাজে পরিচিতির জন্য ৷ মানুষের মাঝে দিনে-দিনে বেড়ে ওঠার সাথে সাথে দেখতে পায় তার জন্য এই দুনিয়াতে কতকিছুর ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে তার জন্মের বহু আগে থেকে ৷ গাছপালা, ঘরবাড়ি, খাদ্যশষ্য, পোষাক-আষাক, বাসস্থান ও কবরস্থান বা গোরস্থানের ৷

মানুষ জীবিত থাকতে দরকার ঘরবাড়ি বাসস্থান, আর মৃত্যুর পর দরকার হয় গোরস্থানের ৷ তার মানে "চিত্ত থেকেই চিতা", "জন্ম থেকেই গোরস্থান" দুনিয়াতে চিত্ত আছে বলেই চিতার দরকার হয়েছে, আর মানুষ আছে বলেই গোরস্থানের দরকার ৷ মানুষ যদি দুনিয়াতে না আসতো তবে আর চিতা বা গোরস্থানের প্রয়োজন হতো না ৷ গোরস্থান বা চিতায় আমাদের সবার একদিন না একদিন যেতে হবেই, কেউ আগে কেউ পরে ৷ যেই গোরস্থানে একদিন যেতে হবে, যেখানে যুগযুগ ধরে শায়িত থাকবে, সেই চিতা বা গোরস্থানটি থাকা চাই নিজ বাসস্থানের চেয়ে বেশি সুসজ্জিত ও নিরাপদের ৷ যেন যুগযুগ ধরে মৃত:মানুষটির কবরখানা তার বংশধর'রা মাসের পর মাস, আর বছরের পর বছর হাতে ছুঁইয়ে প্রিয় স্বজনকে স্মরণ করে একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলতে পারে ৷

যেই মৃত:মানুষটিকে গোরস্থানে কবর দেওয়া হয়েছে, সেই মানুষটির স্মরণে তার বংশধর'রা যদি গোরস্থানে গিয়ে কবরখানার নিশানাই ঠিক না পায়, তবে তার বংশধর'রা মৃত:মানুষটিকে স্মরণ করবে কীভাবে? যে কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে প্রিয় স্বজনের কবরে একটা আগরবাতি জ্বালিয়ে মৃত: মা' বাবাকে স্মরণ করার জন্য গোরস্থানে গিয়ে দেখল বাবা'র অথবা মায়ের কবরখানা আর নাই, গোরস্থানের পাশের পুকুরে কবরখানা বিলীন হয়ে গেছে অনেক আগে, তখন মৃত: ব্যক্তির স্বজনদের মনে কেমন কষ্ট লাগবে? আগরবাতি আর গোলাপ-জল পুকুরে বিসর্জন দিয়ে চলে আসা ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না তার স্বজনদের ৷

এমনই এক গোরস্থানের কিছু সংখ্যক কবর নিয়ে বিলীন হয়ে গেছে নারায়ণগঞ্জ পাঠানটুলী পৌরঃ গোরস্থানের কিছু অংশ ৷ পুকুরের পাড় ভেঙ্গে, বিলীন হয়ে যাওয়া কবরগুলির মধ্যে রয়ছে গোদনাইল এলাকার অনেক নামী-দামী কিছু ব্যক্তিবর্গের, যারা এখন প্রয়াত বা বেহস্তবাসি ৷ বিশেষ কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সম্মানিত মুসলমান ভাইবেরাদারদের গোরস্থানে যেতে দেখা যায় প্রিয়জনদের কবর জেয়ারত করার জন্য ৷ পবিত্র সব-ই-বরাত উপলক্ষে গোরস্থানে সম্মানিত মুসলমান ভাইবেরাদার একটু বেশি যায়, তাদের প্রিয়জনের কবরে একটা আগরবাতি জ্বালিয়ে তাদের স্মরণ করার জন্য ৷ এই সব-ই-বরাত এর রাতে অনেকে মৃত: বাবা, মা' দাদা-দাদি, ভাই-বোন, পুত্রকন্যার জন্য গোরস্থানে গিয়ে, তাদের বেহস্তবাসি করা ও তাদের গুনাহ মাপ করে দেয়ার জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে দুহাত তুলে কাঁদতেও দেখা যায় ৷

কাঁদতে দেখা যায় পুকুরে বিলীন হয়ে যাওয়া কবরগুলো না পেয়ে, তখন কাঁদতে কাঁদতে সাথে করে নেয়া আগরবাতি সেই পুকুরপাড়েই জ্বালিয়ে দেয় মৃত: আত্মীয়স্বজনদের নামে ৷ এমন এক সব-ই-বরাত এর রাতে আমার এক পরিচিত লোককে জিজ্ঞেস করলাম, মন খারাপ কেন স্যার? প্রত্যুত্তরে জবাব পেলাম, বাবা'র কবরখানাও পুকুরে বিলীন হয়ে যাওয়া পথে ৷ এই সব-ই-বরাত এ পেয়েছি, আগামী সব-ই-বরাত এ পাবো কিনা জানিনা ৷ জিজ্ঞেস করলাম স্যার, গোরস্থানটি কি সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন? বললেন হাঁ, তবে সিটি কর্পোরেশন এসব নিয়ে মনে হয় মাথা ঘামায় না ৷ এই পুকুরের গ্রাস থেকে বাকি কবরগুলি বাঁচানোর জন্য, গোরস্থানে মানুষের মুক্তহস্তে দান করা অর্থ দিয়ে কয়েকবার পুকুরপাড়ে বাঁশমূলি দিয়ে আড়গড়া দেয়া হয়েছে ৷ এই বাঁশমূলির আড়গড়া তো বেশি দিন যেতে না যেতেই পোঁচে ভেঙ্গে যায় ৷ যদি নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন এই গোরস্থানটির দিকে একটু নজর দিত, তবে হয়তো পুকুরের গ্রাস থেকে বাকি কবরগুলো রক্ষা পেত ৷ দুঃখ আর আক্ষেপের সুরে কথাগুলো বললেন সেই পরিচিত লোকটি ৷ সরেজমিনে গোরস্থানের ভিতরে গিয়ে দেখা যায়, গোরস্থানের দ্বিতীয় গেটের রাস্তার সর্বউত্তরে একটি পুকুর, সেই পুকুরের পাড় ভেঙ্গে বিলীন হয়ে গেছে অনেকগুলো নতুন-পুরাণ কবর ৷ স্থানীয় লোকদের মুখে শোনা যায়, এই পুকুরে গোরস্থানে প্রায় একহাজারেরও বেশি কবর বিলীন হয়ে গেছে বহু আগে থেকে ৷

বর্তমানে অত্র গোদনাইল পাঠানটুলী এলাকার লোকদের কথা হল, বর্তমানকালে নারায়ণগঞ্জে এত উন্নয়ন হচ্ছে যা বাংলাদেশের কোন জেলা শহরের সিটি কর্পোরেশনে হচ্ছে না ৷ অথচ আমাদের নারায়ণগঞ্জের সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন অতি প্রাচীনতম গোরস্থানের কোন উন্নয়ন বা কাজ হচ্ছে না ৷ গোরস্থানটি রাস্তা হতে একটু উঁচু, আগে রাস্তার পাশে ইট-সিমেন্টের কোন প্রাচীর ছিল না, বৃষ্টিপাত হলেই মাঝেমাঝে দেখা যেত, কবর হতে রক্ত নির্গত হয়ে রাস্তা ভেসে যেত ৷ এখন ইটপাটকেলের তৈরি প্রাচীর ভেদ করে আর রক্তমিশ্রিত পানি বেরুতে পারেনা, বা সেটা দেখাও যায় না ৷ এখন কয়েক বছর ধরে শুরু হয়েছে গোরস্থানের উত্তরের পুকুরপাড় ভাঙ্গা, এখন থেকে যদি নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন এই পাঠানটুলী গোরস্থানের দিকে নজর না দেয়, তবে দুএক বছরের মধ্যে এই গোরস্থানের অনেকগুলি কবর পুকুরে বিলীন হয়ে যাবে, তা নিশ্চিত ৷

পাঠানটুলী এলাকার লোকদের কথা, মাসদাইর হিন্দুদের শ্মশান, খ্রীষ্টানদের কবরস্থান ও মাসদাইর গোরস্থানের উন্নয়ন হচ্ছে কাজ হচ্ছে সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক, আর আমাদের পাঠানটুলীর এই প্রাচীনতম গোরস্থানটির কোন উন্নয়ন হচ্ছে না কাজও হচ্ছে না ৷ এটা পাঠানটুলী গোরস্থানের প্রতি অবহেলার সামিল ৷ এলাকাবাসির দাবি, পাঠানটুলী গোরস্থানের প্রতি এহেন অবহেলা জনিত আচরণ ত্যাগ করে, অনতিবিলম্বে গোরস্থানের পুকুরপাড় শক্ত-মজবুত আড়গড়া দিয়ে, গোরস্থানের বাকি কবরগুলি রক্ষা করার জন্য, নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন যেন এর দ্রুত পদক্ষেপ নেয় ৷ এলাকাবাসির বিশ্বাস, নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের বর্তমান মেয়র পাঠানটুলী জনগণের কল্যাণে গোরস্থানটির রক্ষণাবেক্ষণে দ্রুত এগিয়ে আসবেন ৷