বেওয়ারিস কুকুরের আক্রমণ থেকে নারায়ণগঞ্জবাসীদের বাঁচাবে কে?

নিতাই বাবু
Published : 24 Dec 2016, 02:21 AM
Updated : 24 Dec 2016, 02:21 AM

ছবিটি নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন গোদনাইল লক্ষীনারায়ণ বাজার থেকে তোলা।

ছোটবেলা থেকে গত কয়েক বছর আগেও দেখতাম শহরে কুকুরের উপদ্রব বেড়ে গেলে পৌরসভা কর্তৃপক্ষ জলাতঙ্ক রোগ প্রতিরোধের জন্য টিম নিয়ে নেমে পরতো শহরের পাড়া-মহল্লায়, কুকুরের দেহে "রেবিস" বা "জলাতঙ্ক" প্রজনন নিষ্ক্রিয় করণের লক্ষ্যে। পৌরসভার পশু চিকিৎসক ও শ্রমিক সুইপার বা ডুম সম্প্রদায়ের লোকের সমন্বয়ে এই টিম পরিচালনা করা হতো। এই জলাতঙ্ক রোগ প্রতিরোধ টিমের মধ্যে থাকতো, জলাতঙ্ক রোগ প্রতিরোধক "রেবিস" এর টিকা বা ইনজেকশন। সুইপার বা ডুম'রা সাঁড়াশি দিয়ে কুকুরটাকে আটকে ফেলতো, পরে পশু চিকিৎসক সেই কুকুরের দেহে জলাতঙ্ক প্রতিরোধক টিকা বা ইনজেকশন পুস করে ছেড়ে দিতো। সেই কুকুরটি কাউকে কামড়ালেও কোন ভয় ছিলো না, বা জলাতঙ্ক রোগ হতো না।

এভাবে সপ্তাহব্যাপী বা মাসব্যাপী চলতো এই জলাতঙ্ক রোগ প্রতিরোধ টিমের কাজ। এরপরেও যদি কোন ফল না হতো, তখন নামতো কুকুর নিধনের কাজ। সুইপার বা ডুমরাই এই কাজটা করতো, তখন আর পশু চিকিৎসকের দরকার হতো না। সাঁড়াশি দিয়ে কুকুরটিকে আটকিয়ে কুকুরের মাথায় দুইটা আঘাত করলেই সব শেষ, মানে কুকুরের মৃত্যু। এরপর ট্রাক বা পিকাপে করে পরিতপ্ত জায়গায় নিয়ে বড় আকারের গর্ত করে সেই মৃত কুকুরগুলোকে মাটিচাপা দেয়া হতো। কিন্তু এখন আর তা চোখে পড়ে না, তাই দিন-দিন শহরের আনাচে-কানাচে কুকুরের উপদ্রব বেড়েই চলছে।

ছবিখানা গুগল থেকে সংগ্রহ করা।

অথচ প্রতিবছর ২৮ সেপ্টেম্বর বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস (ইংরেজি world Rabies Day) পালন করা হয়। জানা যায়, গ্লোবাল এলায়েন্স ফর রেবিজ কন্ট্রোল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের দপ্তর থেকে এই দিবসটি পরিচালনায় প্রধান সমন্বয়ের ভূমিকা পালন করে থাকে।

জানা যায়, "রেবিজ" বা "জলাতঙ্ক" হচ্ছে ভাইরাস গটিত একটি রোগ যা সাধারণত কুকুর, শেয়াল, বাদুড় প্রভৃতি উষ্ণ রক্তের প্রাণীদের মধ্যে দেখা যায়। এটি এক প্রাণী থেকে আরেক প্রাণীতে পরিবাহিত হতে পারে, তার লালা বা রক্তের দ্বারা।

বিশ্বের সকল দেশের প্রণীর মধ্যেই এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। প্রতিবছর বিশ্বে যত মানুষ কুকুরের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে মারা যায়, তার ৯৯% এই রোগের কারণে হয়।


বর্তমানে সারাদেশের কথা জানা না থাকলেও নারায়ণগঞ্জে এই জলাতঙ্ক রোগ বিস্তারের প্রধান প্রাণী কুকুরের উপদ্রব অনেক বেশি। শহরের পাড়া-মহল্লায়, রাস্তাঘাটে, যেখানে সেখানে কুকুর আর কুকুর। বছরের ভাদ্র-আশ্বিন-কার্তিক মাসে এদের বংশ বিস্তারের একটা নির্দিষ্ট সময়। অঘ্রানের শুরুতে দেখা যায়, একটা মা কুকুর ৮থেকে ১০/১২টা বাচ্চা প্রসব করে থাকে। এভাবে বংশবৃদ্ধির কারণে দেখা যায়, শহরের পাড়া-মহল্লা এই কুকুরে আয়ত্ত্বে চলে যায়। তখন এদের পেটের ক্ষুধা নিবারণের জন্য যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়ায় খাদ্যের সন্ধানে, পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্য না পেয়ে, ক্ষুধার জ্বালায় কোন কারণ ছাড়াই মানুষকে কামড় দেয়। তখন কামড়ানো কুকুরটি জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত না থাকলেও জলাতঙ্ক রোগের ভয়ে মানুষ হাসপাতাল বা ডাক্তারে শরণাপন্ন হয়।


বর্তমানে এই জলাতঙ্ক রোগটাকে মানুষ অত্যন্ত ভয় পায়, এই ভয়ে মানুষ ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়েও অনেক সময় ভাল হয় না। ডাক্তারের শরণাপন্ন হলেই প্রয়োজন হয় ভ্যাকসিন বা ১৪টি ইনজেকশনের, যা নাভিতে পুশ করা হয় এবং একদিন পরপর নিতে হয়। যারা এই জলাতঙ্ক রোগ প্রতিরোধক ভ্যাকসিন বা ইনজেকশন গ্রহণ করেছেন তাদের মুখে শোনা যায় যে, যখন এই ইনজেকশন নাভিতে পুশ করে, তখন মনে হয় মৃত্যু অনিবার্য, এত যন্ত্রণাদায়ক। তারপরেও আক্রান্তকারীর ভয় থেকেই যায়, শুধু ভাবতে থাকে আমি হয়তো রোগ মুক্ত হই নাই, এই ভয়েই মানুষ আরও বেশি রুগ্ন হয়ে পড়ে। আর যাদের টাকাপয়সা আছে, তারা ঠিকমতো চিকিৎসা নিয়ে হয়তো ভালো হয়। যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায় তাদের অবস্থা নির্ঘাত মৃত্যু।

গেল ক'দিন আগে নারায়ণগঞ্জ সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন গোদনাইল লক্ষীনারায়ণ বাজারে কোন কারণ ছাড়াই হটাৎ করে পেছন থেকে একটা কুকুর, এক ভদ্রলোককে কামড় দেয়। ভদ্রলোকেটি স্থানীয় মোঃ জসিমউদ্দিন, লক্ষীনারায়ণ কটন মিলস্ উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক অভিভাবক প্রতিনিধি সদস্য।

বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন উন্নয়নের ছোঁয়া প্রায় ঘরে ঘরে পৌঁছানো। কিন্তু এই জটিল বিষয়টিকে কেউ দেখেও দেখে না, ভেবেও ভাবে না। বছরের শুরুতে সেপ্টেম্বর মাস আসলেই সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তাদের মনে পড়ে বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবসটির কথা। ২৮ সেপ্টেম্বরে বহু উৎসাহ উদ্দীপনার মাধ্যমে এই দিবসটি পালন করা হয় ঠিক, কিন্তু এবিষয়ে কোন পদক্ষেপ নেয়া হয় না, তা শুধু কাগজে কলমেই থেকে যায়। যার ফলে বেওয়ারিস কুকুরের সংখ্যা দিন-দিন বাড়তেই থাকে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী দু-এক বছরের মধ্যে নারায়ণগঞ্জ শহরের মানুষ আর রাস্তায় বের হতে পারবে না, ঘরে বসেই থাকতে হবে দিনের পর দিন। সাধারণ মানুষের ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা বিশাল অট্টালিকার চার দেয়ালের বন্দিশালায় জীবন যাপন করতে হবে, সেই সময়টা আসন্ন।


বর্তমানে দেশের বিভিন্ন জেলাশহরে যে হারে কুকুর বাড়ছে, তাতে কুকুরের আক্রমণও বাড়ছে সমান তালে তাল মিলিয়ে। তারমধ্যে নারায়ণগঞ্জ শহর অন্যতম, নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন মোট ২৭টি ওয়ার্ড নিয়ে গটিত, এই ২৭টি ওয়ার্ডে বেওয়ারিস কুকুরের সংখ্যা কোন যান্ত্রিক গণনা মেশিনেও গুণে শেষ করা যাবে না। এমনিতেই একটা কুকুরের বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে, কুকুরের শরীরে কোন পশম থাকে না, মুখ দিয়ে গাড় লালা বের হয়, এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করে, মোট কথা যাকে বলে পাগলা কুকুর। এসব বেওয়ারিস জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত কুকুরের কামড় থেকে নারায়ণগঞ্জবাসীকে বাঁচাবে কে?


প্রিয় পাঠকবৃন্দ, লেখার শুরুতে লিখেছিলাম একটা মা কুকুর ৮থেকে ১০/১২টা বাচ্চা প্রসব করে। তার প্রমাণ ইতিমধ্যে ইউটিউবে একটা ভিডিও আপলোড করা হয়েছে। একটা কুকুর একটা নয়, দুইটা নয় ১২টা বাচ্চা প্রসব করেছে গেল ক'দিন আগে। এবার দেখুন, এভাবে যদি বেওয়ারিস কুকুরর সংখ্যা বাড়তেই থাকে, তবে কয়েক বছরের মধ্যে নারায়ণগঞ্জ শহরের অবস্থা কী হবে? কুকুরের কামড় থেকে বাঁচাবে কে? তাই অনতিবিলম্বে এই বেওয়ারিস কুকুর নিধনের জন্য একটা যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া জরুরী বলে মনে করি।