শীতলক্ষ্যা নদীর কুচকুচে কালো পানি

নিতাই বাবু
Published : 27 Jan 2017, 03:19 PM
Updated : 27 Jan 2017, 03:19 PM

একদিন আমার এক পরিচিত বন্ধুকে সাথে নিয়ে রওনা হলাম, আমার ছোটবেলার সেই প্রিয় প্রাইমারি স্কুলটি দেখতে। স্কুলটি শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্বপাড়ে লক্ষ্মণখোলা আদর্শ কটন মিলস্ সংলগ্ন। বন্ধুকে আগে কিছু জানাইনি কোথায় যাবো আমরা, হাঁটতে হাঁটতে গেলাম চিত্তরঞ্জন গুদারাঘাট নদীর ধারে। নদী পারাপারে নিয়োজিত গুদারা আসতে একটু দেরি হবে বিধায় ভাবলাম নদীর পাড়ে একটু ঘুরে দেখি। ঘুরে দেখতে গিয়েই আর নদীর ওপারে গিয়ে নিজের প্রিয় স্কুলটি আর দেখা হলো না সেদিন, শীতলক্ষ্যার তীরেই ঘুরে চলে এলাম দুজনে নিজেদের গন্তব্যে ৷

কেন ফিরে চলে এলাম?
গুদারা ট্রলার আসতে দেরি দেখে ভাবলাম, নদীর পাড় দিয়ে ওনেকদিন হাঁটি না, আজ একটু ঘুরে দেখি ৷ নদীর পাড় ঘেঁষে গড়ে ওঠা প্রাচীন চিত্তরঞ্জন কটন মিলস্‌ আর লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলের প্রাচীর, সেই প্রাচীরের নিচ দিয়েই হাঁটছি দুজনে। মনোরম সৌন্দর্যের বিকালটা ভালোই লাগছে, সাথে ছিল দুইজনের কাছে বর্তমান যুগের এন্ড্রয়েড মোবাইল ফোন, মোবাইলের হেডফোনো ছিলো দু'জনের কাছে। গান শুনছি আর হাঁটছি, দেখছি কোন একসময়ের খড়স্রোতা শীতলক্ষ্যা নদীর করুণ দৃশ্য, দেখছি সারিবদ্ধভাবে চলতে থাকা বালুবাহী ট্রলারগুলি।

কোত্থেকে আসে আবার কোথায় যায়, তাদের গন্তব্য অজানাই থেকে গেল অামার কাছে। গন্তব্য হয়তো নিকটে, নয়তো আরও একটু দূরে সুনির্দিষ্ট একটা স্থান তো আছেই ওদের। যেমন আছে চিত্তরঞ্জন গুদারাঘাট, আছে কাঁচপুর ব্রীজের নিচে। এমন আরো অসংখ্য স্থান আছে এই ট্রলার মালিকদের। তাদের কাছ থেকে এইসব বালু নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাররা পুকুর, ডোবা, খালবিল ভরাট করে রড-সিমেন্ট দিয়ে তৈরি করছে বড়বড় অট্টালিকা, ঘরবাড়ি। ওইসব অট্টালিকা আর ঘরবাড়ি বানিয়ে ভাড়া দিচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শহরে আসা মানুষের কাছে, যারা বিভিন্ন কর্মসংস্থানে চাকরি করে।

গুদারাঘাট থেকে দাঁড়িয়ে দেখছি বালুর ট্রলার কোথা থেকে আসে আবার কোথায় যে যার, এসবের আসা-যাওয়ার গন্তব্য থেকে যায় অজানা।

এসব ভাবতে ভাবতে নদীর পাড় দিয়ে দু'জনে হাঁটছি আর এদিক ওদিক তাকাচ্ছি, কোথাও কোন সবজি ক্ষেত চোখে পড়ছে না, চোখে পড়ছে শুধু শুকনো কচুরিপানা। আগে চোখে পড়তো নানারকম ধান ক্ষেত আর নানারকম সবজি ক্ষেতের বাহার, এখন যেন সবই স্মৃতি! এসব দেখে নিজের কাছে খারাপ লাগছে, তবু হাঁটছি আর মোবাইল থেকে গান শুনছি। গান বাজছে, আজ এই দিনটাকে মনের খাতায় লিখে রাখো। গানটি মনে হচ্ছে আমার মোবাইলে বাজছে না, মনে হচ্ছে এই শীতলক্ষ্যা নদীই গানটি গাইছে। কারণ এই শীতলক্ষ্যা নদীর সাথে কোন একসময় ছিল আমার মধুর সম্পর্ক সকাল আর দুপুরে। স্কুলে যাওয়ার আগে একবার ঝাঁপ দিয়ে পরতাম শীতলক্ষ্যার বুকে, আবার স্কুল থেকে এসে বিকালবেলায় ঝাঁপ দিতাম, সাঁতার দিয়ে পার হতাম এই খড়স্রোতা শীতলক্ষ্যা নদী। তাই শীতলক্ষ্যা নদীর সাথে সেই আগেকার মধুর সম্পর্কটা আমার এখনো রয়ে গেছে, একটু সময় পেলেই ঘুরে আসি শীতলক্ষ্যা নদীর পাড় থেকে।

https://www.youtube.com/watch?v=w7fQCVaDaTk


এখন ঘুরতে গেলেই কান্না আসে নদীর দূরারোগ্য অবস্থা দেখে, যেমন রুগ্ন তেমনি নীট গার্মেন্টস্‌ আর ডাইং এর বিষাক্ত কেমিক্যালের পানির মিশ্রণে শীতলক্ষ্যা যেন মৃত্যু যন্ত্রণায় ভুগছে। এই অবস্থায় সাঁতরানো তো দূরের কথা, পা ভেজাতেও খারাপ লাগে। কুচকুচে কালো পানি আর পশুমরা দুর্গন্ধ, আর সেই পানিই শোধন করে পান করতে হচ্ছে আমাদের, আমরা যারা শহরে বসবাস করি ৷ এই সূক্ষ্ম মৌসুমেই বেশি দুষিত হয়ে যায় শীতলক্ষ্ম্যার পানি, বর্ষা মৌসুমে আবার এতটা থাকেনা, তখন নদী  ভরা থাকে তাই ৷ শীত মৌসুমে নদীর পাড় দিয়ে হাঁটতে গেলেই নাকে রুমাল বা কাপড় চেপে ধরতে হয়, তবু যাই ঘুরতে শীতলক্ষ্যার ভালোবাসায়।


এভাবে ঘুরে হাঁটতে হাঁটতে নদীর পূর্বপাড়ে চোখ পড়ে গেল, আমার বসবাস করা সেই আদর্শ কটন মিলস্ আর সেই ভাসমান ডকইয়ার্ডের দিকে, তারপরেই আমার ছোটবেলার স্কুলটি। নদীর এপার থেকে ওপারে সব কিছুই এখন দেখা যায় সহজেই। কারণ, শীতলক্ষ্যা নদী তো আগের মতো প্রস্থ না, শুকিয়ে এক রুগ্ন খালে পরিণত হয়ে আছে বহু আগেই।

মনে পড়ে সেই আগের কথা, নদীর এপার থেকে কাউকে ডাক দিলে শুনা যেত না। আর এখন এপারে রেডিও বাজলেও ওপার থেকে শোনা যায়। এতেই বুঝা যায় যে এই শীতলক্ষ্যা নদী আজ কত প্রস্থতা হারিয়েছে, সেই দৃশ্য নিজ চোখে কেউ না দেখলে হয়তো আমার লেখা পড়ে বিশ্বাস করবে না। কেউ বিশ্বাস করুক আর নাই করুক, এই বিষয়ে আমি এই লেখায় তেমন কিছু লিখছি না, শুধু বর্তামে যা দেখা যায় তাই লিখলাম ৷

একটু পরেই সাথের বন্ধুর মত লোকটি বলল, বাবু চলুন নদীর ওপারে যাই, বললাম তা অবশ্য যাবো বন্ধু । আমিতো ওপারেই যাওয়ার উদ্দেশে রওনা হয়েছি তোমাকে নিয়ে, তা তোমাকে আগে জানাই নি, তুমি যদি যেতে রাজি না হও! তাই আগে তোমার কাছে আমি গন্তব্যটা গোপন রেখেছি ৷ সামনেই ছিল চিত্তরঞ্জন গুদারাঘাট, নদী পারাপার হতে জন প্রতি একটাকা জমা দিতে হয় ঘাটে, যা আগে দিয়ে আসা হয় নাই । তাড়াতাড়ি করে বন্ধুকে দিয়ে ঘাটের দুইটাকা পাঠালাম, টাকা দিয়ে গুদারার জন্য দাঁড়িয়ে আছি দুজনে। ওপার থেকে গুদারা আসতে একটু সময় লাগবে তাই দাঁড়িয়ে আছি গুদারার অপেক্ষায়। সামনেই দেখি ছোটছোট কয়েকটা শিশু ঠেলাজাল দিয়ে নদীর পঁচা পানিতে মাছ ধরছে।

দেখলাম এই শীতলক্ষ্যার পঁচা পানিতে এখনো মাছ আছে এই শীতলক্ষ্যাকে ভালোবেসে, যেমনটা ভালোবাসি আমি। মাছও এই শীতলক্ষ্যাকে ছেড়ে যেতে চায় না, শত আঘাতেও শীতলক্ষ্যাকে জাপটে ধরে আছে মরে-বেঁচে পঁচা পানিতে জমে থাকা বিষাক্ত শেওলা খেয়ে। আগে যখন আমরা আদর্শ কটনস্ মিলে থাকতাম, তখন স্কুলে যাওয়ার সঙ্গে এই ঠেলাজাল দিয়ে আনেক মাছ ধরেছি, সেই মাছ এখন আর নাই, যা আছে তা পানির রং এর মত কালো, পুটি আর খলিসার রং একই রকম।

মাছ ধরা দেখতে দেখতেই আর হাঁটতে হাঁটতে গেলাম একটু দূরে পানার কল সংলগ্ন ৷ এই পানির কল হলো সারা নারায়ণগঞ্জের পানি শোধনাগার, এই পানির কলের নিচে গেলাম দুজনে, দেখলাম যেখান থেকে পানি শোধনাগারে টেনে নেয় ৷ দেখলে নিজের মন বলে এই পানি আর পান করবো না ৷ এত কালো কুচকুচে পানি আর এত দুর্গন্ধ, যা শোধন করতেও পানি শোধনাগারের কর্মচারীরা হিমশিম খায় ৷ সময় সময় পানির সেই দুর্গন্ধ শোধন করা পানিতে থেকেই যায়, পান করার জন্য পানির গ্লাস মুখের সামনে নিতেই দুর্গন্ধে আর পান করার ইচ্ছা হয় না৷

এখান থেকেই ওয়াসা কর্তৃক পানির কল, পানি টেনে নিচ্ছে পানি শোধনাগারে, যা আমরা পান করছি নিরুপায় হয়ে ৷

সেখান থেকে ফিরে আসতেই দেখি গুদারা ঘাটে ভিড়েছে ৷ গুদারার যাত্রী নামার পর আমার বন্ধুটি আগে গিয়ে গুদারায় ওঠল ৷ আমি তখনো মন খারাপ করে আমার ছোটবেলার স্মৃতিচারণ নিয়ে ভাবছি ৷ ভাবছি ওখানে গেলে হয়তো আরো বেশি মন খাপ হয়ে যাবে, তার চেয়ে বরং ভালো হবে আজ আর নদীর ওপারে যাবোই না ৷ গুদারা থেকে আমার বন্ধু বলছে কী ব্যাপার দাদা বাবু আসেন! আমি বন্ধুকে বললাম গুদারা থেকে নামুন! আমি আজ যাবো না নদীর ওপারে ৷ সাথে সাথে আমার বন্ধুটি গুদারা থেকে নেমে আমাকে জিজ্ঞেস করলো কেন কী হয়েছে? সময় তো আরো আছে ঘুরে আসলেই তো ভালো হতো ৷ আজ আর নয় নদীর ওপারে, মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল, আজ এই শীতলক্ষ্ম্যার এপারে বেড়াই ৷ আরেকটু ঘুরে দেখি আমার প্রিয় শীতলক্ষ্ম্যাকে, যেই নদীতে একদিন স্নান না করলে হতো না, সেই শীতলক্ষ্ম্যাকেই একটু ভালো করে দেখে নেই ৷ এভাবে সেদিন সারা বিকাল শীতলক্ষ্ম্যা নদীর পশ্চিমপাড়েই ঘুরে বেড়ালাম দুজনে ৷