‘ভালোবাসা দিবসে’ সবার প্রতি রইল আমার প্রাণঢালা ভালোবাসা

নিতাই বাবু
Published : 15 Feb 2017, 02:11 AM
Updated : 15 Feb 2017, 02:11 AM

ভালোবাসা দিবস প্রসঙ্গে কিছু লিখতে হলে আগেই সেই প্রসঙ্গের ইতিহাস টানতে হয়। বিভিন্ন তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, এই ভালোবাসা দিবস যুগযুগ ধরে প্রচলিত। কিন্তু আমাদের দেশে এই ভালোবাসা দিবস উদযাপন করে আসছে তা বেশিদিন আগে থেকে নয়। যতটুকু জানি, আমাদের দেশে ১৯৯৩ সাল থেকে এই ভালোবাসা দিবসের আবির্ভাব ঘটে, যা ছিল কিছু সংখ্যক তরুণ-তরুণীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আর এখন এই ভালোবাসা দিবস ধনী-গরীব সহ সব শ্রেণির মানুষেই উদযাপন আর উপভোগ করে আসছে বছরের পর বছর।

জানা যায়, ২৬৯ সালে ইতালির রোম নগরীতে সেন্ট ভ্যালেইটাইন'স নামে একজন খৃষ্টান পাদ্রী ও চিকিৎসক ছিলেন। ধর্ম প্রচার-অভিযোগে তৎকালীন রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ক্রাডিয়াস তাঁকে বন্দী করেন। কারণ তখন রোমান সাম্রাজ্যে খৃষ্টান ধর্ম প্রচার নিষিদ্ধ ছিল। বন্দী অবস্থায় তিনি জনৈক কারারক্ষীর দৃষ্টিহীন মেয়েকে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে তোলেন। এতে সেন্ট ভ্যালেইটাইনের জনপ্রিয়তার প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে রাজা তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। সেই দিন ১৪ই ফেব্রুয়ারি ছিল। অতঃপর ৪৯৬ সালে পোপ সেন্ট জেলাসিউও ১ম জুলিয়াস ভ্যালেইটাইন'স স্মরণে ১৪ই ফেব্রুয়ারিকে ভ্যালেন্টাইন' দিবস ঘোষণা করেন। খৃষ্টানজগতে পাদ্রী-সাধু সন্তানদের স্মরণ ও কর্মের জন্য এ ধরনের অনেক দিবস রয়েছে।

যেমন: ২৩ এপ্রিল সেন্ট জজ ডে, ১১ নভেম্বর – সেন্ট মার্টিন ডে, ২৪ আগস্ট সেন্ট বার্থোলোমিজম ডে, ১ নভেম্বর আল সেইন্টম ডে, ৩০ নভেম্বর সেন্ট এন্ড্রু ডে, ১৭ মার্চ সেন্ট প্যাট্রিক ডে।

পাশ্চাত্যের ক্ষেত্রে জন্মদিনের উৎসব, ধর্মোৎসব সবক্ষেত্রেই ভোগের বিষয়টি মুখ্য। তাই গির্জা অভ্যন্তরেও মদ্যপানে তারা কসুর করে না। খৃস্টীয় এই ভ্যালেন্টাইন দিবসের চেতনা বিনষ্ট হওয়ায় ১৭৭৬ সালে ফ্রান্স সরকার কর্তৃক ভ্যালেইটাইন উৎসব নিষিদ্ধ করা হয়। ইংল্যান্ডে ক্ষমতাসীন পিউরিটানরাও একসময় প্রশাসনিকভাবে এ দিবস উদযাপন নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এছাড়া অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি ও জার্মানিতে বিভিন্ন সময়ে এ দিবস প্রত্যাখ্যাত হয়।

বর্তমানকালে, পাশ্চাত্যে এ উৎসব মহাসমারোহে উদযাপন করা হয়। যুক্তরাজ্যে মোট জনসংখ্যার অর্ধেক প্রায় ১০০ কোটি পাউন্ড ব্যয় করে এই ভালোবাসা দিবসের জন্য কার্ড, ফুল, চকোলেট, অন্যান্য উপহারসামগ্রী ও শুভেচ্ছা কার্ড ক্রয় করতে, এবং আনুমানিক প্রায় ২.৫ কোটি শুভেচ্ছা কার্ড আদান-প্রদান করা হয়। আমাদের দেশেও এর কমতি নেই, বিভিন্ন ছাপাখানায় গিয়ে দেখা যায় ফেব্রুয়ারির শুরুতেই তাদের ব্যস্ততা ভালোবাসা দিবসের শুভেচ্ছা কার্ড তৈরিতে।

প্রতি বছর ফাল্গুনের শুরুতে বসন্তের আগমনে যখন ভালোবাসা দিবসের ঘন্টা বাজে, ঠিক তখনই আমার মত কোটি মানুষের হৃদয়ে ভালোবাসার বাজনা বাজতে থাকে। ফাল্গুনে যেমন সবুজ ঘেরা পৃথিবীর বৃক্ষগুলো নতুন সাজে সাজতে থাকে, কৃষ্ণচূড়া যখন আমাদের চারদিক সাজিয়ে রাখে ফুলে-ফুলে, তখনই ভালোবাসা দিবসে আমাদের ভালোবাসা আর ভালোলাগার মানুষগুলোকে বেশি মনে করিয়ে দেয়। বসন্তে কোকিল যেমন ভালোবার টানে মনের আনন্দে কুহুকুহু ডাকে, আমরাও আমাদের ভালোবাসার মানুষকে কাছে ডাকি। দিবসটি আসে বছরে একবার, কিন্তু আমাদের হৃদয়ের ভালোবাসা থাকে ৩৬৫ দিনের বছরের প্রতিদিন।

মানুষের ভালোবাসা কি মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ? স্রষ্টার সৃষ্টির সব কিছুর মাঝেই মানুষের ভালোবাসা জড়িয়ে আছে। যেমন, আমি নিশ্বাসকে ভালোবাসি বলেই এই পৃথিবীতে বেঁচে আছি, আমি খাদ্যকে ভালোবাসি বলেই খাদ্যকে গ্রহণ করছি। আমি আমার শরীরটাকে ভালোবাসি বলেই শরীরের প্রতি এত যত্নবান হয়ে উঠি, শরীরটাকে ভালো না বাসলে তো যেতে হয় ডাক্তারের কাছে। আমি আমার শহরটাকে ভালোবাসি বলেই শহরের সমস্যা নিয়ে লেখি, দেশকে ভালোবাসি বলেই পৃথিবীর যেখানেই যত আরামেই থাকি, তবু ভালোবাসার টানে দেশেই আসতে মন চায়।

আমি আমার সংসারকে ভালোবাসি বলেই সংসার করছি, সন্তানকে ভালোবাসি বলেই সন্তান আমাকে ভালোবাসে। সব মিলিয়ে আমার ভালোবাসা পৃথিবীর সব কিছুর মাঝে, স্রষ্টার পৃথিবীর সব কিছুকেই ভালোবাসি। পৃথিবীকে ভালোবাসি বলেই সহজে মরতে চাই না, শত দুঃখ-কষ্ট সহ্য করেও এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে মন চায়।

তাই কবিগুরু রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিতায় তার নিজের মনোভাব প্রকাশ করে লিখেছেন,

মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে,
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।
এই সূর্যকরে এই পুষ্পিত কাননে,
জীবন্ত হৃদয়-মাঝে যদি স্থান পাই।
ধরায় প্রাণের খেলা চিরতরঙ্গ
বিরহ মিলন কত হাসি-অশ্রুময়,
মানবের সুখে -দুঃখে গাঁথিয়া সংগীত
যদি গো রচিতে পারি অমর-আলয়।
তা যদি না পারি তবে বাঁচি যতকাল
তোমাদেরি মাঝখানে লভি যেন ঠাঁই,
তমরা তুলিবে বলে সকাল বিকআল
নব নব সংগীতের কুসুম ফুটাই।
হাসিমুখে নিয়ে ফুল, তার পরে হায়
ফেলে দিয়ে ফুলে, যদি সে ফুল শুকায়।

তাই বেঁচে থাকতে চাই হৃদয়ে ভালোবাসা নিয়ে এই পৃথিবীর মানুষের মাঝে, ভালোবাসা পেতে চাই, ভালোবাসা দিতে চাই।

১৪ ফেব্রুয়ারি সেই ভালোবাসা দিবস, সারা দুনিয়ার মানুষের মত আমাদের দেশের মানুষেরাও বহু উৎসাহ উদ্দীপনায় এই ভালোবাসা দিবসটি উদযাপন করছে। ১৩ ফ্রেব্রুয়ারি দুপুর থেকেই দেখা যায়, শহরের আনাচে-কানাচে, হাটবাজারে, মার্কেটের সামনে ফুলের দোকান সাজিয়ে বসেছে ফুল বিক্রেতারা। যুবক-যুবতীরা আগে থেকেই তাদের পছন্দমত ফুল কিনে নিচ্ছে, হরেকরকমের ফুল। কেউ তার ভালোবাসার মানুষকে উপহার দিতে কিনছে বিভিন্ন সামগ্রী। ঈদের চাঁনরাতে যেই দৃশ্য চোখে পড়ে, সেই দৃশ্য যেমন আজ দেখা গেল, দেখে মনে হয় ১৪ ফেব্রুয়ারি যেন ঈদ বা কোনো পূজা-পার্বণের আনন্দে মেতে উঠছে, তাই দোকানগুলোতেও ছিল উপচেপড়া ভীড়।

শুধু ফুলের দোকান আর নিত্য-সামগ্রী দোকানেই ভীড় ছিলো না, ভীর ছিলো মাছ-মাংসের দোকানগুলোতেও। ভালোবাসার মানুষগুলো যেন এই দিনটির আশায় ছিলো এতদিন, তাইতো দেখা গেলো সবার এত ব্যস্ততা। আবার আসবে এই দিনটি আগামী বছর ২০১৮ সালের ১৪ ফ্রেব্রুয়ারি, আবার মেতে উঠবো আমরা ভালোবাসার আনন্দে, ডাকবো কুহুকণ্ঠে ভালোবাসার মানুষগুলোকে। আমিও প্রার্থনা করি বেঁচে থেকে যেন আগামী দিনের ভালোবাসা দিবসটি উপভোগ করতে পারি, নিজের মনের মানুষটির সাথে পৃথিবীর সবাইকে যেন ভালোবাসতে পারি।

এই ভালোবাসা দিবসে সবার প্রতি রইল আমার প্রাণঢালা ভালোবাসা, শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। প্রতিদিন উদযাপিত হোক এই ভালোবাসা দিবস।

তথ্য সংগ্রহ: উইকিপিডিয়া