নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে সর্বস্তরের মানুষের ঢল

নিতাই বাবু
Published : 21 Feb 2017, 09:37 AM
Updated : 21 Feb 2017, 09:37 AM

ছবি আজ সকালে গোদনাইল পানিরকল সংলগ্ন বাংলাদেশ সমবায় শিল্প সংস্থা (সীঃ) থেকে তোলা।

আজ মহান একুশে ফেব্রুয়ারি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। সারা দুনিয়ার মানুষ আজ আমার ভাইদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত মাতৃভাষা দিবসটি পালন করে করছে, স্মরণ করছে আমাদের গৌরবোজ্জ্বল এই দিনটিকে। মায়ের ভাষা রক্ষা করার জন্য আমাদের দেশের সন্তানরা যখন তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু কারে তখন আমার জন্মও হয়নি। আমার জন্ম ১৯৬৩ সালের জুলাই মাসে, তবু মা-বাবার মুখে শোনা ও বিভিন্ন তথ্য মতে এই দিনটির কথা কিছুটা হলেও লেখার শুরুতে লিখতে হয়। তাই আজকের এই দিনে আমাদের এই গৌরবোজ্জ্বল দিনটির কিছু কথা আর আমাদের এলাকার কিছু খবর নিয়ে আমার আজকের এই পোস্টখানা।

ছবি: গোদনাইল চিত্তরঞ্জন কটন মিলস্ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে।

শুনেছিলাম ১৯৫২ সালের এই দিনে মাতৃভাষা রক্ষার জন্য যারা রাজপথে জীবন দিয়েছিল সেসব ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারিকে আমরা স্মরণ করে আসছি। ২১ ফেব্রুয়ারি আমাদের জন্য একটি গৌরবোজ্জ্বল দিন, যা পৃথিবীর আর কোন দেশে এমন একটি দিনের ইতিহাস নেই, যা কিনা মায়ের ভাষা রক্ষা করার জন্য রাজপথে জীবন দিয়ে এমন একটি ইতিহাস রচনা করতে পেরেছে। পৃথিবীতে এটি একটি বিরল ঘটনা, যা আমাদের এই মহান আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস একুশে ফেব্রুয়ারি।

ছবি: গোদনাইল মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড অফিস, ছবিতে লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলস উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অভিভাবক প্রতিনিধিবৃন্দ।

জানা যায় ১৯৫২ সালের এইদিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৪৪ ধারা অমান্য করে রাজপথে বেরিয়ে এলে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের পুলিশ বাহিনী ছাত্রদের ওপর গুলি চালায়। এতে বরকত, সালাম, জাব্বার সহ কয়েকজন ছাত্র হতাহত হন। এ ঘটনার প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ ঢাকাবাসী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে সমাবেত হয়।

লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলস্ উচ্চ বিদ্যালয়ের শহীদমিনারে ফুল দিয়ে স্মরণ করছে ভাষা শহীদদের।

নানা নির্যাতন সত্ত্বেও ছাত্রদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও প্রতিবাদ জানাতে পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি পুনরায় রাজপথে নেমে আসে। তারা শহীদদের জন্য অনুষ্ঠিত গায়েবি জানাজায় অংগ্রহণ করে, তারা ভাষা শহীদদের স্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্য ২৩ ফেব্রুয়ারি এক রাতের মধ্যে মেডিকেল কলেজে হোস্টেল প্রাঙ্গণে গড়ে তুলে একটি স্মৃতিস্তম্ভ; যা তৎকালীন সরকার ২৬ ফেব্রুয়ারি গুঁড়িয়ে দেয়। সেই থেকে ভাষা আন্দোলন আরও বেগবান হয়। ১৯৫৪ সালে প্রদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করলে ৯মে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তখন থেকে প্রতিবছর এই দিনটি জাতীয় 'শোক দিবস' হিসেবে উদযাপিত হয়ে আসছে।

আমাদের মাতৃভাষা উচ্চারণের বর্ণগুলো গাছের ঢালে ফুলে-ফুলে। ছবি গোদনাইল লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলস উচ্চ বিদ্যালয় থেকে।

আমরা জানি, ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসঙ্ঘের সদস্য দেশসমূহে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে। ২০১০ সালের ২১ অক্টোবর বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে ঘোষণা দেয় এখন থেকে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করবে জাতিসংঘ।

ভাষা শহীদদের ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে আসা লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলস উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে।

সেই থেকে সালাম, বরকত, জাব্বারদের রক্তের বিনিময়ে আমাদের এই একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসটি প্রতিবছর পালিত হয়ে আসছে। শুধু আমরাই নয়, সারা দুনিয়ার সারাদেশে যথাযথ মর্যাদায় ফেব্রুয়ারি মাসের ২১ তারিখে এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করে আসছে।

শহীদমিনারে ফুল দিতে স্কুল পড়ুয়া ছোট শিশুরা, অনুমতির জন্য অপেক্ষা।

আজ সেই মহান একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। সারাদেশের মতো আমাদের নারায়ণগঞ্জ গোদনাইলেও যথাযথ মর্যাদায় দিনটিকে স্মরণ করছে, উদযাপন করছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস- একুশে ফেব্রুয়ারি। নারায়ণগঞ্জ সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন গোদনাইলের সবকটি স্কুলের শহীদমিনার ছেয়ে গেছে ফুলে-ফুলে। গতকাল থেকেই স্কুল পড়ুয়া ছেলে-মেয়েরা ভাষা শহীদদের স্মরণ করে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য বাজার থেকে যার-যার পছন্দমতো ফুল কিনে নেয়। বাজার ঘুরে দেখা যায়, বড়দের সাথে তাল মিলিয়ে ছোট ছেলে-মেয়েরাও ফুল কিনছে সমান তালে।

ছবি গোদনাইল মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড অফিস

আগে আমরা একুশে ফেব্রুয়ারির আগের দিন সারারাত জেগে ফুল চুরি করতাম একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদমিনারে দেওয়ার জন্য, ওইসময় এখনকার মতো হাট-বাজারেও ফুল বিক্রি হতো না। তখন দেখতাম শুধু স্কুল পড়ুয়া ছেলে-মেয়েরাই একটু ব্যস্ত থাকতো একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে, এখন ছেলে বুড়ো, ধনী-গরীব সবাই শহীদমিনারে ফুল দিয়ে স্মরণ করে ভাষা শহীদদের। তাদের স্মরণে ফুল দেয় শহীদ মিনারে, এটাও আমাদের জন্য একটা গৌরবের ব্যাপার।

ভাষা শহীদদের স্মরণে লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলস এর ছাত্রছাত্রী সহ শিক্ষক ও অভিভাবক প্রতিনিধিদের শোভাযাত্রা। ছবিটি গোদনাইল লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলস এলাকা থেকে তোলা।

তারই ধারাবাহিকতায় আমাদের গোদনাইলে কোনোকোনো জায়গায় একুশের প্রথম প্রহরে শহীদমিনারে ফুল দেয়া আরম্ব করে। রাতভোর না হতেই শহীদমিনারগুলো কানায় কানায় ভরে যায় ফুলেফুলে। স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা ভোরবেলা থেকে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শোভাযাত্রা বের করে, আবার একেক স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা ব্যানার ফেস্টুন হাতে নিয়ে সারিবদ্ধভাবে দলেদলে নীরবে খলিপায়ে হাটতেও দেখা যায়। একেক দলের একেক রং এর স্কুলের পোশাক থাকে, তাদের কন্ঠে থাকে একুশের গান, হাঁটছে আর একুশের গান গাইছে। কোনকোন জায়গায় বড়বড় সাউন্ড বক্সে আর মাইকে একুশের কালজয়ী চিরস্মরণীয় গানটি রাত থাকতেই বাজতে থাকে। নিম্নে অমর একুশের কালজয়ী গানটি লিখে দিলাম মহান একুশের ভাষা শহীদদের স্মরণে।

গোদনাইল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে শহীদমিনার।

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি।
ছেলে হারা শত মায়ের অশ্রু গড়া এ ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি।
আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি।
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি।।

ছবি লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলস্ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে

আজকে নারায়ণগঞ্জ গোদনাইল এলাকার একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের কিছু চিত্র নিম্নে দেওয়া হলো-


পরিশেষে আমাদের মায়ের ভাষা রক্ষা করতে গিয়ে যেসব মায়ের সন্তানেরা আত্মত্যাগ করেছে, যাদের রক্তের বিনিময়ে এই গৌরবোজ্জ্বল একুশে ফেব্রুয়ারির সূচনা হয়েছে, তাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে শেষ করলাম আজকের এই পোস্টের লেখনি। অমর একুশে অমর হোক যুগে যুগে, স্মরণীয় হয়ে জেগে থাকুক বিশ্বের সব মানুষের অন্তরে। শান্তি পাক ভাষা শহীদ বরকত, সালাম, জব্বার সহ সকল ভাষা শহীদের আত্মা।