আমরা বস্ত্র শিল্পের কারিকর তাঁতি, আমরা মানুষের লজ্জা নিবারণের জন্য কাপড় তৈরি করি

নিতাই বাবু
Published : 27 Feb 2017, 03:05 PM
Updated : 27 Feb 2017, 03:05 PM

আমরা বস্ত্র শিল্পের কারিকর, আমরা তাঁতি। দেশের অন্যান্য শিল্প শ্রমিকদের চেয়ে আমরা ছিলাম সবদিক থেকে বঞ্চিত, লোকের চোখেও ছিলাম ঘৃণিত আর অবহেলিত । আমরা তাঁতিরা চিলাম দেশের অভাবগ্রস্ত মানুষের মধ্যে অন্যতম। তবু আমাদের দুঃখ নেই, আমরা গর্বিত আমরা আনন্দিত দেশের সব মানুষের লজ্জা নিবারণের জন্য একটুকরো কাপড় তৈরি করতে পেরে। আমাদের কর্মজীবনের দুঃখসুখের বর্ণনা দিতে গেলে আগে দিতে হয় এই মহান তাঁত শিল্পের বর্ণনা, আর তুলে ধরতে হয় তাঁতিদের কথা।

ছোটবেলায় দেখতাম আমাদের গ্রামের একটা পাড়ায় একসাথে কয়েকটা বাড়ি ছিল, পাড়ার নাম ছিল জুগিপাড়া, কেউ বলতো জুগিবাড়ি। জুগি হলো আমাদের হিন্দুধর্মের একটা জাত বা সম্প্রদায়, তাদের নামের আগে টাইটেল বসাতো দেবনাথ। জুগি সম্প্রদায়ের কাজ ছিল বস্ত্র তৈরি করা, তাঁরা যেই মেশিন বা কল দিয়ে কাপড় তৈরি করতো সেটাকে বলা হতো তাঁত । যারা তাঁত চালিয়ে কাপড় উৎপাদন করতো, তাদের বালা হতো তাঁতি বা জুগি বা ঝোলা বা কারিকর । কোন-কোন জায়গায় এসব তাঁতিদের ভিন্নভিন্ন নামেও ডাকা হতো, এখনো তাঁতিদের একএক জায়গায় একএক নামে ডাকা হয় অঞ্চল ভেদে । কোন জায়গায় তাঁতি, কোন জায়গায় ঝোলা, কোন জায়গায় কারিকর নামেও ডেকে থাকে এই বস্ত্র তৈরি করার জাদুকর তাঁতিদের । তাঁত শিল্প বা বস্ত্র শিল্প নিয়ে কিছু লিখতে হলে তার আগে সেই শিল্পের জন্মকথা বা ইতিহাস তুলে ধরতে হয় ।

এই সেই তাঁত, যেই তাঁত মেশিন দিয়ে দেশের মানুষের লজ্জা নিবারণের কাপড় তৈরি করা হয়।

এই তাঁত শিল্প বা বস্ত্র শিল্পের জন্মলগ্ন আমার জানা না থাকলেও আমি খুব অল্প বয়স থেকেই এই শিল্পের সাথে জরিত, আর আমার বাবা, কাকা, জেঠা, বড়দা সবাই এই তাঁত শিল্প বা বস্ত্র শিল্পের সাথে আমার জন্মের বহু আগে থেকেই সম্পৃক্ত ছিলেন । আমাদের সংসার চলতো এই শিল্প থেকে শ্রমের বিনিময়ে উপার্জিত অর্থ দিয়ে, যার কারণে আমি বড় হয়ে নিজেও এই শিল্পের সাথে জরিয়ে যাই বংশগত ভাবে । তাই আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই এই তাঁত বা তাঁতি নিয়ে কিছু লিখতে চাই, কারণ আমি নিজেও একসময় একজন তাঁতি বা বস্ত্র তৈরির কারিকর ছিলাম ।
তাঁত (weaving) হচ্ছে এক ধরণের যন্ত্র বা মেশিন, যা দিয়ে তুলা (cotton) হতে উৎপন্ন সূতা (yarn) থেকে কাপড় (cloth) বানানোর মেশিন । তাঁত বিভিন্ন রকমের হতে পারে বা দেখাও যায়, খুব ছোট ছোট তাঁতও আছে আমাদের দেশে, যা দিয়ে দেশিয় গামছা তৈরি করা হয় । এসব তাঁত আমাদের দেশের বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন নামে পরিচিত, তাহলো জাপানি কল, পিট লুম, টেপ লুম, ঠকঠকি, hand loom. (হাত তাঁত)। এসব কল বা মেশিনগুলি হাতে চালানো হয় ।
(এসব হাত-তাঁত দিয়েই কোন একসময় তৈরি হতো ঢাকার মসলিন, কুমিল্লার খাদি সহ দেশের নামীদামী কাতান, জামদানি, টাঙ্গাইল শাড়ী। এসব খ্যাতনামা কাপড়ের মধ্যে বহু আগেই বিলুপ্ত হয়ে যায় ঢাকার মসলিন কাপড়, বর্তমানে কাতান জামদানি ও কুমিল্লার খাদি কাপড়ও প্রায় বিলিপ্ত হতে বসেছে )

এরপর যুগের সেথে তাল মিলিয়ে কাপড় উৎপাদন বৃদ্ধি করতে বৈদ্যুতিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করা হয় পাওয়ার লুম (power loom machine) যা বিদ্যুতের সাহায্যে চলে । এই পাওয়ার লুমের মধ্যেও বর্তমানে বহু প্রকার কাপড় তৈরি করার মেশিন আছে, যেগুলি বিদেশিদের দেখাদেখি আমাদের দেশে তৈরি করে তার নাম দেয়া হয় বাংলা মেশিন বা বাংলা লুম । আর যেগুলি সরাসরি বিদেশ থেকে আসে সেগুলি বিভিন্ন নামে পরিচিত, চায়না লুম, জাপানি পাওয়ার লিম, কুরিয়ান লুম, সুইজারলেন্ডি লুম, যেই দেশের মাশিন সেই দেশের নামটা মেশিনের আগে ব্যবহার করা হয় ।

স্থানীয় একটি মিলের weaving department ( তাঁত ঘর) সারিবদ্ধভাবে বসানো তাঁত।

তারপরও আরো আছে রিপিয়ার মেশিন, যেই মেশিন সূতার নলি সংযুক্ত (মাকু ছাড়াই চলতে সক্ষম । আছে সেরোয়ার ফাইভ হান্ড্রেড, এই মেশিনটা রিপিয়ার মেশিনের মত, প্রতি মিনিটে পাঁচ'শ' বার বাইনের (বুনন) সূতা জুড়তে সক্ষম বিধায় এর নাম রাখা হয় সেরোয়ার ফাইভ হান্ড্রেড । আছে সোলজার মেশিন, এগুলি সবই রিপিয়ার (repair machine) পরিবারের বংশধর, চলে নলি আর মাকু ছাড়া । আরও আছে এয়ার জেট, ওয়াটার জেট মাশিন, এয়ার জেট মেশিন সূতার নলি (bobbin winder) মাকুর (seattle) পরিবর্তে বাতাস দ্বারা মাকুর কাজ করে বিধায় তার নাম এয়ার জেট । আর ওয়াটার জেট মেশিন হলো সূতার নলি মাকুর পরিবর্তে পানির সাহায্যে মাকুর কাজ করা হয় বিধায় তার নাম রাখা হয় ওয়াটার জেট ।
যেই বস্তুটাকে কাজে লাগানোর জন্য এসব মেশিনের আবিস্কার তা হল তুলা, তুলা থাকেই হয় সূতা, সূতা দিয়ে তৈরি করা হয় কাপড় । কাপড় ছাড়া এই সুন্দর পৃথিবীর কোন মানুষের লজ্জা নিবারণ হয় না, সে হোক কোনো রাজা বাদশা, হোক না কোন দেশের প্রধানমন্ত্রী, হোক কোন রাষ্ট প্রধান । লজ্জা নিবারণের জন্য সবার এক টুকরো কাপড় লাগবেই লাগবে । সেই কাপড় তৈরির মেশিন তাঁত (loom) আর কারিকর হলো তাঁতি (weaver)।

নলি মেশিন perwinder এই মেশিন দিয়ে নলিতে সূতা পেঁচানো হয়, তারপর এই নলি মাকুর সাথে লাগিয়ে দিয়ে তাঁত মেশিনের Seattle box এ দিয়ে মেশিন চালু দিলেই কাপড় তৈরি শুরু হয়ে যায়।

আমার ধারণা, পৃথিবীতে কাপড়ের আবিষ্কার;(cloth inventory) হয়েছিলো শীত থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য । কারন; আদি যুগে লজ্জা কোন বিষয় ছিলো না, আমার মনে হয় তখন লজ্জা কাকে বলে তখনকার দিনের মানুষ তা বুঝত না । তখন তাঁরা সবসময় থাকত ক্ষুধা নিবারণের জন্য হতাশ, আর ভয়ে থাকত দৌড়ের উপর । যেখানে ঝড়-তুফান আর প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবিলা করতে হতো তাদের দিন-রাত চব্বিশ ঘন্টা, যেখানে-সেখানে ওত পেতে থাকত বনের জীব জন্তু । সেখানে এই লজ্জা জিনিসটার নামই তখন ছিল না, আর লজ্জা কী? সেটা তখনকার মানুষ তা বুঝতোও না। তারা শুধু বুঝতো বাঁচতে হলে ক্ষুধা নিবারণ করতে হবে, আর ক্ষুধা নিবারণ করতে হলে লড়াই করতে হবে। তাই তাঁরা জীবনধারনের জন্য ছুটে বেড়াতো শুধু খাদ্যের সন্ধানে, সারাদিন পশুপাখি শিকার করে খেতো, রাতে বনের হিংস্র প্রাণীদের আক্রমন হতে নিজেকে বাঁচানোর জন্য গাছের উচু জায়গায় বা কোন পাহাড়ের গুহায় আত্মরক্ষা করে থাকতো।

টানা বা ভীম, veeam সারিবদ্ধভাবে কয়েক হাজার সূতা মাড় করে মোড়ানো, এই ভীমার সূতা থেকেই তৈরি হয় কাপড়। এই কাজটা যারা করে থাকে তাদের বলে ড্রয়ার ম্যান বা রিচিং ম্যান বা 'ব' গাথা

মনে হয় তখন তাদের লজ্জা কোন প্রয়োজনীয় বিষয় ছিল না, যা এখনো দেখা যায় ব্রাজিলের আমাজন রেইন ফরেষ্টের কিছু ভিডিও দেখলে । আদিযুগের মানুষের ছিল শুধু খাদ্যের আর রাতযাপনের চিন্তা । খাদ্য যাই পেতো তাই খেতো, কিন্তু শীতের হাত থেকে বাঁচার প্রয়োজনে তখন তাঁরা গাছের ছাল বা পশুর চামড়া ব্যবহার করে জীবনধারণ করতো । এভাবে চলতে চলতে মানুষ শীত থেকে বাঁচার উপায় খুঁজে বের করে ফেলল। তা ছিল গাছের তুলা থেকে বহু কষ্টে সূতা তৈরি করে সেই তূলা থেকে একদিন সূতার আবিস্কার করে ফেলল । সেই সূতা থেকেই তৈরি করা শুরু করে দেয় হাতে বুনা কাপড় ।

তাঁতের মাকু Seattle এই সেই মাকু, এই মাকু তাঁতের সূতের ভেতর দিয়ে আসাযাওয়ার ফলে কাপড়ের বাইন (বুনন) হয়ে কাপড় তৈরি হয়। ছবি গুগল থেকে সংগ্রহ করা।

সেই আদি যুগের মানুষ যখন ধীরে-ধীরে সভ্য জগতে পা রখতে শুরু করল, তখন তাদের কাপড় তৈরি করাও উন্নতির দিকে অগ্রসর হতে লাগল । গাছের তুলা সংগ্রহ করে সেই তুলার আঁশ হতে হাতে পাঁক দিয়ে সূতা তৈরি করতো, সেই সূতা এক থেকে দেড় হাজার সূতা (বা তারও কমবেশি) সারিবদ্ধ ভাবে একসাথ করে ২০গজ বা তারও বেশি লম্বা একটা বড় রুলার (ঘুড়ি উড়ানোর নাটাই এর মতো) তৈরি করতো । (বর্তমানে সেই রুলার কোনকোন জায়গায় টানা বা ভীম (veeam) বলে পরিচিত) সেই টানা বা ভীমের মোট সূতাগুলিকে আলাদা আলাদা করে ১০/১১/১২/বা ১৩ ইঞ্চি লম্বা (rings) 'ব' বা 'বয়া'মাঝখানে সুইয়ের ছিদ্রের মতো থাকে এমন, সেই ছিদ্রযুক্ত জায়গা দিয়ে একটা একটা করে সূতা ভরে সাজানো হয়, এই কাজটাকে বলে 'ব'গাঁথা বা ড্রয়ার বা রিচিং করা, কোনকোন জায়গায় এই কাজটাকে হানা 'ব' বলা হয় (নরসিংদী আর পাবনায়) ।

ভীম! ভীমের সারিবদ্ধ হাজার হাজার সূতাগুলি একএক করে 'ব' এবং শানার ভেতরে ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে তাঁতে নেওয়ার জন্য।

এই বয়াগুলো দুইভাগে বিভক্ত বা ১০/১২ ভাগে বা তারও বেশি ভাগে বভক্ত থাকে বা থাকতে পারে (কাপড়ের ডিজাইনের ওপর নির্ভর করে) । এই সারিবদ্ধ বয়াকে বলে ঝাপ বা (ring frame) বয়ের ফ্রেম। এই 'ব' বা বয়ার ভিতর দিয়ে সূতাগুলো শানা বা হানা বা রিড, এই রিড বা শানায় সমান ভাগে ভাগ করে শানার (reide) ভিতরে ঢুকায় । এই রিড বা শানা বা হানা ঘন-পাতলা আছে, ১০ কাউন্ট হতে শুরু করে ২৫০ কাউন্টের শানাও আছে । যত বেশি কাউন্টের শানা বা রিড, তত তার শলা বা ঘর । যদি ৫০ কাউন্টের শানা বা রিড হয়, তবে প্রতি ইঞ্চিতে শানার ঘর বা ফাঁক বা শলা থাকবে ৫০ এর অর্ধেক ২৫ ঘর বা ২৫ শলা। একএক ঘরে দুই সূতা করে হলে প্রতি ইঞ্চিতে সূতা থাকবে ১০০ সূতা, ৫০ ইঞ্চি কাপড়ের জন্য সূতার প্রয়োজন হবে ৫০০০ হাজার সূতা, আর 'ব' বা বয়াও থাকবে ৫০০০ হাজার বয়া । যখন তাঁত চালূ দেয় বা চালায় তখন এই 'ব' বা বয়ার ঝাপ বা ফ্রেম ওপর-নীচ হয়ে দুইভাগে ভাগ হয়ে ওঠা-নামা করতে থাকে। তখন ভীমের সূতাগুলিকে মাঝখানে সুরুঙ্গ বা ফাঁক করে দেয়, সূতার এই ফাঁক দিয়ে তখন আলাদা একটা সূতার নলি সহ মাকু ওই ফাঁক হওয়া সুরুঙ্গ দিয়ে আসাযাওয়া করতে থাকে। আর শানা বা রিড ওই সূতাগুলো চাপ দিয়ে একসাথ করে দেয় (বুনন) তখনই তৈরি হয়ে যায় কাপড় ।

কোনোকোনো কাপড়ের গায়ে বহুরকমের নকশি বা ডিজাইন দেখা যায়, সেই নকশি বা ডিজাইন করা হয় জাপানি জ্যাকেট বা ডবির সাহায্যে। ডবি বা জ্যাকেট বহুরকমের হয়ে থাকে, যা দিয়ে তৈরি করে জামদানি বা টাঙ্গাইল শাড়ী বা পর্দার কাপড়। সময়সময় জামা পেন্ট তোয়ালে গেঞ্জির টিকেট ও মকলম কাপড় তৈরি করতেও ডবি বা জ্যাকেটের প্রয়োজন হয় । জ্যাকেট বা ডবি হল একটা ছোট মেশিনের মতো, যা তাঁত বা পাওয়ার লুমের উপরে সেটিং করা থাকে । ২৪ লিভারের ডবিও আছে, লিভার হল যা দিয়ে সূতার ঝাপগুলি টেনেটেনে ওঠা-নামা করায়, তাকেই বলে ডবি বা জ্যাকেট ।কোনো ডিজাইনের শাড়ি কাপড় তৈরি কতে হলে জ্যাকেট ছাড়া কিছিতেই সম্ভব নয় ।

সবশেষে কাপড় তৈরি হয়ে বাজারে নেওয়ার জন্য এখানে কাপড় মেপে থান করা হচ্ছে। এই কাজটাকে বলা হয় ফোল্ডিং।

আমরা যখন আদর্শ কটন মিলে থাকতাম, তখন মিলের ভিতরে গিয়ে দেখতাম আমার বড়দাদা বসে-বসে বয়ের ভিতরে সূতা ঢুকাচ্ছে একজন হেলপার সাথে নিয়ে । আমিও শখ করে হেলপারের জায়গায় বসে আমার বড়দাদার সাথে সূতা গাঁথতাম, সেই থেকে আমার কাপড়ের মিলে বা টেক্সটাইল মিলে তাঁতের কাজ শিখা । সেসব বড়-বড় মিলে কাপড় তৈরির সব মেশিনপত্র থাকতো, তুলা থেকে সূতা, সূতা থেকে কাপড় তারপর কাপড়ে রং করে পরে বাজারে বা বিদেশে রপ্তানি কারা পর্যন্ত । সেসব মিলে তুলা আসতো নৌকায় বা বাইরোডে, প্রথমে তুলা যেত ব্লু রুমে । ব্লু রুমে তুলাকে সূতা বানানোর উপযোগী করে চলে আসতো স্প্রিং ডিপার্টমেন্টে, স্প্রিং এ তৈরি হতো সূতা, সূতা হয়ে চলে যেত (warping) ওয়ারপিং এ । সেখান থেকে ভীম হয়ে চলে যেত সাইজিং (সূতা মাড় করার মেশিন) থেকে সূতা মাড় হয়ে বা ভীম হয়ে আসে তাঁতে,তাঁত থেকে কারিকর বা তাঁতিরা তৈরি করতো কাপড় , সেই কাপড় আবার রং কারার জন্য চলে যেত ডাইং-এ, ডাইং থেকে কাপড় রং হয়ে চলে যেত হাটবাজারে বা বিদেশে । ( সেসব বড় বড় বস্ত্র শিল্পের টেক্সটাইল মিলগুলি এখন আর নাই, বিলুপ্তি হয়ে গেছে বহু আগে। আমাদের শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়েও ছিল অনেকগুলি মিল, এখন সবই স্মৃতি )।

কিছুদিন আগে আমাদের নারায়ণগঞ্জের ফতল্লায় একটা প্রাইভেট টেক্সটাইল মিলে গিয়েছিলাম একজন পরিচিত তাঁতির সাথে দেখা করতে, গিয়ে দেখি সেখানে আমার পরিচিত অনেক তাঁতিরা কাজ করছে । তাদের জিজ্ঞেস করলাম, কেমন কী অবস্থা বর্তমানে টেক্সটাইল মিলের? উত্তর পেলাম, না দাদা না ভালো না, কাজ করলে দিনকার রোজ হয়, না করলে আর হয় না । তাদের পঢ়নে দেখলাম জীর্ণকাপড়, জীর্ণদেহ সবমিলিয়ে একেবারে দুরবস্থা, সেই সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তাঁতে কাজ করে এখনো ঠিকমতো সংসার চালাতে পারছে না পরিচিত তাঁতিরা। আমারও ঠিক একই অবস্থা ছিল, আমি যখন তাঁতি ছিলাম। সারাবছর কাজ করে ঈদ পূজাপার্বণে ঠিকমতো বোনাসও পেতাম না, পেতাম না কোনো ছুটিছাটা। ছিলাম সবসময় আতঙ্কে কখন যেন চাকরি চলে যায় সেই ভয়ে। পারিবারিক কোনো সমস্যায় পড়লে মালিকপক্ষ থেকে পেতাম না কোনো প্রকার সাহায্য বা অগ্রিম টাকা, এখনো কোনো তাঁতি পায় কিনা সন্দেহ ।অথচ আমরা তাঁত চালিয়ে তাঁতিরা মানুষের লজ্জা নিবারণের জন্য কাপড় তৈরি করতাম দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, আমরা পাই না মালিকদের কাছে কোনো সুযোগসুবিধা ।না পাই দুঃখ নাই, তবু খুশি আমরা আনন্দিত মানুষের জন্য একটুকরো লজ্জা নিবারণের কাপড় তৈরি করতে পেরে ।

যেই কাপড় ছাড়া কোনো দেশের রাজা-বাদশাদেরই লজ্জা নিবারণ হয় না, আমরা এই কাপড় তৈরি করার কারিকর বা তাঁতি। আজ আমি গর্ব করে বলতে পারি, আমরা সারা দুনিয়ার মানুষের লজ্জা নিবারণের কারিকর, আমরা পরের লজ্জা নিবারণের জন্য বস্ত্র বা কাপড় তৈরি করে আজ আমরা নিজেরাই বস্ত্রহীন ভাবে থাকতে হয়, টাকার অভাবে থাকতে হয় না খেয়ে ।আমদের মায়ের শরীরে পেঁচানো থাকে ছেঁড়া কাপড়, নিজেদের স্ত্রীর থাকে ছেঁড়া কাপড়, ছেলে-মেয়ের পঢ়নে থাকে ছেঁড়া কাপড় । আবার বছরের পর বছর থাকি ঋনের বোঝা মাথায় নিয়ে, সময়সময় কাজে বা মিলে ডিউটি করতে যেতে হয় অনাহারে । একগজ কাপড় তৈরি করে পাই দুইটাকা, সারাদিনের মুজুরি গড়ে পাই ২৫০/৩০০ টাকা । বিদ্যুৎ না থাকলে মুজুরি নাই, ঈদ/পূজায় বোনাস নাই, বাৎসরিক কোনো ভাতা নাই, প্রাইভেট কোনো মিলে চাকরির নিশ্চয়তা নাই । তবু আমরা পৃথিবীর শ্রেষ্ট শিল্পের কারিকর বস্ত্র কারিকর, সকলের লজ্জা নিবারণের কারিকর, আমরা গর্বিত তাঁতি।