চিঠি লিখেছিলাম তোমার ঠিকানায় পাঠাবো বলে!

নিতাই বাবু
Published : 13 March 2017, 01:57 AM
Updated : 13 March 2017, 01:57 AM

কিছুদিন আগে গিয়েছিলাম, আমরা আগে যেখানে থাকতাম, সেই নগর খাঁপুরে। সাথে ছিল আমার সেই পুরানো বন্ধু কানাই, ও-এসেছে কলিকাতা থেকে ২৩ বছর পর। এই কানাই হলো আমার জীবনের প্রথম প্রেমের বাস্তব সাক্ষী। সাক্ষী সেই পুকুরপাড়ের কিছু পুরোনো দোকান, যা এখনো আছে। নগর খাঁপুর যাওয়ার পর, আমার বন্ধু কানাই, আমাকে বললো চল আগে দু'জনে দুই-কাপ চা পান করে নেই, পরে পরিচিত লোকদের সাথে দেখা করব। পুকুর পাড়েই এখন দুইটা চা দোকান, যা আগে ছিল না। সেই দোকানে বসেই আমরা দু'জনে চা খাচ্ছি। সামনেই পুকুরের সেই ঘাঁট, যেই ঘাঁটে আমার সেই প্রথম জীবনের ভালো লাগার মানুষটি বসেবসে হাড়ি-পাতিল ধোয়া-মাজা করতো। আমি চায়ের কাপে চুমুক দিয়েই সেই ঘাঁটের দিকে চেয়ে থাকি, আমার এই চাওয়া আমার বন্ধুটি টের পেয়ে আমাকে বলছে, কিরে! মনে পরছে বুঝি? বললাম হ্যাঁ, এখানে এসেই ওর কথা ভীষণ মনে পড়ে গেল।

এমন সময় নগর খাঁনপুরে থাকা এক পরিচিত বন্ধু সামনে এসে হাজির। বলল কিরে তুই এখানে? কখন এসেছিস? কি করিস? ইত্যাদি ইত্যাদি। জবাবে, আমার বলার আগেই আমার বন্ধু কানাই বলে ওঠলো, ওতো বর্তমানে ভালো একটা চাকরি করে, বেতনও পায় ভালো। তারপর ওর জন্য এককাপ চা  অর্ডার দিলাম, ও চা পান করছে, আর আমাকে জিজ্ঞাসা করছে, আমার ভালোবাসার মানুষটির কথা। আমাকে বলছে, তুই জানিস নাকি ও-কোথায় থাকে? আমি বললাম না। কানাই ওকে জিজ্ঞেস করলো, তুই জানিস নাকি? নগরের বন্ধুটি বললো, আমি একবার শুনেছি ও-কোথায় থাকে। ওর কথা শুনে আমি আগ্রহ করে বললাম, তুই ওর ঠিকানাটা আমাকে একটু দিতে পারবি? বিন্ধুটি বললো পারবো, তবে কয়েকদিন দেরি হবে। আমি আবারও বললাম, ওর কাছে চিঠি পাঠানোর ঠিকানাটা তুই আমাকে একটু কষ্ট করে হলেও জোগার করে দিবি, আমি ওর কাছে একটা চিঠি লেখবো। ও-আমাকে বললো, ঠিক আছে তুই সামনের সপ্তাহে আবার এখানে আসিস, আমি তোর জন্য ওর ঠিকানাটা সংগ্রহ করে রাখবো। ওর কথা শুনে মনেমনে ভাবছ, ঠিকানাটা পেলেই আমার প্রিয়ের কাছে চিঠি লিখে পাঠিয়ে দিবো। তারপর নগর খাঁনপুরে অনেক্ষণ ঘুরাফেরা করে আমি আর কানাই বাসায় চলে এলাম। সেদিন রাতেই আমার প্রিয়ের কাছে একটা চিঠি লিখলাম, প্রিয়ের ঠিকানায় দিবো বলে।

প্রিয়তমেষু,

শুরুতেই আমার ভালোবাসা রইল, আশা করি স্বামী সন্তান নিয়ে একপ্রকার ভালো আছো। তুমি ভালো থাকো, বিধাতার কাছে এটাই আমার চাওয়া। আর আমার জন্য যদি তুমি আশীর্বাদ করে থাক, সেই আশীর্বাদে আমিও একপ্রকার ভালো আছি প্রিয়।

পর-সমচার,

আজ এনেকদিন যাবত তোমাকে খুব মনে পড়ছে, কেন মনে পড়ছে তা আমি নিজেও জানিনা প্রিয়। শুধু এটুকু জানি, যখন নিজের সংসারে অশান্তি বেড়ে যায়, তখনই তোমাকে মনে পড়ে ভীষণভাবে। কেন জান? আমার সাংসারিক অশান্তিতে শুধুই ভাবি তোমাকে নিয়ে। ভাবি এজন্য যে, আমার সংসারে যদি তুমি থাকতে, তাহলে হয়তো এই অশান্তিটা হতোনা। কিন্তু তুমি নেই, তুমি আছো পরের ঘরে, পরের ঘরনী হয়ে। তোমাকে না-পাওয়ার ব্যথায় কাঁদি সময়সময় যখন তোমায় মনে পড়ে। ভাবি তোমাকে নিয়ে, কেন যে সেই এক বিকেলে আমার সামনে তুমি এসেছিলে? কেন-ই-বা তোমাকে দেখে ভালো লেগেছিল! সেই ভালোলাগা থেকেই তো তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম তা তুমি নিজেও জান।

কিন্তু তখন আমি হেরে গিয়েছিলাম, আমার দারিদ্র্যতার কাছে, আমার আর্থিক দুর্বলতার কাছে। সেই জন্যই আমি পারিনি তমাকে জীবনসঙ্গী করতে। সেসময় তোমার কোন দোষ ছিলনা, তোমার অজান্তে তোমার বাবা তোমার বিয়ে ঠিক করে ফেলে, যা তুমি পরে জেনেছ। তখন তমারও কোনোকিছু করার ছিলনা।

তোমার বিয়ের দুদিন আগে আমি যখন জানলাম যে, তোমার বিয়ে। তখন তুমি দেখেছ, সাথে গ্রামের সবাই দেখেছে আমার অবস্থা কী হয়েছিল। শুধু কান্না ছাড়া তখন আর কিছুই আমার সঙ্গী ছিলনা। সেসময় তুমি আমার হাত ধরে কেঁদেকেঁদে বলেছিলে, আমায় তুমি ক্ষমা করে দাও, আমার কোন দোষ নেই। সেসময় তোমার কান্নায় আমার সব যন্ত্রাণা দূরে সরে চলে যায়। উল্টো আমিই তোমাকে শান্তনা দিয়ে বললাম, তোমাকে না পাওয়ার ব্যথা আমি সইবো কেমন করে প্রিয়ে? তবু সইবো তোমার সুখের জন্যে। তুমি যাও চিরসুখি হও যেয়ে পরের ঘরে।

তারপর তোমার বিয়ের দিন, তুমি যখন বিয়ের পিঁড়িতে বসতে চাইছিলেনা, তোমাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসাতে সবাই যখন জোরাজুরি করতে লাগলো, তুমি তখন বলেছিলে আমার কথা। বলেছিলে আমার ভালবাসার মানুষটির হাত ধরেই আমি বিয়ের আসরে যেয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে চাই। সবাই তখন অবাক দৃষ্টিতে তোমার দিকে চেয়ে বললো, কে সে তোমার ভালোবার মানুষ? তুমি সোজা কথায় আমার নামটা বলে দিলে প্রিয়। পাড়ার মানুষ তখন আমাকে খুঁজতে শুরু করে দিলো, আমাকে তো পায় না খুঁজে। পাবে কী করে? আমিতো আছি গ্রাম ছেড়ে একটু দূরে নির্জন এক জায়গা দুঃখভরা মন নিয়ে।

গ্রামের লোকজন সেখান থাকেও আমাকে খুঁজে বের করে তোমার সামনে এনে হাজির করলো। তখন তুমি আমাকে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লে, আমায় ঝাপটে ধরে তুমি বলতে লাগলে, আমি তোমায় ছাড়া বাঁচবো না, আমি এই বিয়ের পিঁড়িতে বসবো না। তোমার কান্না দেখে আমিও তখন কাঁদছিলাম তোমাকে ধরে। আমাদের দু'জনের কান্নায় তখন গ্রামের আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে গেল। বরযাত্রীরা তখন বলতে শুরু করলো, এই বিয়ে হবে না। এ-কথা শুনে তুমি একটু খুশিই হয়েছিলে। কিন্তু আমিতো খুশি হই-নি! আমি দৌড়ে গিয়ে বরের বাবার হাত ধরে কেঁদে কেঁদে বলেছিলাম, দোহাই আপনাদের, আপনারা যাবেন না। ওর কোন দোষ নেই, ও ফুলের মতো পবিত্র। ওকে আমি বিয়ের আসরে এনে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দিচ্ছি, আপনারা একটু দয়া করুন। এরপর আমি তমাকে কোলে করে ঘর থেকে বাড়ির উঠানে এনে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দেই। যেই শাড়িটা পড়ে তুমি বিয়ের পিঁড়িতে বসে ছিলে, সেই শাড়িটাও গোপনে আমি কিনে দিয়েছিলাম প্রিয় তোমার মায়ের কাছে। সেটা কি তুমি জানতে? জানতে না প্রিয়ে, জেনেছ হয়তো বহু পরে। তোমার কি মনে পড়ে প্রিয়ে সেই দিনের কথা? আমার এখনো মনে পরে প্রিয়, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে।

বিয়ের আসরে পুরোহিতমশাই যখন বিয়ের মন্ত্র পাঠ করছিলো, তুমি তখন শুধু আমার দিকেই তাকিয়ে তাকিয়ে আমাকেই দেখছিলে বিভোর ভাবে। চারটি কলাগাছের চতুর্দিকে তোমরা স্বামী-স্ত্রী যখন ঘুরছিলে সাতপাকে, আমি তখন কাঁদছিলাম তোমাকে হারিয়ে।

তোমার কি মনে পড়ে প্রিয়ে? বিয়ের পরদিন যখন তোমাকে তোমার স্বামীর বাড়ি নিয়ে যাচ্ছিল সেসময়ের কথা? আমার মনে পড়ে প্রিয়ে, মনে পড়ে তুমি শশুরবাড়ি যেতে চাচ্ছিলে না। আমি তোমাকে জোর করে গাড়িতে বসা তোমার স্বামীর সঙ্গে তোমাকে বসিয়ে দেই। তুমি চলে গেলে তোমার স্বামীর ঘরে, আমি তোমাকে হারিয়ে, দুঃখভরা মন নিয়ে চলে যাই বহুদূরে চাকরির সন্ধানে। দুই বছর পর ফিরে এসে দেখি আমার মায়ের অবস্থা ভালো না, বৃদ্ধ মায়ের অনুরোধ রাখতে গিয়েই আমি বিয়ে করেছি প্রিয়, নিজের ইচ্ছায় নয়। যদি আমাকে বিয়ে করার জন্য অনুরোধ করার মতো কোনো মানুষ না-থাকতো, তবে প্রিয়ে আমি চিরকালই দেবদাস হয়ে থাকতাম।

এখন বলো প্রিয়ে, কেমন আছো? শুনেছি তোমার কোলে নাকি দুটো মানিক এসেছে? ওদের দেখতে কেমন, রাজপুত্রের মতো? হয়তো তাই, তোমার চেহারাই ওরা পেয়েছে প্রিয়। স্বামীর সোহাগে সোহাগী হয়ে কীভাবে তোমার বর্তমান দিন যাপিত হচ্ছে জানাবে কেমন! আর কি লিখবো প্রিয় ভাষা খুঁজে পাচ্ছিনা, শুধু প্রার্থণা করি সুখী হও, স্বামীর সোহাগে সোহাগী হও। আর হ্যাঁ, আমার এই চিঠিখানা পেয়ে তুমি চোখের জলে বুক ভাসাইও না, যদি একফোঁটা চোখের জল ফেলো, তোমার চোখের জলের দাম আমি কখনো দিতে পারবোনা প্রিয়। আমার অনুরোধ রইল, তুমি চোখের জল ফেলে আমাকে ঋণী করোনা।

ইতি-
তোমার কোন একসময়ের ভালোবাসার মানুষ।

চিঠিখানা লিখেছি ঠিক, কিন্তু প্রেরণ করা হলো না প্রিয়ের ঠিকানা না-পাওয়ার কারণে।