মাদকবিরোধী অভিযানে ধরা পড়ছে মাদকসেবী, ধরাছোঁয়ার বাইরে মাদক ব্যবসায়ী

নিতাই বাবু
Published : 21 April 2017, 06:19 PM
Updated : 21 April 2017, 06:19 PM

বিকালবেলা অফিসের কর্তব্য পালনে বেরুতেই চোখে পড়ল পুলিশের মাদক বিরোধী অভিযানের দৃশ্য। স্থানটি ছিল গোদনাইল বাংলাদেশ সমবায় শিল্প সংস্থার অভ্যন্তরে, তারিখ ১৯ এপ্রিল ২০১৭ বুধবার। বাংলাদেশ শিল্প সংস্থার সামনেই তিনটি লেগুনা, একটি মাইক্রোবাস দাঁড়ানো। লেগুনার ভেতরে দুইজন লোক বসা দেখে অপর একজন লোককে জিজ্ঞেস করলাম, ওরা লেগুনার ভেতরে বসা কেন? লোকটি বললেন মাদকসেবী, গাঁজা খাইছে দাদা। তাই কিছুক্ষণ আগে সংস্থার ভেতর থেকে ওদের ধরা হয়েছে, বললেন লোকটি। গেলাম সংস্থার ভেতরে, সংস্থার প্রহরী আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেনি, যেহেতু আমি সংস্থার ভেতরে থাকা শ্রমিক কর্মচারী সবার পরিচিত তাই। ভেতরে গিয়ে দেখি ১০-১২ জন পুলিশ। সাথে মহিলা পুলিশও। এই অভিযানে অংশ নেয় ফতুল্লা থানা, সিদ্ধিরগঞ্জ থানা ও নারায়ণগঞ্জ মডেল থানার ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাগণ। পুলিশের ভয়ে মোবাইল নিয়ে সামনে গিয়ে ঘটনাস্থলের ছবি তুলিনি।

এই সংস্থাটি বহু প্রাচীন, এখানে পাট বেলিং করা হয়। সংস্থার পশ্চিমে শীতলক্ষ্ম্যা নদী। নদীর পাড় ঘেঁষেই বাংলাদেশ সমবায় শিল্প সংস্থা, যা কো-অপারেটিভ নামে সবার কাছে পরিচিত। প্রতিদিন ৮ ঘন্টা পাটের কাজ সেরে সংস্থার শ্রমিকরা বিকালবেলা এই নদীর পাড়েই বসে আড্ডা দেয়। শুধু সংস্থার শ্রমিকরাই নয়, নদীর পাড়ে ঘুরতে আসে এলাকার ছেলে-বুড়ো অনেকেই । এই আড্ডা আর মিলন মেলার মাঝেই কেউ তাস, কেউ গোল্লাছুট খেলায় থাকে মগ্ন। কেউ সিগারেট আবার কেউ গঞ্জিকা সেবনও করতে পারে তা স্বাভাবিক। সেখান থেকেই সংস্থার শ্রমিক দুইজনকে গাঁজাসহ হাতেনাতে ধরে পুলিশের লেগুনায় উঠিয়েছে। পুলিশ ভাল কাজটিই করেছে, কারণটা সবারই জানা। এই মাদকে ছেলে-বুড়োসহ সবার জীবনটাই তচনচ করে দিচ্ছে। মাদককে না-বলুন শ্লোগানকে সামনে রেখেই পুলিশের এই মাদক বিরোধী অভিযান।

এই অভিযানে যে-ক'জনকে ধরা হয়েছে, তাঁদের প্রথমে নিকটস্থ থানায়, পরে ভ্রাম্যমাণ ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক তৎক্ষণাৎ ধারা অনুযায়ী জেল। যাই হোক, পরদিন জানা যায়, নারায়ণগঞ্জ থেকে ১৯ তারিখের অভিযানে মোট ২৯ জনকে আটক করা হয়েছে, সবাই মাদকসেবী। ২০ তারিখে নারায়ণগঞ্জের সব পত্রিকায় ছাপা হয়েছে যে, ১৯ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সিটির সমস্ত মহল্লা আর অলিগলি থেকে মাদক বিরোধী অভিযানে যাদের ধরা হয়েছে তাঁদের প্রত্যেককে ৬ মাস করে কারাদণ্ড প্রদান করেছে আদালত। পত্রিকার খবর পড়ছি আর ভাবছি, ৬ মাস! এতো অনেক সময়! এই ৬ মাস কারাভোগ করে আসতে পাড়লে হয়তো মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা মাদকের আসক্তি থেকে একটু রেহাই পাবে। কারণ জেলে-তো আর মাদক তারা পাবেনা। মাদক না-পেলে মাদক সেবনও করতে পারবেনা। এতে মাদকাসক্ত ব্যক্তির পরিবার পরিজনও একটু স্বস্তির নিশ্বাস পেলতে পারে।

কেননা, মাদকাসক্ত ব্যক্তির পরিবার পরিজন এই মাদকের নেশায় সর্বশান্ত হয়ে গেছে বহু আগেই। আমার মনে হয়, মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে পরিবারের লোকজন এই মরণনেশা থেকে ফিরিয়ে আনতে বুঝাইতে বুঝাইতে আর কম বুঝায়নি। কেউ কেউ ডাক্তার কবিরাজও ধরেছে। যখন কাজের কাজ কিছুই হয়নি, তখন অভিশাপ দেওয়া শুরু করেছে মাদক ব্যবসায়ীদের। দুহাত তুলে কেঁদে কেঁদে সৃষ্টিকর্তার কাছে ওইসব নেশা বিক্রেতা ব্যবসায়ীদের পতন চেয়েছে। দু'হাত তুলে বলেছে হে' আল্লাহ! আপনি এসব নেশার ব্যবসায়ীদের খতম করে দিন, যাতে আমার স্বামী, আমার ভাই, আমার বাবা যেন আর কোথাও তার নেশা করার মাদকদ্রব্য না-পায়। তাহলেই আমার বাবা, আমার ভাই, আমার স্বামী আর নেশা করতে পারবেনা, আমারাও আর না-খেয়ে থাকবো না, আমাদের লেখাপড়াও আর বন্ধ হয়ে যাবে না।

এই মাদক ব্যবসায়ীদের মাদকের কারণে দেশের সব জায়গায়, সবখানে সমাজের বহু পরিবার আজ বড় অসহায় হয়ে পরেছে। কতো যুবক আজ নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে তার কোনো হিসাব নাই। সোনার সংসার ছারখার করে দিচ্ছে এই মাদক ব্যবসায়ীদের পাচার করা মাদকে। সময় সময় পত্রিকার পাতায় দেখা যায়, মাদকাসক্ত ছেলে গর্ভধারিণী মা'কেও মারধর করে, স্ত্রী 'কেও মারধর করছে, নেশার টাকা জোগাড় করতে না-পেরে খুনও করছে। রাস্তায় রাস্তায় দেখা যায় নেশার টাকা জোগাড় করার জন্য ড্রেন-নর্দমায় নেমে লোহালক্কড় খুঁজছে, উপাধি পেয়েছে টোকাই। আর যারা গাঁজা সেবন করে জিম মেরে থাকে, তাঁরা উপাধি পেয়েছে মুরগী। ছিল রাজপুত্র, মাদকের কারণে হয়েছে টোকাই আর মুরগী। আবার দেশে যখন মাদক বিরোধী সাঁড়াশি অভিযান চালানো হয়, তখন এসব টোকাই, হিরোইনচি, গাঁজাখোরদেরই ধরা হয়। আসল ক্রিমিনালরা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে।

যেমনটা হয়েছে ১৯ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সিটিতে। এই মাদক বিরোধী অভিযানে যেখানে ২৯ জন মাদকসেবী ধরা পড়েছে, তাঁদের সাথে একজনও মাদক ব্যবসায়ী ধরা পড়ে নাই, এটা দুঃখজনক। তাহলে এই অভিযানে কতটুকু সফলতা আসবে কে জানে। এমন অভিযানের সফলতা আসবে তখন, যখন আমারা দেখবো যে, মাদক সেবনকারীকে ধরে তার কাছ থেকে তথ্য নিয়ে দুইএকজন মাদক ব্যবসায়ীকে ধরা হয়েছে। আর মাদকসেবীদের যদি কারাভোগ হয় ৬ মাস, মাদক ব্যবসায়ীদের যেন হয় যাবজ্জীবন। আর তাঁদের ছাড়ানোর জন্য যাতে কেউ এগিয়ে না-যায়। তাহলে মনে হয় আমরা অনেকটা মাদক মুক্ত, নেশা মুক্ত সমাজ গড়তে পারবো।