বঙ্গবন্ধুর খুনিদের চরম ঘৃণা-ধিক্কার জানানোরও ভাষা নেই

নিতাই বাবু
Published : 15 August 2017, 04:31 AM
Updated : 15 August 2017, 04:31 AM

.

শোকাবহ রক্তমাখা আগস্ট আসলেই, মনে পড়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের কথা। যার ডাকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, লক্ষ লক্ষ বীর বাঙালি পাক হানাদার বাহিনীর ওপর। যার ঘোষণায় আমরা পেয়েছি একটা মানচিত্র, একটা স্বাধীন দেশ। যার জন্য আমরা খুলতে পেরেছি আমাদের পায়ের পরাধীনতার শিকল। যার কৃতিত্বে আজ আমরা স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষ। আমরা আজ কারোর গোলাম নয়, আমরা আযাদি। ১৯৭১ সালে সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে দেখেছি, পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরতা, জ্বালাও পোড়াও, শুনেছি হাজার হাজার মা-বোনদের সম্ভ্রমহানির কথা। শুনাছি রেসকোর্স ময়দানের বজ্রকন্ঠ, রেডিওতে শুনেছি স্বাধীনতার ঘোষণা।

যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমরা অনেক কষ্ট করেছি, থেকেছি না খেয়েও। আমাদের বাড়িতে ছিল মুক্তিবাহিনীদের রাত্রিকালীন আড্ডা, শুনেছি তাদের মুখে মুক্তিযুদ্ধের গল্প। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা হারিয়েছি আমাদের প্রিয়জনকে, তবু আমাদের কোনও শোক বা আফসোস নেই। শোক আর আফসোস শুধু রক্তমাখা ১৫ আগস্টের জন্য। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল ২৬ মার্চ থেকে, শেষ হয়েছিল ১৬ ডিসেম্বর। যুদ্ধ চলাকালীন ৯ মাসের মাঝখানেও আগস্ট ছিল। তখন যদি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হতো, তাহলে আমাদের এতো শোক লাগতো না; যা এখন লাগে।

৩০ লাখ শহীদের রক্ত আর অসংখ্য মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন। চারদিকে ঘরবাড়ি পোড়া গন্ধ, যেখানে সেখানে পড়ে থাকা মরদেহ। মানুষ পঁচা গন্ধে বাতাস ছিল ভারি। মানুষের পড়নে ছিল না কাপড়, কৃষকের ছিল না হালের গরু। ছিল না খাবার, থাকার ছিল না ঘর। ভাই হারিয়েছিল আদরের বোনকে, অনেক মা হারিয়েছিল তার স্বামীকে। তবু মানুষের কোনো দুঃখ ছিল না, শোক ছিল না; ছিল না হাহাকার। শত কষ্ট মেনে নিয়ে ১৬ ডিসেম্বরকে মানুষ হেসে খেলে বরণ করে নিয়েছিল। অপেক্ষায় ছিল, স্বাধীন বাংলার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের জন্য। তখন তিনি ছিলেন, পাক হানাদার বাহিনীদের দেশে আটক। এই সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মজিবুর রহমান ছাড়া, এক সময় স্বাধীনতা ম্লান হতে লাগল।

হঠাৎ একদিন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি, স্বাধীনতার মহানায়ক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করলেন। তখন সে-সময়ের সারে সাত কোটি বাঙালি যেন ফিরে পেল তাদের প্রাণ। শুরু হল নিজেদের ঘর গোছানো, শুরু হল সোজা হয়ে দাঁড়ানো। দূর হতে লাগল ঘর পোড়া গন্ধ, মা ভুলতে লাগলেন সন্তান হারানো বেদনা। কৃষক শুরু করলেন তার জমিতে চাষাবাদ, ঘর হারা মানুষ বানাতে লাগলেন তার ঘর। সর্বোপরি বাঙালি জাতি যখন বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে লাগলো; তখনই ঘটলো ইতিহাসের বেদনাবিধুর বিভীষিকাময় ১৫ আগস্ট। যা ইতিহাসের পাতায় লাল অক্ষরে লেখা থাকবে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, তখন আমার বয়স ১২ বছর মাত্র। বাবা চাকরি করতেন চিত্তরঞ্জন কটন মিলে। বড়দাদা চাকরি কতেন আদর্শ কটন মিলে, সপরিবারে থাকতাম মিলের ভেতরে। ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্টের সকালবেলা যখন শোনা গেল বঙ্গবন্ধু আর নেই, তখন চারিদিকে পড়ে গেল শোকের ছায়া। সব শব্দ হয়ে গেল স্তব্ধ, স্কুল কলেজ বন্ধ, চারিদিক শুধু হাহাকার। হায়! হায়! কী হলো? কী ঘটলো? ঘটলো ইতিহাসের কলঙ্কজনক নৃশংস ঘটনা। সেনাবাহিনীর একদল উচ্ছৃঙ্খল বিপথগামী সৈনিকের হাতে সপরিবারে প্রাণ হারাল, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান।

তখন অনেকেই ভেবেছিল, এই বুঝি আরেকটা যুদ্ধ সংঘটিত হতে চলছে। কিন্তু না, কিছুই হয় নি; হয়েছে জাতির পিতার জন্য নীরবে চোখের পানি ফেলা। যদি রাতেই শোনা যেতো বঙ্গবন্ধু মরে নাই, তাহলে বীর বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়তো ঘাতকদের ওপর। রাজপথে আবার মিছিল হত বঙ্গবন্ধুকে বাঁচানোর জন্য। তিনি বেঁচে যেতেন বাঙালির ভালোবাসায়, তখন বিশ্ব পেতো এক মহান নেতা। আমরা ফিরে পেতাম আমাদের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতাকে। সত্যি, বাঙালির হৃদয়ে, মননে এমন ইচ্ছা থাকা সত্বেও, সেদিন পারি নি কিছুই করতে; দুর্ভাগ্য আমাদের।

সেদিন ঘাতকদের নৃশংস হামলায় শুধু জাতির পিতাই প্রাণ হারান নি, প্রাণ হারিয়েছেন আরো অনেকে। তার সাথে প্রাণ হারিয়েছেন, বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব,পুত্র শেখ জামাল, শেখ কামাল, শেখ রাসেল, রোজী জামাল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল, ভাই শেখ নাসের ও কর্নেল জামিল, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে মুক্তিযোদ্ধা শেখ ফজলুল হক মনি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, শহীদ সেরনিয়াবাত, আরিফ রিন্টু খান,শিশু বাবুসহ অনেকে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মিজিবুর রহমান ছিলেন খুবই আত্মবিশ্বাসী। তিনি কখনোই এমনটা পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুতও ছিলেন না। ভাবেননি একটা স্বাধীন দেশের সেনাবাহিনীর হাতে তাকে প্রাণ হারাতে হবে। তাই সেদিন ঘাতকদের মেশিনগানের মুখেও বঙ্গবন্ধু ছিলেন বীর সাহসী।

ঘাতকদের প্রশ্ন করেছিলেন, 'তোরা কী চাস? কোথায় নিয়ে যাবি আমাকে?' কোনো কথাই শুনেনি ঘাতকচক্র, ঝাঁঝরা করে দেয় জাতির পিতার দেহখানা। স্বাধীন বাংলাদেশের সারে সাত কোটি মানুষও এই নৃশংস ঘটনার আশায় ছিল না। তবু সাবার অজান্তেই ঘটে গেল ইতিহাসের কলঙ্কজনক নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা।

জানা যায়, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরবেলা সারা দুনিয়ার মানুষ ছিল ঘুমে বিভোর। এই সুযোগে একদল বিপদগামী সেনাবাহিনী যায়, ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে। সেই বাড়িতেই সপরিবারে থাকতেন স্বধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান। ওই উচ্ছৃঙ্খল বিপদগামী সেনাবাহিনীদের টার্গেট ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান। তাঁরা বাসভবনে প্রবেশ করেই, কাপুরুষোচিত আক্রমণ চালায়।

সেই নারকীয় হামলার পর দেখা গেছে, ভবনটির প্রতিটি তলার ভয়ানক দৃশ্য। প্রতিটি তলার দেয়াল, জানালার কাচ, মেঝে ও ছাদে রক্ত আর মগজ। সাথে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে হাড়-গোঁড়, কাপড়চোপড়। দেয়ালগুলোও ঝাঁঝরা হয়ে গেছে, গুলির আঘাতে। প্রথম তলার সিঁড়ির মাঝখানে নিথর পড়ে আছেন, স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লাশ। পাশেই পড়ে ছিল তাঁর ভাঙা চশমা ও তার অতিপ্রিয় তামাকের পাইপ। তাঁর তলপেট ও বুক ছিল বুলেটে ঝাঁঝরা। এ-ছাড়া মূল বেডরুমে দুই ভাবির ঠিক মাঝখানে ছিল, ছোট্ট শিশু শেখ রাসেলের লাশ। সেদিন দেশের বাইরে থাকায় বেঁচে যান, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ছোটবোন শেখ রেহানা ৷

এরপর ১৯৮১ সালের ১৭ মে রবিবার, দীর্ঘ নির্বাসন শেষে তিনি বাংলার মাটিতে ফিরে আসেন। বহু প্রতিক্ষার পর ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে। জননেত্রী শেখ হাসিনা শপথবাক্য পাঠ করে ক্ষমতা গ্রহণ করে। আর তখনি এ দিবসটিকে জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা করেন। সাথে এদিন সরকারি ছুটিও ঘোষণা করা হয়। এভাবেই চলে ২০০১ সালের আগস্ট পর্যন্ত। এরপর ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় আসে। তারা ক্ষমতায় এসে এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক দিবস পালনের বিষয়টি বাতিল করে দেয়। বিএনপি সরকার জানতো না যে, ইতিহাস কখনো মাটিচাপা দিয়ে রাখা যায় না। কথায় আছে,'সত্যের নৌকা সাতবার ডোবে, সাতবার ভাসে।'

এরপর ২০০৭ সালের ১২ই জানুয়ারি তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ দেশে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেন। একই সাথে সেনা সমর্থিত একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়, যার প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ফখরুদ্দীন আহমেদকে নিয়োগ করা হয়। ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে মহামান্য হাইকোর্টের এক ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা দেন। সেই রায়ে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসটি সরকারি ছুটিসহ রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক দিবস পালনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়। সেই থেকে প্রতি বছর ১৫ আগস্ট পালিত হয়ে আসছে জাতীয় শোক দিবস।

তাই আগস্ট মাসটি বাংলাদেশের মানুষের কাছে শোকের মাস। জাতি গভীর শোক ও শ্রদ্ধায় স্মরণ করে আসছে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সকল সদস্যদের। বাংলাদেশের মানুষের কাছে সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ও মর্মস্পর্শী দিন ১৫ আগস্ট। প্রতিবছর আগস্ট মাস আসলেই বাঙালির মনে পড়ে যায়, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কথা। সমস্ত বাঙালির হৃদয়ে শোক আর কষ্টের দীর্ঘশ্বাস ওঠানামা করতে থাকে।

বাঙালি জাতি এইদিন শোক ও শ্রদ্ধায় জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানকে স্মরণ করে। রাষ্ট্রীয়ভাবে যথাযোগ্য মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্যে পালিত হয়, জাতির পিতার শাহাদাত বার্ষিকী। কিন্তু দুঃখ শুধু থেকেই গেল, এখনো জাতির পিতার সব খুনিদের বিচারকার্য সমাপ্ত হয়নি। এখনও পারেনি, পলাতক আসামিদের দেশে ফিরিয়ে আনতে। আশা করি এই বাংলার মাটিতেই একদিন পলাতক খুনিদের ফাঁসি কার্যকর হবে। তবু এমন কলঙ্কজনক হত্যাকাণ্ডে জরিত খুনিদের প্রতি চরম ঘৃণা-ধিক্কার জানানোর ভাষা খুঁজে পাই না।

আংশিক তথ্য সংগ্রহ উইকিপিডিয়া।

ছবি সংগ্রহ গুগল।