চৌধুরীবাড়ি আর.কে গ্রুপের শ্রমিকদের বিক্ষোভ

নিতাই বাবু
Published : 29 Sept 2017, 03:09 PM
Updated : 29 Sept 2017, 03:09 PM


ঈদ মানে আনন্দ, আসন্ন ঈদকে সামনে রেখে মানুষ ব্যস্ত হয়ে পড়ে কেনাকাটায়। কিনে নেয় নতুন নতুন জামা কাপড় সহ বহুরকম দ্রব্যসামগ্রী। পবিত্র ঈদ অতিবাহিত হলেই প্রভাব পড়ে দৈনন্দিন জীবন চলার খরচের ওপর। খেটেখুটে খাওয়া মানুষগুলো পড়ে যায় মহাবিপদে। যাদের সীমিত রোজগারের ওপর সংসার, তাদের অবস্থা তো একেবারেই দুরাবস্থাতে গিয়ে দাঁড়ায়। বলছি, 'বর্তমানে যারা গার্মেন্টসে চাকরি করে তাদের কথা।'

ঈদ যদি কোনও মাসের ২৮/২৯ তারিখে অনুষ্ঠিত হয়, তখন গার্মেন্টস মালিকরা শ্রমিকদের দেয় অর্ধেক বেতন। বলা হয়, বাকি অর্ধেক বেতন দেওয়া হবে কারখানা বা গার্মেন্টস খোলার পর। আবার মালিক কর্তৃপক্ষের নিয়ম থাকে যে, নির্দিষ্ট খোলার তারিখে শ্রমিকদের কাজে উপস্থিত থাকতেই হবে। যদি অনপুস্থিত থাকে, তা হলে বন্ধের হাজিরা কর্তন করা হবে। করেও তাই।

এ সব নিয়মনীতি, বাধা-নিষেধ মেনেই বর্তমানে অসহায় দিনমজুর শ্রমিকরা কাজ করছে। তারপরও যদি সময়মত তদের মাসিক বেতন না পায়, তাহলে? তাহলে অসহায় শ্রমিকরা সংসার চালাবে কী করে? উপাই নাই, সংসারে খাবার নাই, মুদি দোকানে সদাই নাই। তাই শ্রমিকরা হয়ে পড়ে দিশেহারা। পাওনা বেতনের জন্য ধরণা দেয় মালিক কর্তৃপক্ষের কাছে। তারা মালিক কর্তৃপক্ষের কাছে বলে তাদের বর্তমান দুরাবস্থার কথা। শুনে ও শুনে না মালিকপক্ষ শ্রমিকের কথা। তখন শ্রমিকরা ক্ষিপ্ত হয়ে শুরু করে শ্লোগান, বন্ধ করে দেয় রাস্তাঘাট। শুরু হয়ে যায় হানাহানি, মারামারি আর ভাংচুর। তখন মালিকপক্ষ শ্রমিকদের নিধন করতে খুঁজে ভিন্ন পন্থা। শ্রমিকদের থামাতে আর দমাতে মালিকপক্ষ স্মরণাপন্ন হয় পুলিশের। ক্ষিপ্ত শ্রমিকদের দমাতে থানা থেকে প্রেরণ করে দাঙ্গা পুলিশ। পুলিশ ঘটনাস্থলে এসেই শুরু করে করে লাঠিচার্জ, ছোঁড়া হয় কাঁদানে গ্যাস।

এমন ঘটনা আমাদের দেশে প্রতিটি ঈদ উৎসবের আগে ও পরে ঘটে থাকে। কখনও ঢাকা, কখনও চট্টগ্রাম আর দেশের শিল্পনগরীগুলোতে। সদ্য গত হওয়া পবিত্র ঈদুল উল আযহা অনুষ্ঠিত হয়েছে ২ সেপ্টেম্বর। এই ঈদের আগেপাছে এমন কোনও ঘটনা দেশের কোথাও শোনা যায়নি। শোনা না গেলেও ঘটে গেল, নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল চৌধুরী বাড়ির আর কে গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজে। পবিত্র ঈদুল উল আযহা অনুষ্ঠিত হয়েছে ২ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ইং তারিখে। শ্রমিকদের বেতন দেওয়া হয়েছে মূল বেতন থেকে অর্ধেক বেতন।

শ্রমিকরা এই স্বল্প বেতন আর বোনাস দিয়ে উদযাপন করে কোনরকম ভাবে। আশায় থাকে বাকি বেতনের, যা পাবে গার্মেন্টস খোলার পর। আর কে গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ ঈদের বন্ধ ছিল ৭ দিন। খোলার তারিখ ছিল ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ইং তারিখ। ইন্ডাস্ট্রিজ খোলার পর, শ্রমিকরা যারযার কাজে যথারীতি যোগদান করে। এই গার্মেন্টসের বেশিভাগ শ্রমিকদের বাড়িই দেশের বিভিন্ন জেলাশহরে। কাজ করে গার্মেন্টসে, আর বাসা ভাড়া নিয়ে থাকে এর আশেপাশের মহল্লায়। সারা মাস মুদিদোকানে খায় বাকি, মাসের বেতন পেলে পরিশোধ করে টাকা। ৯ সেপ্টেম্বর গার্মেন্টস চালু হবার পরও ৬ দিন অতিবাহিত হলো। তারিখ হলো ১৫ সেপ্টেম্বর, যা একমাসের অর্ধেক সময়। কিন্তু শ্রমিকদের পাওনা গতমাসের অর্ধেক বেতন আর মালিকপক্ষ দিচ্ছে না।

এদিকে ঈদের ছুটি শেষে গ্রামের বাড়ি থেকে আসা শ্রমিকদের হাত খালি, পকেট শূন্য। এমতাবস্থায় শ্রমিকরা গার্মেন্টস কর্তৃপক্ষের কাছে অর্ধেক বেতনের জন্য তাগিদ দিতে থাকে। কর্তৃপক্ষ দেই দিচ্ছি, দেই দিচ্ছি বলে আসছে, কিন্তু শ্রমিকদের বেতন দিচ্ছে না। মালিকপক্ষ গত ১৪ সেপ্টেম্বর রোজ বৃহস্পতিবার, শ্রমিকদের বকেয়া বেতন দেওয়ার কথা বলে। শ্রমিকরাও মিলিকপক্ষের কথা মেনে নেয়। বৃহস্পতিবার দিবাগত সন্ধ্যায় শ্রমিকরা কর্তৃপক্ষের কাছে বেতন চায়।

গার্মেন্টস কর্তৃপক্ষ আবারও বেতন দিতে গড়িমসি শুরু করে। একপর্যায়ে বেশিভাগ শ্রমিক ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। মালিকপক্ষ ১২ সেপ্টেম্বর বেতন পরিশোধ করবে বলে আবারো কথা দেয়। ১২সেপ্টেম্বর রোজ রবিবার দিনগত সন্ধ্যায় সব শ্রমিক একত্রিত হয়ে বেতন চায়। এতেও মালিকপক্ষ বেতন দিতে আপত্তি জানায়। সাথে সাথে এই খবর গার্মেন্টসের প্রতিটি ডিপার্টমেন্টে ছড়িয়ে পড়ে। ক্ষিপ্ত শ্রমিকরা হয়ে যায় বিক্ষুব্ধ, রূপ নেয় এক ভয়াবহতার। সব শ্রমিকরা গার্মেন্টস থেকে বাইরে এসে রাস্তার মাঝখানে অবস্থান নেয়। মুহূর্তেই নারায়ণগঞ্জ টু ডেমড়া ভায়া চিটাগাং রোড বন্ধ হয়ে যায়। চৌধুরী বাড়ি বাসস্ট্যান্ড পরিণত হয় যানজটের মৃত্যুপুরীতে। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা বেতন পরিশোধ করতে শ্লোগান শুরু করে।

এ সময় কোনও যানবাহ ভাংচুর না হলেও, রাস্তায় কোনও যানবাহ চলতে দেয়নি। শ্রমিকদের শ্লোগান চলে প্রায় একঘণ্টা, মানুষ হয়ে ওঠে অতিষ্ঠ। খবর পেয়ে নিকটস্থ সিদ্ধিরগঞ্জ থানা থেকে আসে দাঙ্গা পুলিশ। পুলিশের উদ্বর্তন কর্মকর্তাগণ শ্রমিকদের কথা শুনে শ্রমিকদের শান্ত হতে বলেন। রাস্তা থেকে শ্রমিকদের সরিয়ে দেন পুলিশরা। তারপর পুলিশের মধ্যস্থতায় শ্রমিকরা শান্ত হয়ে তাদের পাওনা বেতন দাবি করে। এসময় পুলিশের সাথে এলাকার কিছুসংখ্যক গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গও উপস্থিত ছিলেন। ছিলেন নারায়ণগঞ্জের কিছু সাংবাদিকও। উপস্থিত শ্রমিকদের আগামী দুইদিনের মধ্যে তাদের বকেয়া বেতন পাবে বলে কথা দেয়। তারা বলেন, 'এতে মালিকপক্ষ কোনরকম গড়িমসি করতে পারবে না। যদি দুইদিনের মধ্যে শ্রমিকদের বেকেয়া বেতন না দেয়, তা হলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।'

এরপর বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা শান্ত হয়, পরিস্থিতিও আসে নিয়ন্ত্রণে।