মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফি সীমিত রাখুন

নিতাই বাবু
Published : 10 Jan 2018, 10:44 AM
Updated : 10 Jan 2018, 10:44 AM

মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী,

আমার হাতেখড়ি একটুকরো কলাপাতা আর বাঁশের কঞ্চির কলমে। লেখাপড়াও শুরু হয়েছিল ১৯৬৮ সালে। চতুর্থ শ্রেণিতে থাকতেই ১৯৭১ এ শুরু হয় আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম। স্কুলে প্রথম ভর্তি হয়েছি নামমাত্র ভর্তি ফি দিয়ে। তখন এই বঙ্গদেশে এক টাকার যেই মূল্য ছিল, বর্তমানে ১০০০ টাকারও সেই মূল্য নেই। বাল্যশিক্ষা একখানা বই নিয়ে স্কুলে যেতাম। তখনকার সময়ে এই বঙ্গদেশে যতো মাথাওয়ালা জ্ঞানীগুণীজন ছিল তারা সবাই আমার মতন এই বাল্যশিক্ষা বই পড়েই জ্ঞানীগুণী হয়েছিল। আমার মনে হয় এই বাল্যশিক্ষা বইখানা আপনি নিজেও পড়েছেন মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী, যা ছিল রামসুন্দর বসাক প্রণীত বাল্যশিক্ষা। তখনকার সময়ে সব বাঙালিদের বাড়িতে শিশুদের পড়ার জন্য এই বাল্যশিক্ষা বইখানা বহুকাল প্রচলিত ছিল। এরপর স্বরবর্ণ-ব্যঞ্জনবর্ণ শিক্ষার জন্য নতুন রূপে প্রকাশ হয় সীতানাথ বসাকের আদর্শলিপি বইখানা।

রামসুন্দর বসাক প্রণীত 'বাল্যশিক্ষা'। বইয়ের ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ করা।

আপনারও হয়তো মনে আছে, আগেকার সময়ের স্কুল জীবনের কথা। তখনকার সময়ে ক্লাস ওয়ানে একবার ভর্তি হলে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত আর কোনপ্রকার ভর্তি ফি কাউকে দিতে হয়নি। ক্লাস ফাইভে বাৎসরিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পাড়লে স্কুল থেকে বিনামূল্যে একটা ছাড়পত্র পাওয়া যেত। প্রাইমারি স্কুলের সেই ছাড়পত্র নিয়ে হাইস্কুলে সবাই ভর্তি হতো। ভর্তি ফিও ছিল নামমাত্র। আবার ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হলে দশম শ্রেণী পর্যন্ত কোন ভর্তি ফি কাউকে দিতে হয়নি। তখনকার সময়ে দেশের কোনও বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদ ছিল না। অভিভাবক প্রতিনিধি কাকে বলে তার নামগন্ধও ছিল না। বিদ্যালয়ের সার্বিক কর্মকাণ্ড আর সকল দায়িত্ব ছিল বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের উপর। এখন প্রতিটি বিদ্যালয়েই অভিভাবক প্রতিনিধিদের উপরে দায়িত্ব। মাস্টারের দায়িত্ব শুধু পড়ানো আর অভিভাবক প্রতিনিধিদের হুকুম মেনে চলা। প্রতি দুইবছর পরপর অভিভাবক প্রতিনিধি নির্বাচন। নির্বাচনের আগে জয়লাভের জন্য ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবকদের নানারকম প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। লেখাপড়া ভালো হবে, ভর্তি ফি কমানো হবে, ফরম ফি কমানো হবে, সার্বিক সহযোগিতা করা হবে ইত্যাদি ইত্যাদি বিষয়ে সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়া হয়।

নির্বাচনের পর ওইসব প্রতিশ্রুতির কথা আর তাদের মনে থাকে না। বিদ্যালয়ের উন্নয়নমূলক কাজের চাপে সবই ভুলে যায় অভিভাবক প্রতিনিধিরা। তারা বিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য ঘোষণা দিতে থাকেন ভর্তি ফি, ফরম ফি বাড়ানো হবে, না হয় বিদ্যালয়ের উন্নয়ন হবে না। কারণ শুধু একটাই মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী, তা হলো- অভিভাবক প্রতিনিধি নির্বাচন করতে তাদের অনেক টাকা ব্যয় হয়েছে। নিজের পকেটের টাকা ব্যয় করে শুধুশুধু কে কার উপকার করতে চায়? সেই নির্বাচনী ব্যয় তো তাদের এই বিদ্যালয় থেকেই তুলতে হবে। সেই কারণেই প্রতিবছর নানারকম অজুহাত দেখিয়ে বাড়াচ্ছে ভর্তি ফি, ফরম ফি ইত্যাদি।

বর্তমানে দেশের সকল সরকারি-বেসরকারি স্কুলগুলোতে চলছে ভর্তি বাণিজ্য। গত একবছর আগে যেখানে ছিল ৭০০ টাকা ভর্তি ফি, এবার সেখানে ১০০০ টাকা! কোন কোন বিদ্যালয়ে ১১০০ টাকা থেকে শুরু করে ২০০০ টাকা পর্যন্ত। নামীদামী স্কুলগুলোতে আরও বেশি। কোচিং সেন্টারে পড়তেও এখন ভর্তি ফি দিতে হয় মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী। স্কুলে-কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বত্র চলছে ভর্তি ভর্তি খেলা। মোটকথা ভর্তি ফি আর ফরম ফি এখন আমাদের বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এক মহা বাণিজ্যে রূপ নিয়েছে। এতো টাকা দিয়ে স্কুলে ভর্তি হবার পর অভিভাবকদের ভাবতে হয় ছেলেমেয়ের স্কুল ড্রেসের কথা, প্রাইভেট পড়ানোর কথা, যাতায়াত খরচের কথা। সাথে যোগ হয় খাতা কলম আর গাইড নামের একটা বই।

মানুষ এখন দুর্মূল্যের বাজারে মহা বিপদে। এমনিতেই শহরের বাসা ভাড়া বছরে দুইবার করে বাড়ে। গ্যাস বিল আর বিদ্যুৎ বিল বাড়ার সাথে সাথে বাসা ভাড়াও হুরহুর করে বেড়ে যায়। সাথে খাওয়াদাওয়া, চিকিৎসা সহ সন্তানদের লেখাপড়া। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে দেশ যেমন এগিয়ে যাচ্ছে। সাথে এগিয়ে যাচ্ছে শিক্ষার মান উন্নয়ন। বাড়ছে শিক্ষার হার। আগেকার সময়ে কোনোএক গ্রামের একটা ছেলে মেট্রিক পাস করলে দশ গ্রামের মানুষ এসেছে তাকে দেখতে। আর এখন প্রতি ঘরে ঘরেই আইএ পাস, বিএ পাস, আর মাস্টার ডিগ্রি পাস। তাই বাড়ছে সন্তানের প্রতি পিতামাতারও দায়িত্ব কর্তব্য। সব পিতামাতাই চায় তার সন্তান লেখাপড়া শিখে মানুষের মতন মানুষ হোক। কিন্তু একজন গরিব মানুষ কি এরকম ব্যয়বহুল খরচ সামাল দিয়ে তার আদরের সন্তানকে লেখাপড়া শিখাতে পারবে? মনে হয় না। আবার প্রতিবাদও করা যাবে না মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী। এরজন্য কোন প্রতিবাদ করতে গেলেও হয় বিপদ। তখন প্রতিবাদকারির সন্তানরা থাকে তাদের টার্গেটে। স্কুলে পড়া অবস্থায় ওইসব ছাত্র-ছাত্রীরা স্কুল শিক্ষের অনুগত হতে পারেনা। তারা থাকে শিক্ষকদের লাল চোখের দৃষ্টিতে স্কুল কমিটির নজরে। কারণ একটাই, কেন করল ভর্তি ফি আর ফরম ফি নিয়ে বাড়াবাড়ি! তখন চলে অকারণে বেতের বারি, না হয় পরীক্ষায় ফেল। এমন ভয়ে কোনও অভিভাবক তাদের বিরুদ্ধে টু শব্দও করে না। কেউ কেউ ঋণের বোঝা মাথায় নিয়েও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার জন্য।

বর্তমানে আমাদের দেশে বছর শুরুতে দেখা যায় এই ভর্তি ফি'র আলামত। ভালো রেজাল্ট নিয়ে পাস করলেও পুনরায় ভর্তি ফি দিয়ে তাকে ভর্তি হতে হবে, নয়তো সে আর তার প্রিয় স্কুলে প্রবেশ করতে পারবে না। তার মানে হলো, একটা ছাত্র-ছাত্রী সারাবছর যা করেছে সবই মিছে।
প্রতিবছরই দেখা যায় এই আলামতের দৃশ্য, যা বছর শুরুতে পত্র-পত্রিকায় চোখ রাখলেই দেখা যায়। এর সাথে আবার যোগ হয়ে যায় কোচিং বাণিজ্যের খবরও। আগেকার সময়ে নামমাত্র ভর্তি ফি দিয়ে যারা লেখাপড়া করেছে, তাদের কি লেখাপড়া হয় নাই? তখন কি স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী বাৎসরিক পরীক্ষায় পাস করেনি? তখন কি প্রতিটি স্কুলের শিক্ষকেরা বিনা বেতনে চাকরি করেছিলো? নাকি এখনকার মতন যাবতীয় খরচাদি তখনকার শিক্ষকেরা বহন করেছিলো? আমার মনে হয় সবকিছু তখনকার সরকার বহন করেছিলো।

স্বীকার করি মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী, তখন এদেশে এতো এতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না। আর এখন কচু গাছের মতো যত্রতত্র অনেক অনেক সরকারি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। স্বীকার করি, যতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ততো শিক্ষার মান উন্নয়ন। তবে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী, এই শিক্ষার মান উন্নয়নের পাশাপাশি গরীবের নাভিশ্বাস, দীর্ঘশ্বাস, মরণফাঁদ সবই হচ্ছে। তার কিছু নমুনা দেখা যায় বছর শেষে ডিসেম্বর মাস হতে জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। ছাত্র-ছাত্রীরা স্কুল থেকে বিনামূল্যে নতুন বই হাতে পায়। নতুন বই হাতে পেয়ে অবুঝ মনা ছাত্র-ছাত্রীরা খুশিতে নাচতে থাকে। আর তাদের অভিভাবকরা কেঁদে কেঁদে চোখের জল ফেলে ঘরে বসে। বর্তমান দুরমূল্যের বাজারে ছেলে-মেয়েদের স্কুলে ভর্তি যেন গরিবের জন্য একপ্রকার মরণযন্ত্রণা। ডিসেম্বরে বেতন/ফরম ফি, আর জানুয়ারিতে ভর্তি ফি। এরপর ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ হতে না হতে শুরু হয় গাইড বই, নোট বই, খাতা কলমের কষাঘাত। আর ব্যাচ পড়া, কোচিং পড়ার বজ্রাঘাত। স্কুলে ক্লাস মাস্টারদের ব্যাচতো পড়তেই হবে, তা বাধ্যতামূলক। আর যারা স্কুল শিক্ষকদের ব্যাচে পড়বে না, সেসব ছাত্র-ছাত্রী পরীক্ষায় নম্বর কম পাবে। এরপরও তাদের পছন্দের কোচিং সেন্টারেও পড়তে বাধ্য করা হয় সময়সময়।

মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী, আমার এই লেখায় একজন রিকশা চালকের দুখের কথা তুলে ধরলাম।

গত ডিসেম্বর মাসে একজন পরিচিত লোক আমার কাছে এসেছে। তার মনের বিশ্বাস হলো, আমার কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নিতে পারবে। তার ছেলেমেয়ে দুটোর ফরম ফিলাপের জন্য দরকার ৬৪০০ টাকা দরকার। তার কাছে আছে মাত্র ৩০০০টাকা। বাদবাকি টাকাই এখন তাকে ধারকর্জ করতে হচ্ছে। কোথাও না পেয়ে শেষ অবধি এসেছে আমার কাছে। এসে বলছে, আমাকে ৩০০০টাকা ধার দিবেন? আমার স্ত্রীর বেতন হলে আপনার টাকা পরিশোধ করে দিবো। কি দরকারে ৩০০০টাকা? জানতে চাইলাম। বললেন, 'ছেলেমেয়ে দুজনেরই ফরমফিলাপ। টাকা জোগাড় না করতে পাড়লে ফরম ফিলাপ করতে পারবো না। আর ছেলেমেয়ে দুটোই পরীক্ষা দিতে পারবে না।'

মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী, এই বঙ্গদেশে ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে শুধু এই লোকটিই নয়। এর মতন আরও অনেক অনেক অসহায় লোক আছে। অনেকেই ফরম ফিলাপ আর ভর্তি ফির ছুরিকাঘাতে আহত। টাকার অভাবে ফরম ফি করা হয় না, ছেলেমেয়েদেরও আর পরীক্ষা দেওয়া হয় না। ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া না করাতে পেরে রোগে-শোকে হচ্ছে রোগাক্রান্ত। ছেলেমেয়েও হচ্ছে লেখাপড়া থেকে বঞ্চিত। একে তো ফরম/ভর্তি, তারপরে প্রাইভেট পড়া, নাহয় কোচিং অথবা ব্যাচ খরচ। তাহলে, একজন খেটে খাওয়া মানুষ কীভাবে এই দুর্মূল্যের বাজারে ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া করাবে? তারপরেও সবাই সন্তানদের লেখাপড়া করাতে চায়, শিক্ষিত করতে চায়। কিন্তু এই ব্যয়বহুল খরচের কারণে অনেকেই কুলিয়ে ওঠতে পারে না।

দূরদূরান্ত থেকে শহরে আসা মানুষগুলো পরের বাড়িতে থাকে ভাড়া। বিভিন্ন রকম কাজ করে দিনাতিপাত করে থাকে। কেউ একটা গার্মেন্টসের কর্মচারী, কেউ আবার রাস্তা নির্মাণ শ্রমিক। কেউ রাজ যোগালি, কেউবা ছোটখাটো কলকারখানার কর্মচারী, কেউ রিকশা চালক, কেউ অটো চালক। বেতন থাকে সামান্য, দৈনিক মুজরিও সীমিত। একটা সংসারে খানাওয়ালা থাকে, মা-ভাইবোন সহ থাকে পাঁচ থেকে ছয়জন। বর্তমানে পুরুষের পাশাপাশি মহিলারাও সমান তালে কাজ করে স্বামীর সংসারে যোগান দিচ্ছে। তাদের স্বপ্ন শুধু একটাই, তা হলো ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর স্বপ্ন। এই স্বপ্ন অনেকেরেই বাস্তবায়ন হয় না লেখাপড়ার ব্যয়বহুল খরচের কারণে।

একদিকে বছর শুরুতে সরকার দিচ্ছে বিনামূল্যে নতুন বই। অন্যদিকে ভর্তি ফি আর ফরম ফি বাবদ অভিভাবকদের পকেটের টাকা বিদ্যালয় থেকে কেড়ে নিচ্ছে। বিদ্যালয় থেকে শুধু বিনামূল্যে কয়টা নতুন পাওয়া যায়! এই নতুন বইয়ের সাথে যে আরও কতকিছু আছে, তা কেবল বুঝে ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবকরা। এসব খরচাদি সামাল দিতে একজন গরীব মানুষের অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়? এমন খরচ কি একজন গরীব অভিভাবকের গলার ফাঁস নয়? নাকি এই খরচ ডিজিটাল বাংলাদেশের দ্রব্যমূল্য উর্ধ্যগতির ধারাবাহিতা, মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী?