ফেলে দেওয়া চুল এখন অনেক মানুষের জীবিকা

নিতাই বাবু
Published : 3 Feb 2018, 09:01 PM
Updated : 3 Feb 2018, 09:01 PM

চুল সংগ্রহকারী বা চুল ফেরিওয়ালা। ছবিটি গোদনাইল আরামবাগ থেকে তোলা।

একসময় দেখা যেতো মা-বোনরা চিরনি দিয়ে মাথা আঁচড়াতো। একে অপরের চুল আঁচড়িয়ে দিতো। বিকালবেলা বাড়ির উঠোনে বা ঘরের বারান্দায় চলতো, চুল আঁচড়ানোর প্রতিযোগিতা। আঁচড়ানের সময় চিরনিতে কিছু ছেঁড়া চুল লেগে থাকতো। সেগুলো মুড়িয়ে থুতু দিয়ে ফেলে দিতো। সব মায়েরা ছেঁড়া চুলে থুতু দিয়ে ফেলতো কিনা তা জানা নেই। তবে হিন্দু ধর্মাবলম্বী মা-বোনরাই, ছেঁড়া চুল থুতু দিয়ে বেশি ফেলতো। ছেঁড়া চুলে থুতু না দিয়ে ফেললে নাকি, মাথার চুল ঝরে পড়ে যায়। এটা ছিল আগেকার বুড়ো বুড়িদের একটা কুসংস্কার রটানো কথা। আর পুরুষ মানুষের মাথার চুল কেটে সাধারণত ফেলেই দেওয়া হতো। পুরুষের কাটা চুল ফেলার কোনও নিয়মকানুন ছিল না, এখনো নেই। এখন নারীপুরুষের কারোর চুলই ফেলনা নয়। এগুলো এখন খুবই মূল্যবান জিনিস। সময়সময় দেখা যায়, শহরের চুল কাটার দোকান (সেলুন)-এর নিচ থেকে পরিত্যক্ত চুল অনেককে কুড়িয়ে নিতে। আবার গৃহিণী মা-বোনেরা তাদের মাথার পরিত্যক্ত চুল মুড়িয়ে রেখে দেয়, ঘরের কোণে বা কোনও পটের ভেতর। সময়মত এগুলো দিয়ে রাখা হয় নানারকম জিনিসপত্র সহ শিশুদের হরেকরকমের খেলনা।

কিন্তু আগেকার সময় কেউ ভাবেনি যে, এই ফেলে দেওয়া চুল একদিন বিদেশে রফতানি হবে। যা দিয়ে আমাদের দেশ আয় করবে বৈদেশিক মুদ্রা। এখন প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে যেসব প্রকার পণ্য বিদেশে রফতানি হচ্ছে, তার মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে ফেলে দেওয়া এই চুল। জানা যায় চুল রফতানি করেই প্রতিবছর দেশের আয় হচ্ছে, কোটি কোটি টাকারও বেশি। আবার এরমধ্যে জড়িয়ে আছে হাজার হাজার মানুষের জীবন জীবিকা। দূর হচ্ছে বেকারত্বের অভিশাপ, স্বাবলম্বী হচ্ছে অনেক মানুষ। মানুষের মাথার পরিত্যক্ত চুল এখন একরকম বিশেষ ধরনের রপ্তানি যোগ্য পণ্য।

প্রতিদিন বিভিন্ন পত্রপত্রিকার খবর পড়েও জানা যায়, এই ফেলে দেওয়া চুল ব্যবসার খবরাখবর। আবার স্বচক্ষে দেখাও যায়, শহরের অলিগলিতে ফেলে দেওয়া চুল সংগ্রহকারী ফেরিওয়ালাদের। তাদের কাছ থেকে জানা যায়, এই পরিত্যক্ত চুল ব্যবসার বিষদ বিবরণ ও এর ভেতরকার রহস্য। পরিত্যক্ত চুলকে ঘিরে দেশে গড়ে উঠেছে কয়েকশ' শিল্প প্রতিষ্ঠান। তাদের মতো অনেক মানুষ জীবিকা নির্বাহ করছে, এই চুল ব্যবসায় জড়িত থেকে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা, বিশেষ করে ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, যশোর, মাগুরা, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, মাদারীপুর থেকে শহরে আসছে এসব চুল সংগ্রহকারী দল। তারা জানায়, উত্তরাঞ্চলের দিনাজপুর, রংপুরসহ অনেক জেলাতেই গড়ে উঠেছে পরিত্যক্ত চুল শিল্প। ওইসব জেলাগুলোতে গড়ে উঠেছে, তিন শতাধিক চুল প্রক্রিয়াকরণ কারখানা। যারা উত্তরাঞ্চল জেলাশহর থেকে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায় আসছে, তারা ঘুরে ঘুরে চুল সংগ্রহ করে নিয়ে যায় উত্তরাঞ্চলে। সেখানে তাদের মহাজন আছে। মহাজনরা তাদের হাজার হাজার টাকা দাদন দিয়ে রাখে। যাতে সংগ্রহ করা চুল অন্য মহাজনের কাছে বিক্রি করতে না পারে। তারা ঘুরে ঘুরে পরিত্যক্ত চুল সংগ্রহ করে প্রতিমাসে একবার মহাজনের কাছে যায়। সংগ্রহ করা চুল বুঝিয়ে দিয়ে, তাদের পাওনা বুঝে নিয়ে আবার চলে আসে বিভিন্ন জেলাশহরে।

উত্তরাঞ্চলীয় ওইসব চুল আড়তদার মহাজনরা দাদন দিয়ে অনেক গরিব লোককে বিভিন্ন জেলাশহরে পাঠায়। পাঠায় এই কারণে যে, শহর থেকে চুল সংগ্রহ করে তাদের কাছে পৌঁছানোর জন্য। বিনিময়ে গরিব মানুষগুলো পাবে তাদের ন্যায্য পারিশ্রমিক, মহাজনরা করবে অধিক মুনাফা। করছেও তা-ই। তাদের থেকে দাদন নিয়ে অনেকেই চুল সংগ্রহের জন্য আসছেও শহরে। তাঁরা শহরে এসে প্রথমে একটা বাসা ভাড়া নেয়। তারপর ধারেকাছের একটা মার্কেট থেকে মেয়েদের মাথার ব্যান্ড, কিছু শিশু খাবার, রঙবেরঙের বেলুন, ক্লিপ, চিরুনি, চুলেরকাঁটা, ফিতা, কাচের চুড়ি, বেলুন, বাদামভাজা কিনে আনে। এগুলোই হচ্ছে, চুল সংগ্রহকারীদের মূল চালান। এগুলো একটা চালের প্লাস্টিকের ব্যাগের বাইর সাইটে সেফটিপিন দিয়ে আটকায়। ব্যাগের দুইদিকেই ঝুলানো থাকে পোলাপানের খেলনা, মাথার ব্যান্ড, আর মহিলাদের সাজগোছের মালামাল। একহাতে থাকে ব্যাগ, আরেক হাতে একটা ছোট আকারের ফুলানো বেলুন। মহল্লার ভেতরের গলিতে গিয়ে ডাক দিচ্ছে, 'চুল আছে…চুল'।

কেউ কেউ একটা টুকরিতে করে করে মালামাল নিয়েও পাড়া মহল্লায় ঘুরে বেড়ায়। আর ফুলানো বেলুনে বারবার ঘষা দেয়। বেলুনে ঘষা দেওয়ার সাথে সাথে প্যাঁচপ্যাঁচ করে শব্দ হয়। বেলুনের প্যাঁচপ্যাঁচ শব্দ শুনে বাসাবাড়ির ছোটছোট ছেলেমেয়েরা মায়েদের জমানো চুল নিয়ে এদের সামনে আসে। ছেলেমেয়েদের হাতের মুঠোতে থাকে মা-বোনদের মাথার পরিত্যক্ত চুল। সামান্য একটু চুল হলেও, চুল সংগ্রহকারীরা ওদের ফেরায় না, রেখে দেয়। চুল সংগ্রহকারীদের কাছে একটুখানি চুল মানে অনেককিছু। গৃহিণী মায়েদের কাছে ফেলনা হলেও, চুল সংগ্রহকারীদের কাছে তা অনেক মূল্যবান। কারণ, প্রতি কেজি পরিত্যক্ত চুলের মূল্য ১৫-২০ হাজার টাকা। জানা যায় চুল সংগ্রহকারীদের কাছ থেকে।

চুল সংগ্রহকারী বা চুল ফেরিওয়ালা। ছবিটি গত কয়েকদিন আগে গোদনাইল আরামবাগ একটি বাড়ি থেকে তোলা।

একদিন সকালবেলা বাসার সামনে এক লোক বসে আছে। তার সামনে একটা ব্যাগ, আর একটা কাঠের ঢালার মতন। ব্যাগের দুপাশে নানারকম খেলনা আর মেয়েদের মাথার রঙবেরঙের ব্যান্ড সেফটিপিন দিয়ে আটকানো। ঢালাতে আছে শিশুদের নানারকম খাবার। বাড়ির অনেক মহিলারা মুটমুট করে চুল এনে দিচ্ছে লোকটাকে। লোকটা যাকে যা দিয়ে পারছে, বিদায় করছে। কাউকে দিচ্ছে মাথার ব্যান্ড, কাউকে দিচ্ছে কাচের চুড়ি, কাউকে চকলেট। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ দেখলাম। সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম আপনার বাড়ি কোথায়? বললেন, ঝিনাইদহ। এখানে কতদিন যাবত? বললেন, নতুন এসেছি। তা মাসখানেক হবে। এমন আরও অনেক কথা জিজ্ঞেস করলাম। উত্তর দিলেন ঠিকঠিক। তাঁরা মাসে একবার দেশের বাড়িতে যায়। সাথে নেয় শুধু সংগ্রহ করা চুল। মাসের ৩০ দিন শহরের আনাচেকানাচে ঘুরে ঘুরে চুল সংগ্রহ করে। পাড়া মহল্লায় ঘুরে পরিত্যক্ত চুল পাওয়া যায় দেড় থেকে দুই কেজি। এই দেড় দুই কেজি চুল সংগ্রহ করতে তাদের খরচ হয়, ৪-৫হাজার টাকা। তারা মহাজনের কাছ থেকে পাইকারি দরে পেয়ে থাকে, গড়ে প্রতি কেজি ১৪-১৫ হাজার টাকা। অনেক মুনাফা অর্জনকারী ব্যবসা এই চুলের ব্যবসা। শহর থেকে সংগ্রহ করে নেওয়া চুল যাচাইবাছাইয়ের পর, এগুলো প্রক্রিয়াজাতকরণ করা হয়।

জানা যায় প্রক্রিয়াজাত করার ফলে একদিকে হয় না পরিবেশ দূষণ। অন্যদিকে আর্থিক লাভবান হচ্ছে চুল ব্যবসায়ীরা। সাথে লাভবান হচ্ছে, গ্রাম গঞ্জের আনাচেকানাচে ঘুরে বেড়ানো চুল সংগ্রহকারীরাও। যেসব ব্যক্তি সারাদিন দুবেলা খেতে পারতো না, আজ তাঁরা চুল সংগ্রহ করে তিন বেলাই পেট ভরে খেতে পারছে। স্বাবলম্বী হচ্ছে অনেক মানুষ। দূর হচ্ছে বেকারত্ব, বাড়ছে কর্মসংস্থান। কীভাবে পরিত্যক্ত চুল প্রক্রিয়াজাত করা হয় জানতে চাইলে লোকটি বলেন, 'প্রথমে জট পাকানো চুল সুচ দিয়ে জট ছাড়ানো হয়। এরপর উন্নতমানের শ্যাম্পু দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে রোদে শুকানো হয়। শুকানোর পর দৈর্ঘ্য অনুযায়ী প্যাকিং করা হয়। সর্বনিম্ন ৮ ইঞ্চি থেকে শুরু করে ৩০ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা চুল বাজারজাত করা হয়। ৮ থেকে ১০ ইঞ্চি পর্যন্ত প্রতি কেজি চুল বিক্রি হয়, ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। এভাবে প্রতি ২ ইঞ্চি বেশি দৈর্ঘ্যের চুল, প্রতি কেজি দেড় হাজার টাকারও বেশি দরে বিক্রি হয়। এভাবে ২৮ থেকে ৩০ ইঞ্চি পর্যন্ত প্রতি কেজি চুল বিক্রি হয়, ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকায়। আবার যারা এসব চুল প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্রে কাজ করছে, তাঁরা প্রতিদিন আয় করছে, (দৈনিক মুজরি হিসেবে) ২০০-২৫০ টাকা। এসব প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্রে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও রীতিমতো কাজ করছে।'

সেজন্যই আগেকার পরিত্যক্ত এই চুল, এখনকার দিনে আর ফেলনার বস্তু নয়। এই পরিত্যক্ত চুল যাচাইয়ের পর চলে যায় চীন, কোরিয়া, মিয়ানমারসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। ওইসব দেশের ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে বৈধ পথেই, এসব চুল কিনে নিয়ে যাচ্ছে। ধারনা করা যায়, বিদেশে এসব চুল দিয়ে বিভিন্নরকম ক্যাপ, পরচুলা ও টাক মাথায় হেয়ার প্ল্যান্টেশনসহ আরও নানা কাজে ব্যবহৃত হয়। তাই পরিত্যক্ত চুলের ব্যবসায় পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও দিনদিন স্বাবলম্বী হচ্ছে। বেকারত্ব দূর হচ্ছে। কর্মসংস্থান বাড়ছে। সাথে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। স্বনির্ভর হবে আমাদের দেশ।