প্যাকেটের কি মিষ্টির সমপরিমাণ মূল্য হতে পারে?

নিতাই বাবু
Published : 7 April 2018, 04:21 AM
Updated : 7 April 2018, 04:21 AM

আমাদের পরিচিত খাবারের মধ্যে মিষ্টি অতি জনপ্রিয় একটি খাবার। আদর-আপ্যায়ন সহ যে কোন অনুষ্ঠানে মিষ্টি ছাড়া চলেই না। যে কোন নিমন্ত্রণে অংশ নিতে চাইলে মানুষ প্রথমে যায় মিষ্টির দোকানে, অতঃপর মিষ্টি কিনে যায় নিমন্ত্রিত অনুষ্ঠানে। এমনকি যে কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠানেও মিষ্টির বিকল্প যেন কিছু নেই। বাঙালিদের মধ্যে মিষ্টি খায় না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। বর্তমানে দেশে ছোট-বড় নির্বিশেষে ডায়াবেটিস রোগের ছড়াছড়ি। ডায়াবেটিস আক্রান্ত হলে ডাক্তার প্রথমেই মিষ্টি খেতে বারণ করে। কিন্তু মিষ্টির লোভ সামলাতে না পেরে ডাক্তারের নির্দেশনা না মেনে গোপনে গোপনে অনেক রোগীই মিষ্টি খায়। যেন মিষ্টির নাম শুনলেই সবার জিভে জল এসে যায়। নিয়মিত আপ্যায়ন ও নিমন্ত্রণ ছাড়াও মিষ্টির অনেক অত্যাবশ্যক ব্যবহার সম্পর্কেও আমরা জানি।

মিষ্টির রয়েছে বিভিন্ন রকমফের। নাম ও স্থান ভেদে প্রসিদ্ধি পেয়েছে বিভিন্ন প্রকারের মিষ্টি। এই যেমন-মেহেরপুরের সাবিত্রী ও রসকদম্ব, গাইবান্ধার রসমুঞ্জরী, নাটোরের কাঁচাগোল্লা, টাঙ্গাইলের চমচম, যশোরের রসগোল্লা, কুষ্টিয়ার স্পেশাল চমচম, মুক্তাগাছার মন্ডা, নওগাঁর প্যারা সন্দেশ, রাজশাহীর রসকদম, নওগাঁর প্যারা সন্দেশ, কুমিল্লার রসমালাই, কলাপাড়ার রসগোল্লা, শাহজাদপুরের রাঘবসাই, নেত্রকোণার বালিশ মিষ্টি, মুন্সীগঞ্জের আমৃতি, রাজবাড়ীর চমচম, মাদারীপুরের রসগোল্লা, সাতক্ষীরার সন্দেশ, সিরাজদিখানের পাতক্ষীরা, যশোরের খেজুরের গুড়ের প্যারা সন্দেশ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছানামুখি, পাবনার প্যারা সন্দেশ, সিরাজগঞ্জের পান্তুয়া, টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম, বগুড়ার দইয়ের খ্যাতি দেশজোড়া।

এই বিশাল চাহিদার ও বিভিন্ন প্রকারের মিষ্টি তৈরি ও  বিপণনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে লাখো মানুষের সংসার। এই মিষ্টি বিপণনের জন্য প্রয়োজন হয় প্যাকেজিংয়ের। কিন্তু এই প্যাকেজিংয়ের অবস্থা কিন্তু সুখকর নয়। অনেক সময় এর প্যাকেটগুলো দেখলে শরীর জ্বলে। কিন্তু অসহায় হয়ে পাথরের মতো ওজনের মিষ্টি প্যাকেট মিষ্টির সমমূল্য দিয়েই কিনতে হয়!

এক কেজি মিষ্টি ধারণ ক্ষমতার একেকটি প্যাকেটের ওজন ১৫০ গ্রাম! এক কেজি মিষ্টি কিনলে প্যাকেটের দাম পড়ে ৩০ টাকা! ছবিটি গোদনাইল লক্ষ্মীনারায়ণ বাজার থেকে তোলা।

ফল বিক্রেতাদের ক্ষেত্রেও আমরা দেখি তাদের ঠোঙাগুলো শীল পাথরের মতন ভারী। ঠোঙার নিচে শক্ত ও ভারী এক প্রকার কাগজের বোর্ড লাগানো থাকে। এসব ঠোঙার প্রতিটির ওজন হয়ে যায় ১০০ থেকে ১৫০ গ্রাম! কিন্তু মানুষ অসহায় হয়ে মান-সম্মানের ভয়ে তর্কে  না গিয়ে তা মেনে নেয়।

একই ভাবে মিষ্টির দোকানেও মিষ্টি ওজনে কম দিয়ে মুনাফা করতে ভারী প্যাকেট ব্যবহার করা হয়। দোকানীরা এই প্যাকেট ছাড়া মিষ্টি বিক্রিই করে না। যদি কেউ আগেকার নিয়ম অনুসরণ করে মাটির হাড়ি কিনে মিষ্টির দোকানে যায়, তাহলেও মিষ্টির দোকানদার মিষ্টি বিক্রি করতে চায় না। তখন মিষ্টির দাম ধরা হয় অন্যভাবে, কেজিপ্রতি দাম বেড়ে যায় ২৫ থেকে ৩০ টাকা। বুঝাই যায়, দাম বাড়ার কারণ হলো ঐ প্যাকেট। প্রতিটি প্যাকেটের ওজন গড়ে ১৫০ থেকে ২০০ গ্রাম হয়। এখন এক কেজি মিষ্টির দাম যদি ২০০ টাকা হয়, তবে প্যাকেটের দামও রাখা হয় ঐ ২০০ টাকা হারে। তাহলে একটা এক কেজি ধারণক্ষমতার ১৫০ গ্রামের প্যাকেটের দাম পড়ে ৩০ টাকা আর ২০০ গ্রাম ওজনের প্যাকেটের দাম হয় ৪০ টাকা!

অন্যদিকে আমরা দেখি, এই প্যাকেটগুলো দোকানীরা পিস হিসেবে ৫ টাকা থেকে ৭.৫০ টাকা হারে কিনে আনে। তাহলে কাস্টমারকে ঠকিয়ে শুধু প্যাকেট দিয়ে একজন দোকনদার গড়ে ২৫ থেকে ৩৫ টাকা লাভ করে! এই হলো মিষ্টির দোকানদারদের হিসাব। তাই তারা প্যাকেট সহ ওজন করে মিষ্টি বিক্রি করে, অন্যথা বিক্রি করতে চায় না।

তাই কেউ যদি দোকানীকে বলে যে, "আপনাকে প্যাকেটের মূল্য আলাদা দেওয়া হবে। আপনি শুধু দুই কেজি মিষ্টি আমাকে ওজন করে দিন।" এভাবে শত কান্নাকাটি করলেও মিষ্টির দোকানদার ওই ক্রেতার কাছে প্যাকেট ছাড়া মিষ্টি বিক্রি করবে না। কারণ একটাই, এখানে আছে ২০০ গ্রাম ওজনের ব্যাপার-স্যাপার।

মিষ্টি কেনার সময় প্যাকেটের এই দুইটি অংশই একসাথে করে মিষ্টি ওজন করা হয়। গোদনাইল লক্ষ্মীনারায়ণ বাজার থেকে ছবিটি তোলা।

মিষ্টির প্যাকেটের এই জোচ্চুরি যেন মরার উপর খাঁড়ার ঘা। তবু কিছুই করার নেই, মনে হয় দেখারও কেউ নেই। যেসব মানুষ মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আয় রোজগার করে তাদের দুইটি পয়সার জন্যও জ্বালা থাকে। অনেক সময় দেখা যায় হাট-বাজারে ভ্রাম্যামান আদালত বসে। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব ঘুরে ঘুরে তল্লাশি চালিয়ে দেখে কোনো পণ্যে ভেজাল আছে কিনা, দোকানদার বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বেআইনি কিছু করছে কিনা, ক্রেতাকে ঠকাচ্ছে কিনা? যদি এরকম কিছু ধরা পড়ে তাহলে জেল-জরিমানা হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই মিষ্টির প্যাকেটের দিকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারকরা একটু ফিরেও তাকায় না।

যে যুগে একটা পণ্য কিনলে আরেকটা 'ফ্রি' পাওয়া যায়, সে যুগে মিষ্টির দোকানদাররা চাপাতি দিয়ে হরদম 'কোপ' মারছে ক্রেতার গায়ে! তাই প্রশ্ন রাখছি, মিষ্টির প্যাকেটের কি মিষ্টির সমপরিমাণ মূল্য হতে পারে? কবে এই জচ্চুরি বন্ধ হবে? কবে মানুষ সঠিক ওজনে মিষ্টি পাবে?