লক্ষ্মীনারায়ণ জিউর আখড়ার পুকুরটি রক্ষা করতেই হবে

নিতাই বাবু
Published : 24 April 2018, 03:38 PM
Updated : 24 April 2018, 03:38 PM

নারায়ণগঞ্জের ইতিহাস ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে, শ্রী শ্রী রাজা লক্ষ্মীনারায়ণ জিউর বিগ্রহ মন্দির বা লক্ষ্মীনারায়ণ জিউর আখড়া। সেইসাথে মিশে আছে রাজা লক্ষ্মীনারায়ণ জিউর আখড়ার পবিত্র পুকুরটিও। প্রায় ২৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে দাঁড়িয়ে আছে, এই রাজা লক্ষ্মীনারায়ণ জিউর বিগ্রহ মন্দিরটি। অনেক আগে থেকেই স্থানীয় মানুষের কাছে এটি লক্ষ্মীনারায়ণ জিউর আখড়া বা দেওভোগ আখড়া নামে পরিচিত। নারায়ণগঞ্জের ইতিহাস বলতে গেলে, বেশিরভাগ মানুষেই এই আখড়াটির নামই প্রথম মুখে আনে। নারায়ণগঞ্জের ইতিহাস অনেকে বলতে পারলেও, নতুন প্রজন্মের কাছে এই আখড়ার ইতিহাস আজও অজানা।


ঐতিহ্যবাহী শ্রী শ্রী রাজা লক্ষ্মীনারায়ণ জিউর আখড়া বা দেওভোগ লক্ষ্মীনারায়ণ জিউর আখড়া

নারায়ণগঞ্জ ও রাজা লক্ষ্মীনারায়ণ জিউর আখড়ার ইতিহাস: জানা যায় রাজা লক্ষ্মীনারায়ণ জিউর বিগ্রহ মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয় ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে। আর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পিছনেও রয়েছে নানা ইতিহাস। রাজা লক্ষ্মীনারায়ণ জিউর বিগ্রহ মন্দির নামকরণ করা হলেও, এর উদ্যোক্তা ছিলেন বিখন লাল পাণ্ডে বা বিকন লাল পান্ডে। তিনি সাধারণ মানুষের কাছে বেণুর ঠাকুর নামেও পরিচিত ছিলেন। তিনি বাংলার শেষ নবাব সিরাজদ্দৌলার বিশ্বাস ঘাতক ঘনিষ্ঠ জনের একজন জগৎ শেঠ এবং ব্রিটিশ আমলে ঢাকা শাখার (ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি) ম্যানেজার পদে দায়িত্বরত ছিলেন। সেই সময়ে ব্রিটিশরা কোনোএক বিপদের আশঙ্কা টের পেয়ে ঢাকা ছেড়ে কলকাতায় চলে যান। কিন্তু তাদের সম্পদ রয়ে যায় বিখন লাল পাণ্ডের কাছে। বিখন লাল পাণ্ডে মীর জাফরের আওতাধীন হওয়া সত্ত্বেও তাকে সম্পদ ও অর্থলোভে গ্রাস করতে পারেনি। তিনি গচ্ছিত সম্পদের কাগজপত্রগুলো লুকিয়ে রাখেন লালবাগ কেল্লার কোনো একটি অংশে। ব্রিটিশরা ফিরে আসার পর বিখন লাল পাণ্ডে তাদের সম্পদ পুরোপুরিভাবে বুঝিয়ে দেন। বুঝিয়ে দেওয়ার মধ্যে হিসেবে কোনো গরমিল ছিল না।

তাই ব্রিটিশ শাসক দল (ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি) খুশি হয়ে বিখন লাল পাণ্ডেকে পুরস্কার দিতে চান। বিখন লাল পাণ্ডে তখন ব্রিটিশদের কাছে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে একটি মন্দির স্থাপনের ইচ্ছে প্রকাশ করেন। ব্রিটিশরা (ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি) তার ইচ্ছানুসারে ১৭৬৬ খ্রিস্টাব্দে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরবর্তী এলাকার জমিগুলো রাজা লক্ষ্মীনারায়ণ নামে দেবোত্তর সম্পত্তি হিসেবে দলিলের মাধ্যমে লিখে দেন। সাথে মন্দির নির্মাণের খরচ জোগার করার জন্য তৎকালীন খিদিরপুর বর্তমান মুন্সিগঞ্জ, নরসিংদী সহ কিছু এলাকার জমিদারির দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন। সেই থেকে পরবর্তীকালে এ স্থানের নাম হয় নারায়ণগঞ্জ।

এতকিছুর পরও বিখন লাল পাণ্ডে এই বিশাল সম্পত্তি তাঁর নিজের নামে লিখে নেননি। নিয়েছেন তাঁর গুরু প্রভু নারায়ণের নামে। তারপর বিখন লালা পাণ্ডে শুরু করেন মন্দির নির্মাণের কাজ। তিনি নারায়ণগঞ্জের দেওভোগ এলাকায় তাঁর গুরু প্রভু নারায়ণের নামে প্রতিষ্ঠা করেন, শ্রী শ্রী রাজা লক্ষ্মীনারায়ণ জিউর বিগ্রহ মন্দির। যা এখন নারায়ণগঞ্জবাসীর কাছে সোজা কথায় লক্ষ্মীনারায়ণ জিউর আখড়া নামে পরিচিত। রাজা লক্ষ্মীনারায়ণ জিউর বিগ্রহ মন্দির প্রতিষ্ঠা করার পর, মন্দিরের একপাশে পূণ্যার্থীদের স্নান করার জন্য একটি বিশালার পুকুরও খনন করেন। যেই পুকুরটি বর্তমানে দেওভোগ লক্ষ্মীনারায়ণ জিউর আখড়া পুকুর নামে পরিচিত। পুকুরটি অনেক বড়, তাই অনেকে এই পুকুরটিকে লক্ষ্মীনারায়ণ আখড়ার দীঘিও বলে।

ছবিতে দেখা যায় ঐতিহ্যবাহী শ্রী শ্রী রাজা লক্ষ্মীনারায়ণ জিউর আখড়া ও পুকুরটির বর্তমান দুরাবস্থার চিত্র

পুকুরটির বর্তমান অবস্থা: কিছুদিন আগে একটা জরুরী কাজে এই রাজা লক্ষ্মীনারায়ণ জিউর বিগ্রহ মন্দিরে গিয়েছিলাম। মন্দিরে যাবার আগে নিজেকে পবিত্র করার জন্য পুকুরপাড়ে যাই। উদ্দেশ্য হাত মুখ ধুয়ে মন্দিরে প্রবেশ করবো। কিন্তু না, হাত মুখ ধুতে পারিনি। কারণ, পুকুরটির কোনও তিল পরিমাণ জায়গা খালি নেই। শুধু ময়লা আবর্জনা আর কচুরিপানার সাথে কবুগাছ। একটা সিঁড়ি ঘাটলাও খুঁজে পানিনি, হাত মুখ ধোয়ার জন্য। শেষমেশ একটা চায়ের দোকান থেকে এক গ্লাস জল নিয়ে হাত মুখ ধুয়ে মন্দিরে প্রবেশ করি। আগেকার সময়ে এই মন্দিরে বা আখড়ায় সাধারণ মানুষ আর পূণ্যার্থীরা এই পুকুরে স্নান করে_না হয়, হাত মুখ ধুয়ে মন্দিরে যেতো। মন্দিরের যাবতীয় ধোয়ামোছার কাজও এই পুকুরে হতো। বড়দের মুখে শোনা সেই কথা আজও মনে আছে বলেই, হাত মুখ ধোয়ার জন্য পুকুরপাড়ে গিয়েছিলাম। কোনো এক সময় নিজেও এই পুকুরে সকাল বিকাল স্নান করেছি। যখন আমরা সপরিবারে লক্ষ্মীনারায়ণ জিউর আখড়ার সন্নিকটে নন্দিপাড়া থাকতাম। সময়টা ছিল ১৯৮৫-৮৬ খ্রিস্টাব্দে।

নন্দিপাড়া আর দেওভোগ পাশাপাশি মহল্লা। কিছুদিন আগেও দেওভোগ, উকিলপাড়া, গোয়ালপাড়া, পালপাড়া, নন্দিপাড়ার মানুষ এই লক্ষ্মীনারায়ণ জিউর আখড়ার পুকুরেই স্নান সহ ধোয়ামোছার কাজ করতো। প্রতিদিন ভোররাত থেকে মাঝরাত পর্যন্ত এই পুকুরের চারদিকের ঘাটলায় থাকতো মানুষের ভিড়। নতুন কেহ পুকুরটির সামনে গেলে মনে করতে এটা একটা পবিত্র পুকুর। কারণ, পুকুরের স্বচ্ছ জল আর চারপাশেই ছিল হিন্দুদের জনবসতি। অনেক সময় হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা পুকুরপাড়ে গঙ্গা পূজাও করতো। পূজা শেষে পূজার যাবতীয় উপকরণ ফুলফল এই পুকুরে ভাসিয়ে দিতো। তাই এখনো অনেকের কাছে এই পুকুরটি পবিত্র একটা পুকুর হিসেবেই রয়ে গেছে। আসলেও অনেক আগে এটি পবিত্র পুকুরই ছিল। ছিল এই কারণে যে, কোনোএক সময় কারোর বিয়ে শাদির অতিথি সেবার জন্য থালাবাসনও পুকুর থেকে উঠতো। অনুষ্ঠান শেষে সেসব জিনিসপত্র ধুয়ে মুছে আবার পুকুরে ভাসিয়ে দিতো। এসব কাহিনী শোনা যায়, পুকুর সংলগ্ন পুরানো বসবাসকারীদের মুখে।

ছবি দেখে মনে হয় এটি একটা পরিত্যক্ত জমি। আসলে এটি নারায়ণগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী শ্রী শ্রী রাজা লক্ষ্মীনারায়ণ জিউর আখড়া পুকুর বা দীঘি।

বর্তমানে নারায়ণগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী পুকুরটি বাঁচতে চায়: এই পুকুরটি কোনও সময়ও কেউ পুরোপুরিভাবে সেচতে পারেনি। এসব কথাগুলো শুনেছি বুড়ো বুড়িদের কাছ থেকে। আর এতো বড় পুকুর পুরো নারায়ণগঞ্জ শহরে দ্বিতীয়টি ছিলো না, এখনো নেই। কোনও লোক সাঁতার দিয়ে পুকুরটি এপার থেকে ওপারে যেতে ভয়ে সাহসও পায়নি।

তবে এখন আর কোনও মানুষ এই পুকুরটিতে পা ধুতেও পারে না। এখন পুরো পুকুরটি দেখা যায় একটা খেলার মাঠের মতন। খেলার মাঠে যেমন থাকে সবুজ ঘাস! আর পুরো পুকুরটিতে এখন সবুজ কচুরিপানা সহ কচুগাছ। দেখে মনে হয় কেউ যেন পুকুরটিতে কচুগাছের চাষ করেছে। পুকুরটিতে তিল পরিমাণ জায়গা খালি নেই, শুধু কচুরিপানা আর বড়বড় কচুগাছ। চারদিকের স্নান করার একটা সিঁড়ি ঘাটলার চিহ্নও নেই। আছে শুধু ময়লা আবর্জনার স্তুপ। পুকুরের চারপাশে মানুষের ফেলা এতো ময়লা আবর্জনা দেখে মনে হয়, আর কয়েক বছরের মধ্যে পুকুরটি ভরাট হয়ে যাবে। পুকুরের সামনে গেলে দেখা যায়, পুকুরটি মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। পুকুরটির কান্না শুনতে পাওয়া যায়। পুকুরটি বাঁচতে চায়।

মেয়র আইভীর হস্তক্ষেপে বেঁচে যাওয়া একটি পুকুরের গল্প: সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন গোদনাইল চিত্তরঞ্জন কটন মিলের একটা পুকুরটি আছে। ১৯৮০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে মিলটি বন্ধ হয়ে যায়। পুকুরটি হলো মিলের বাউন্ডারির বাইরে। পুকুরটি চিত্তরঞ্জন কটন মিলের হলেও, এটি ছিল মিলের আশেপাশের এলাকার মানুষের প্রাণ। কয়েক বছর আগে থেকে মিল কর্তৃপক্ষ মিলের সমস্ত সম্পত্তি প্লট আকারে বিক্রি করার ঘোষণা দেয়। সেইসাথে প্লটের সীমানা নির্ধারণও করে ফেলে। পুকুরটিও হয়েছে দুইটি প্লট। মিল কর্তৃপক্ষের এহেন কার্যকলাপে এলাকার জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি হতে থাকে। শুরু হয় আন্দোলন মানববন্ধন সহ আরও অনেককিছু। এই নিয়ে এলাকার অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি এর প্রতিবাদও জানায়। কিন্তু মিল কর্তৃপক্ষ কিছুতেই পুকুরের সম্পত্তি ছাড়তে চাচ্ছিলেন না।

এটি হলো নারায়ণগঞ্জ সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন চিত্তরঞ্জন কটন মিলের পুকুর। যেটি গত কয়েকমাস আগে মাননীয় মেয়র মিল কর্তৃপক্ষের সাথে আলাপ করে জনগণের জন্য বাঁচিয়ে রাখে। এটি এখন গোদনাইল এলাকার একটা পর্যটন এলাকার মতন।

খবর পৌঁছে যায় মাননীয় সিটি মেয়রের কাছে। খবর পেয়ে ছুটে আসেন নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মাননীয় মেয়র। তিনি এলাকার কাউন্সিলর ও রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গদের সাথে নিয়ে, মিল কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে। আলাপ আলোচনার পর এলাকার জনগণের স্বার্থে পুকুরটি বাঁচিয়ে রাখে। পুকুরটির সাথে বেঁচে যায়, মন্দির, মসজিদ, স্কুল ও একটা ফুটবল খেলার মাঠ। তারপর পুকুরটিকে নতুন সাজে সাজাতে শুরু করে। প্রায় পাঁচ ছয়মাস ধরে চলতে থাকে পুকুর সংস্কারের কাজ। পুকুরের চারটি পাড় নতুন করে বাঁধাই করা হয়। লাগানো হয় শখানেক লাইট পোস্ট। রাস্তায় বিছানো হয় টাইল। চারদিকে রোপণ করা হয় নানা জাতের নামীদামী গাছ সহ ফুলের গাছ। বর্তমানে চিত্তরঞ্জন পুকুরপাড় হলো গোদনাইল এলাকার একটা পর্যটন এলাকা। পুকুরপাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতিদিন সন্ধ্যার পর নামে মানুষের ঢল।

দেওভোগ লক্ষ্মীনারায়ণ জিউর আখড়ার পুকুরটি বাঁচাতেও চাই এমন পদক্ষেপ। 

নারায়ণগঞ্জের দেওভোগ থেকে চিত্তরঞ্জন কটন মিলের পুকুরটির দূরত্ব হলো প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার। আর রাজা লক্ষ্মীনারায়ণ জিউর বিগ্রহ মন্দিরের পুকুরটি  নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের বাড়ির উঠোনের সামনেই। আমার বিশ্বাস, তিনি প্রতিদিন সকালবিকাল নগর ভবনে থেকে এই পুকুরপাড় দিয়েই গাড়ি নিয়ে আসা-যাওয়া করে থাকেন।

বর্তমানে পুকুরটির এতোই দুরাবস্থা যে, তা দেখেই অনুমান করা যায়, কয়েকবছরের মধ্যে হয়তো পুকুরটি একেবারে হারিয়ে যাবে। সেইসাথে পুকুরপাড় এলাকার লক্ষ মানুষের সমস্যাও অনুমান করা যায়।

এই পবিত্র পুকুরটি রক্ষা করার দাবি জানালাম।লক্ষ মানুষের সুবিধার্থে চিত্তরঞ্জন কটন মিলের পুকুরটির মতো এই পুকুরটিকেও বাঁচিয়ে রাখতে ব্যবস্থা গৃহিত হোক। পুকুরটিও বেঁচে থাকুক, দেওভোগ এলাকার মানুষের সমস্যাও দূরিভূত হোক।