করোনাভাইরাসের দুঃসময় ও পরের ভাবনা

বিভুরঞ্জন সরকারবিভুরঞ্জন সরকার
Published : 16 Jan 2012, 02:42 AM
Updated : 12 May 2020, 09:45 AM

পৃথিবী এক নতুন কিন্তু ভয়াবহ অবস্থার মুখোমুখি হয়েছে। এর আগে কখনও পৃথিবীর সব মানুষ একই সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে একই আতঙ্কে বিপর্যস্ত হয়নি, একই অনিশ্চয়তায় বিষণ্নবোধ করেনি। এই ভূমণ্ডল গত বছরের শেষ দিকে এমন এক শত্রুর কবলে পড়েছে যে শুধু অপরিচিতই নয়, অদৃশ্যও। করোনাভাইরাস নামের এই শত্রু পৃথিবীর মানব প্রজাতির বিরুদ্ধে হত্যার পরোয়ানা নিয়ে ছুটে চলেছে এক দেশ থেকে আরেক দেশে। জ্ঞান-বিজ্ঞান নিয়ে মানুষের এত গর্ব, এত অহংকার সব ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে করোনাভাইরাস। তার সংহাররূপ দেখে সবাই ভীত, বিচলিত, আতঙ্কিত। করোনার জেদ, সে মানুষকে মারবেই। মানুষের জেদ, সে বেঁচে থাকবে। মানুষ পরাজিত হতে জানে না। হোঁচট খায়, বাধা পায়, মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায় কিন্তু ভোলে না জীবনের জয়গান গাইতে। এবার দেখার বিষয় করোনা-যুদ্ধ জয়ে মানুষ কতটা ক্ষতির বিনিময় কী উপায়ে জয়লাভ করে।

এখন পর্যন্ত করোনাকে প্রতিহত বা পরাস্ত করার অস্ত্র অর্ৎ টিকা, ভ্যাকসিন বা অন্য ওষুধ আবিষ্কার না হলেও অচিরেই যে তা আবিষ্কৃত হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। চেষ্টা চলছে। আশার আলো সুড়ঙ্গের শেষে দেখা যাচ্ছে। যতদিন পর্যম্ত প্রতিষেধক বের না হয় ততদিন পর্যন্ত করোনাভাইরাসকে নিয়েই আমাদের বাঁচতে হবে। সহাবস্থান করতে হবে। তবে চরম হতাশ না হওয়ার পক্ষে আপাতত যুক্তি এটাই যে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া মানেই মৃত্যু নয়। প্রতিদিন যেমন মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন, মৃত্যুবরণ করছেন, তেমনি সুস্থ্যও হয়ে উঠছেন। মৃতের চেয়ে সুস্থ্য হয়ে ওঠার সংখ্যাই বেশি। আমরা শুধু মৃত্যু নয় জীবনকেও দেখতে চাই।

পৃথিবীতে প্রতি বছরে ৬ কোটি মানুষ মারা যায়। ৭০ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয় সংক্রামক ব্যাধিতে। ক্যান্সার ও হৃদরোগে মারা যায় ৩ কোটি মানুষ। কিন্তু এসব মৃত্যু আমাদের আতঙ্কিত করে না কারণ এসব মৃত্যু ঘটে নীরবে, গণমাধ্যমে তা বড় খবর হয় না। করোনাভাইরাসের গতি তীব্র, মৃত্যুও ঘটছে অভাবিত গতিতে। তাই গণমাধ্যমে তোলপাড় শুরু হয়েছে। স্বাভাবিক আবহাওয়া খবর নয়। খবর তো ঝড়। কিন্তু ঝড় তো স্থায়ী হয় না। ধ্বংসের করাল নৃত্য স্থায়ী হতে পারে না। ঝড় যেমন থামে, তেমনি করোনা-ঝড়ও থামবে। তবে ততদিনে আমাদের এই চেনা পৃথিবীটা অনেক বদলে যাবে।

কেমন হতে পারে করোনা-পরবর্তী পৃথিবী? যারা চিন্তক-গবেষক-জ্ঞানী তারা নানাভাবে দেখছেন আগামীর পৃথিবীকে। কারো চোখে সেটা কিছুটা ধূসর, কারো কারো চোখে সেটা রঙিন এবং ঝলমলে। দুর্ভিক্ষে বা অনাহারে মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কা করা হচ্ছে। খাদ্যাভাব যদি না-ও দেখা দেয় তবু কেনার সামর্থ্য থাকবে না অনেক মানুষের। তবে অনাহারে মৃত্যুর বিষয়টি নিয়ে আগাম কল্পনা করে ভারাক্রান্ত হওয়ার এখনই দরকার নেই। কয়েকদিনের অনাহারে সাধারণত কারো মৃত্যু হয় না। বয়স, শারীরিক সুস্থতা, ওজন, কাজের মাত্রা, জিনগত বৈশিষ্ট্য, মনোবল, পরিবেশের তাপমাত্রা ইত্যাদি নানা বিষয় নির্ভর করে অনাহারে একজন মানুষ কতদিন পর্যন্ত বেঁচে থাকবে। মানুষের জীবন ধারণের জন্য পানি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। শুধু পানি পান করে এবং আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে একজন পূর্ণ বয়স্ক সুস্থ্য ব্যক্তি দুই মাস পর্যন্ত বাঁচতে সক্ষম বলে মনে করা হয়।

তবে মানুষের বেঁচে থাকার জন্য, সুস্থ্য থাকার জন্য ন্যূনপক্ষে যতটুকু খাবার দরকার তা দেওয়ার দায়িত্ব বিভিন্ন দেশের সরকারগুলোকে নিতে হবে। উৎপাদন, সরবরাহ, বণ্টন ব্যবস্থা বৈষম্য ও ত্রুটিমুক্ত করতে হবে। বিশ্বের যেসব অঞ্চলে স্বাভাবিক খাদ্য ঘাটতি আছে সেসব দেশের প্রতি বিশেষ মনোযোগ রাখা উচিত খাদ্য উদ্বৃত্ত দেশগুলোকে। করোনা-পরবর্তী পৃথিবীকে মানুষের বাসযোগ্য করতে হলে অনেক কিছুই নতুন করে ভাবতে হবে। ঢেলে সাজাতে হবে অনেক কিছু। আগের মতো চললে হবে না। যে দেশে যে সম্পদ অতিরিক্ত আছে, তাতে সব দেশের  মানুষের অধিকার আছে – এই নীতি অনুসরণ করলে সমস্যা অনেক কম হবে। তবে এটা বলা যত সহজ, বাস্তবায়ন করা তত সহজ নয়। এর সঙ্গে জড়িত আছে বিভিন্ন দেশের জাতীয় এবং আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক।

এটা কারো অজানা নয় যে, প্রাণীর জীবন ধারণের অন্যতম রসদ হলো খাদ্য। এক হিসাবে দেখা যায়, পৃথিবীতে খাদ্য উৎপাদনের যে সুযোগ আছে, তাতে ৩৪০ কোটি মানুষের খাদ্যের ব্যবস্থা হতে পারে। অথচ পৃথিবীর জনসংখ্যা বর্তমানে ৭৮০ কোটি। সেজন্য অতিরিক্ত খাদ্য জোগানের জন্য এমন সব উদ্যোগ বা ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে যা প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করছে। বন সংহার, রাসায়নিক সার প্রয়োগ, অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার, বেশি মাত্রায় পানি সেচ – এই সব কিছুর যোগ ফল হচ্ছে প্রকৃতি আমাদের সঙ্গে বৈরি আচরণ করতে শুরু করছে। অন্যদিকে কৃত্রিম উপায়ে ফসল ফলানোর কারণে খাদ্যের পুষ্টিগুণ কমে যাচ্ছে। ১৯৫০ সালে একটি টমেটোর পুষ্টি ২০২০ সালে ১০টি টমেটোর সমান। আগের একটি কমলা লেবু এখন আটটির সমান।

বিজ্ঞানীরা আবার এমন কথাও বলছেন যে, ফসলের উৎপাদন বাড়িয়ে, ধরন পাল্টিয়ে ১০২০ কোটি মানুষের খাদ্য সংস্থান করা সম্ভব। কিন্তু তার জন্য কৃষির নতুন বিন্যাস দরকার হবে। কোন জায়গায় কোন ফসলের বেশি ফলন হয় তার অনুসন্ধান করতে হবে, সেজন্য প্রয়োজনীয় পরিকল্পনাও করতে হবে। অরণ্য, জলাভূমি ধ্বংসের উন্মত্ততা পরিহার করতে হবে।

জীবন-আবেগে রুধিতে না পারি' যারা উদ্ধত-শির

লঙ্ঘিতে গেল হিমালয়, গেল শুষিতে সিন্ধু-নীর।

মানুষের অপরিণামদর্শিতা দূর না হলে শুধু করোনাভাইরাস কেন, আরো অসংখ্য জীবাণুর আক্রমণের জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। বনজঙ্গল সাফ করা জলাভূমি দখল করার মধ্য দিয়ে বিভিন্ন জীবজন্তুর স্বাভাবিক বাসস্থান নষ্ট হওয়ায় প্রাণী জগতের জীবাণুগুলো মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হওয়ার সুযোগ বেড়েছে। জীবজন্তুর বিচরণক্ষেত্র সংকুচিত হওয়ায় মানুষ এবং জীবজন্তুর মধ্যে দূরত্ব বজায় রাখতে সমস্যা হচ্ছে। এতে প্রাণী থেকে মানবদেহে জীবাণু সংক্রমণের আশঙ্কা বেড়েছে। মানুষ এবং জীবজগতের মধ্যে ব্যাধির আদান-প্রদানের ফলেই নানা ধরনের সংক্রামক ব্যাধির প্রকোপ বাড়ছে। করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রধান কারণ হিসেবেও বন্য বা পোষা প্রাণীকেই চিহ্নিত করা হচ্ছে।

করোনা-পরবর্তী বিশ্বকে এসব বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। বাংলাদেশকেও গতানুগতিক ধারা ও ধারণার বাইরে এসে নতুন পথ-সন্ধান করতে হবে। উন্নয়নের সঙ্গী হয়ে নগরে নগরে গড়ে উঠছে শিল্প-কারখানা। দিনের পর দিন বর্জ্য পদার্থ মিশে নদীর পানি হচ্ছে দূষিত। বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বাড়ছে। বিশ্ব উষ্ণায়ন ত্বরান্বিত হচ্ছে। ২১০০ সালের মধ্যে উপকূলীয় এলাকাগুলো সম্পূর্ণ পানির তলে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। সমুদ্রের পানি ধারণ ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। নদীগুলোর নাব্যতা কমছে দ্রুততার সঙ্গে।

করোনাভাইরাসের এই দুঃসময়ে ভালো খবর হলো, মানুষ এবং মানুষ চালিত জ্বালানি-নির্ভর সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ থাকায় প্রকৃতি যেন হাফ ছেড়ে বেঁচেছে। মানুষের নিঃশ্বাস যখন বন্ধ হয়ে আসছে, প্রকৃতি এবং প্রাণীকুল তখন যেন প্রাণ খুলে হাসছে। একেই কি বলে কারো পৌষ মাস, কারো সর্বনাশ!

মানুষ, প্রকৃতি এবং প্রাণী জগতের সবার জন্য পৌষ মাস নিশ্চিত করার কথা যদি আমরা ভাবতে ব্যর্থ হই, করোনাভাইরাসের পরেও যদি আমাদের মনোজগতে কোনো পরিবর্তন না আসে তাহলে করোনাভাইরাস থেকে বাঁচলেও আর কোনো নতুন ভাইরাস আমাদের প্রাণ সংহারে এগিয়ে আসবে।