আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নির্বাচন: শেষ হইয়াও হইল না শেষ?

বিভুরঞ্জন সরকারবিভুরঞ্জন সরকার
Published : 2 Feb 2012, 02:10 AM
Updated : 13 Nov 2020, 03:04 PM

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন শেষ হয়েছে ৩ নভেম্বর। ৬ নভেম্বরের মধ্যে ফলাফলও জানা গেছে। ফলাফল অমীমাংসিত নয়। ডেমোক্রেটিক প্রার্থী জো বাইডেন জয়ী হয়েছেন। পরাজিত হয়েছেন রিপাবলিকান প্রার্থী প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। প্রায় ৫০ লাখ পপুলার ভোট বেশি পেয়েছেন জো বাইডেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার জন্য যে ম্যাজিক সংখ্যক ইলেকটোরাল কলেজ ভোট প্রয়োজন (২৭০), তারচেয়ে বেশি সংখ্যা বাইডেনের ঝুলিতে (২৭৯)। এই সংখ্যা আরও বাড়বে বৈ কমবে না। সে জন্য কোনোভাবেই বাইডেনের জয় নিয়ে সন্দেহ প্রকাশের সুযোগ নেই।

নির্বাচনের এই ফলাফল প্রত্যাশিত ছিল। নির্বাচনের আগে সব জনমত জরিপেই এগিয়ে ছিলেন বাইডেন। তবে ২০১৬ সালের নির্বাচনে জনমত জরিপে এগিয়ে থেকেও পরাজিত হয়েছিলেন হিলারি ক্লিনটন। এবার সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে কি-না তা নিয়ে অনেকের মনেই সংশয় ছিল। তবে এবার জনমত জরিপ বেঠিক হয়নি।

কিন্তু পরাজয়ের আশঙ্কায় নির্বাচনের আগে থেকেই ঘোট পাকানোর তালে আছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তিনি পরাজয় মানবেন না বলে আগে যা বলেছিলেন, নির্বাচনের পর বাস্তবে তা-ই করছেন। ট্রাম্প হয়তো জানতেন যে, গত চার বছরে তার যে পারফরমেন্স তাতে পুনর্নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা তার কম। তাই তিনি ভোটের ফল না মানার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছেন। তিনি ভোট শেষ হওয়ার পর মুহূর্ত থেকেই তার বিজয় 'চুরি' হয়ে যাওয়ার অভিযোগ করছেন। কয়েকটি অভিযোগও আদালতে দায়ের করা হয়েছিল। উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণহীন অভিযোগগুলো আদালত খারিজ করে দিয়েছে।

কিছুতেই দমবার পাত্র নন ট্রাম্প। তিনি গোঁ ধরে আছেন, তিনি জয় ছাড়া আর কিছু মানবেন না। তাকে পরাজয় মেনে নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন তার জামাতা এবং স্ত্রী। অবশ্য তার দুই পুত্র আছেন তার অবস্থানের পক্ষে। ট্রাম্প মামলা-মোকদ্দমা করে কি হোয়াইট হাউসের দখল রাখতে পারবেন? ট্রাম্প যে প্রায়-উন্মাদের মতো আচরণ করছেন তার কারণ কী? ট্রাম্প জানেন, তিনি মার্কিন সমাজে বিভক্তির যে বিষবৃক্ষ রোপন করেছেন তা সহজে দূর হবে না। তার উদ্ভট সব আচরণের পক্ষে জনগণের এক বিপুল অংশের নীরব অথবা সরব সমর্থন আছে। ট্রাম্পকে সাত কোটি আমেরিকান ভোট দিয়েছে। তিনি ২০১৬ সালে পেয়েছিলেন ৪৬ শতাংশ ভোট। এবার পেয়েছেন ৪৮.২ শতাংশ ভোট। ভালো কাজ করলেও ক্ষমতায় থাকলে জনপ্রিয়তা কমার যে সাধারণ রীতি, সেটাও কাজ করেনি। ট্রাম্পের এই ভোট বৃদ্ধি বিস্ময়কর, অপ্রত্যাশিত।

তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা আছে, কর ফাঁকি দেওয়ার মামলা আছে, আছে নারী নিগ্রহের অভিযোগ। তারপরও এত বিপুল সংখ্যক মানুষের ভোট প্রাপ্তি নিঃসন্দেহে মার্কিন সমাজের চরম বিভক্তির প্রকাশ।

ট্রাম্পের বড় হাতিয়ার হলো বর্ণবিদ্বেষ, জাতিবিদ্বেষ অভিবাসীবিদ্বেষ। কালোদের বিরুদ্ধে শ্বেতাঙ্গদের মনে এক ধরনের ক্ষোভ ছড়াতে তিনি সক্ষম হয়েছেন। কালোরা আছে বলেই শ্বেতাঙ্গরা সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত হয়েছে, সমাজে নানা ঝামেলা তৈরি হচ্ছে, একশ্রেণির শ্বেতাঙ্গের মনে এই বিশ্বাস তৈরি করতে পেরেছেন ট্রাম্প। ট্রাম্প সব আমেরিকানের প্রেসিডেন্ট হতে চাননি, এখনও চান না। তিনি জাত্যাভিমানী এবং যুক্তিবোধহীন মানুষদের সমর্থন চান, তাদের প্রেসিডেন্ট হতে চান। 'আমেরিকা ফার্স্ট' নীতি নিয়ে চার বছরে তিনি আমেরিকাকে বিশ্ব দরবারে সবলভাবে উপস্থিত করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তার খামখেয়ালিপনার জন্য আমেরিকার অবস্থান এখন অনেকটাই দুর্বল।

আমেরিকার ইতিহাসে ট্রাম্পের চেয়ে ব্যর্থ প্রেসিডেন্ট আর কেউ ছিলেন না – এটা মার্কিন গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে আলোচিত। রাজনীতি-অনভিজ্ঞ এই ব্যবসায়ী কর ফাঁকি দেওয়া এবং ব্যবসায়ে মুনাফার বিষয়টি যতটা বোঝেন, রাজনীতি যে ততটা বোঝেন না, সেটা তিনি পদে পদে বুঝিয়েছেন। শতাব্দীর বড় অঘটন কোভিড-১৯ মোকাবেলায় তিনি চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। তার ভুল নীতি এবং স্বাস্থ্য বিজ্ঞান সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে বিশ্বের মধ্যে আমেরিকাতেই করোনাভাইরাস সংক্রমণ এবং মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।

আমেরিকার মতো দেশের প্রেসিডেন্ট হয়ে ট্রাম্প যেভাবে মিথ্যা এবং উদ্ভট কথাবার্তা বলেন, তা এক কথায় অভাবিত। নজিরবিহীন অসততা নিয়ে তিনি পৃথিবীকে নেতৃত্ব দেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন।

ট্রাম্প বরাবরই গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে এসেছেন। নিজের স্বেচ্ছাচারী আচরণের কারণে তিনি জগদ্বিখ্যাত হয়েছেন। যেসব দেশে অগণতান্ত্রিক ও কর্তৃত্ববাদী সরকার প্রধান আছেন, তাদের সঙ্গে ট্রাম্পের সখ্যও বিশেষ ইঙ্গিতবাহী। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হলো চীন। চীনের সঙ্গে টক্কর দেওয়ার নীতি নিয়ে তিনি অনেকের সমর্থন আদায়ে সক্ষম হয়েছেন। চীনের খবরদারী যাদের অপছন্দ, তাদের সঙ্গে ট্রাম্পের মৈত্রী সম্পর্কও লক্ষণীয়।

কেউ কেউ ট্রাম্পের সময়কালে আমেরিকা নতুন করে কোনো দেশের সঙ্গে যুদ্ধে না জড়ানোর ঘটনাকে প্রশংসনীয় বলে মনে করেন। তবে এটা তার নীতিগত অবস্থান, নাকি সিদ্ধান্ত গ্রহণের অক্ষমতা – সে প্রশ্নও আছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষকরা মনে করেন, ট্রাম্প আমেরিকাকে প্রকৃত মিত্রের কাছ থেকে সরিয়ে এনেছেন। ট্রাম্প তার কাজের মাধ্যমে প্রেসিডেন্টের কার্যালয়কে খাটো করেছেন, আমেরিকান নাগরিকদের সংহতিতে ফাটল ধরিয়েছেন এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে আমেরিকার পদচারণাকে সীমিত করে গোটা বিশ্বকেই একটি ভারসাম্যহীন অবস্থায় ফেলে দিয়েছেন।

সদ্য বিজয়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, তিনি লাল (রিপাবলিকান) বা নীল( ডেমোক্রেটিক) দলের না হয়ে সব মানুষের প্রেসিডেন্ট হবেন। তিনি ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছেন। বিভেদ-বিভাজন ভুলে সবাইকে এক হয়ে কাজ করার ডাক দিয়েছেন। তিনি নির্বাচনের আগে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণেরও অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন। ট্রাম্পের চার বছরে মার্কিন সমাজে বিভক্তির যে ক্ষত তৈরি হয়েছে তা নিরাময়ের চেষ্টা করবেন বলে জানিয়েন। তবে তার পথ চলা বাধাগ্রস্ত হতে পারে সিনেটের অসহযোগিতার কারণে। সিনেটে রিপাবলিকানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে অনেক বিষয়েরই অনুমোদন দিতে তারা টালবাহানা করতে পারে। ১০০ সদস্যের সিনেটে রিপাবলিকান ৫৩ এবং ডেমোক্রেটিক ৪৭ জন সদস্য। তবে মন্ত্রিসভায় রিপাবলিকানদের অন্তর্ভুক্ত করলে বাইডেন হয়তো কিছুটা সুবিধা পেতে পারেন।

আশার কথা এটাই যে, জো বাইডেন একজন অভিজ্ঞ মানুষ। রাজনীতিতে তিনি নবাগত নন। বর্তমানে ৭৭ বছর বয়সী বাইডেন ২৯ বছর বয়সে প্রথম সিনেটে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি বারাক ওবামার দুই মেয়াদে ভাইস-প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেছেন। তার আগে মার্কিন সিনেটে পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক কমিটিতে কাজের অভিজ্ঞতাও তার রয়েছে। তিনি জানেন, কীভাবে এবং কোথা থেকে শুরু করতে হবে। তাছাড়া জো বাইডেন তার সহযোগী ভাইস-প্রেসিডেন্ট পেয়েছেন কমলা হ্যারিসকে, যিনি একজন চৌকষ নারী হিসেবে এরমধ্যেই খ্যাতি অর্জন করেছেন। কমলা একজন অশ্বেতাঙ্গ মার্কিন নাগরিক। তার মা ভারতীয়, বাবা জ্যামাইকান। মিশ্র সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা কমলার ঝুলিও অভিজ্ঞতাশূন্য নয়। তিনি আইনজ্ঞ এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার। বাইডেন-কমলা জুটির নেতৃত্ব এক নতুন মানবিক আমেরিকার উত্থানের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। আগামী ২০ জানুয়ারি শপথ গ্রহণ করে বাইডেন-কমলা জুটি হোয়াইট হাউসে প্রবেশাধিকার পাবেন বলে আশা করা যায়।

এখন অনেকের মনে যে প্রশ্নটি ঘুরপাক খাচ্ছে তা হলো, ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়াটি নির্বিঘ্ন হবে কি-না? ট্রাম্পের কি শুভবুদ্ধির উদয় হবে? তিনি কি বাগড়া দেওয়া অব্যাহত রাখবেন? তার পক্ষে কি হোয়াইট হাউসের দখল বজায় রাখা সম্ভব? পুনর্গণনা হলেও ভোটের ফলাফল বদলে যাওয়া প্রায়-অসম্ভব বলেই মনে করা হচ্ছে। আদালতে গিয়ে ট্রাম্প সুফল পাবেন, এমনটা কেউ মনে করেন না। তারপরও মানুষের মন থেকে অস্বস্তি দূর হচ্ছে না। যতক্ষণ পর্যন্ত বাইডেন তার পদে বসতে না পারছেন ততক্ষণ এক ধরনের চাপা অস্বস্তি থাকবেই। আর শেষ পর্যন্ত যদি কোনো অঘটন ঘটে, বাইডেনকে প্রেসিডেন্টের পদে বসতে না দেওয়া হয়, তাহলে আমেরিকার জন্য একটি ভয়ঙ্কর সময় অপেক্ষা করছে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। এর আগে দেশের বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা আমেরিকার আছে। তবে দেশের ভেতর, নিজ নাগরিকদের সঙ্গে যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নেই। এবার দেশের ভেতরেই যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি হবে। ট্রম্পের তৈরি বিভেদ ও হিংসার পথে যদি বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠীগুলো হাঁটতে শুরু করে তাহলে সংহতি ও স্থিতি বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেবে।

বাইডেন লড়াইয়ের ময়দান থেকে সহজে পিছু হটবেন বলে মনে করার কারণ নেই। তিনি একজন মধ্যপন্থী এবং উদার মানুষ হিসেবে পরিচিত হলেও ভোটের ফল না মানার মতো অবস্থানে তার যাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আর যে কোটি কোটি মানুষ তাকে ভোট দিয়েছেন নতুন আশা নিয়ে তারা সবাই ট্রাম্পের পাগলামির কাছে নতি স্বীকার করবেন, এতটাও কি প্রত্যাশা করা যায়?

আমেরিকার গণতন্ত্র এবং নির্বাচন ব্যবস্থাকে তছনছ করে দিলে তার বিরূপ অভিঘাত শুধু আমেরিকার ভৌগোলিক সীমার মধ্যে আটকে থাকবে না, সেটা অন্য দেশেও ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হবে। পৃথিবীর দেশে দেশে অগণতান্ত্রিক শক্তি মাথা চাড়া দেওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে। জিতলে ঠিক আছে, হারলেই ভোট চুরির অভিযোগের ধারা যে দেশগুলোতে আছে, সেসব দেশে নতুন করে অগণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা প্রবল হয়ে উঠতে পারে। উদারতা, সমঝোতার জায়গা দখল করতে পারে হঠকারিতা ও অসহিষ্ণুতা।