পোল্ট্রি শিল্প কোন পথে?

সুলতান মির্জা
Published : 9 June 2012, 05:45 PM
Updated : 9 June 2012, 05:45 PM

বাংলাদেশ এর পোল্ট্রি শিল্পের রাজধানী গাজীপুর। একটা সময় ছিল সারা বাংলাদেশ এর উত্পাদিত ডিম, ব্রয়লার মুরগি, কক এর ৮৫% যোগান হতো ঢাকার পার্শ্ববর্তী এই গাজীপুরে। একটা সময় ছিল গাজীপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ঘরে ঘরে সর্বনিম্ন ৫০০ মুরগির একটা করে খামার ছিল। একটা সময় ছিল গাজীপুরের, শ্রীপুর উপজেলার ৯০%, কাপাসিয়ার ৮০%, কালীগঞ্জ এর ৭৫%, কালিয়াকৈর এর ৭৫% ও অন্যান্য উপজেলার সর্বনিম্ন ৩০% জনগণ এই শিল্পের সাথে জড়িত ছিল। অর্থযাত পোল্ট্রি শিল্পের স্বর্নালী একটা সময় গাজীপুর এর মানুষ পার করে এসেছে। উপরেল্লেখিত এই সারণী গুলো এখন ঘুনে ধরা অতীত মাত্র। তার মানে কী গাজীপুরের মানুষ এখন আর পোল্ট্রি শিল্পের সাথে জড়িত নেই ? আমি বলতে চাচ্ছিলাম আছে তবে তা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অতি নগণ্য। তবে যারা এখনো এই শিল্পের সাথে রয়েছে তারা নিছক হয়তো বা, বেকার খাওয়ার চেয়ে কিছু করে খেতে হবে এই জন্য রুগ্ন হয়ে যাওয়া এই শিল্পটিকে টেনেটুনে নিয়ে যাচ্ছে।

গাজীপুর ছাড়িয়ে সারা বাংলাদেশ এ পোল্ট্রি শিল্পের বিস্তার ঘটেছে বর্তমানে সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, সিলেট,চট্টগ্রাম, ও আরও অন্যান্য অঞ্চলে হয়েছে। কিন্তু ঝুকি ও সংকট কাটেনি। বাড়ছে অভাব ও উত্পাদনের বহুমুখী সমস্যা।

আপনারা জানেন কিনা জানি না, বাংলাদেশ এর অন্যান্য সেক্টরের মত ও কিন্তু পোল্ট্রি সেক্টরে পুঁজিবাদী ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট রয়েছে। যার কারণে ধংস হয়ে যাচ্ছে আমাদের এই পোল্ট্রি শিল্প। আরও হবে। পোল্ট্রি শিল্পের সিন্ডিকেট এর সূচনা হয় তত্কালীন ২০০১-২০০৬ বিএনপি-জামাত জোট সরকারের সময় থেকে জার নেত্রীত্তে ছিলেন আমাদের তত্কালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান এর ছেলে এম নাসের রহমান এর মালিকাধীন কোয়ালিটি পোল্ট্রি ফিড্স লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান। উল্লেখ করতে চাই এই কোম্পানিটির জনমকাল কিন্তু ২০০২ সালের দিকে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর কোয়ালিটি ফিড্স লিমিটেড তাদের নেত্রীত্ব হারিয়েছে। বর্তমানে এই নেত্রীত্ব রয়েছে প্যারাগন ও উষা পোল্ট্রি ফিডের মালিক মশিউর রহমান। যা সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তন যোগ্য।

এই সিন্ডিকেটের কাজ কী ? আমি মনে করি এই সিন্ডিকেটের জন্য পোল্ট্রি শিল্প ধংস হতে চলেছে। যেমন –

* এই সিন্ডিকেটের রয়েছে বাচ্চা উত্পাদন খামার বা হ্যাচারী।
* এই সিন্ডিকেট বাচ্চা উত্পাদন করে মূল্য নির্ধারন করে দেয়।
* এই সিন্ডিকেট পোল্ট্রি ফিড্স উত্পাদন করে বাজার মূল্য নির্ধারন করে দেয়।
* এই সিন্ডিকেট পোল্ট্রি শিল্পের ঔষধ আমদানি করে তা খামারির হাতে যাওয়ার মূল্য নির্ধারন করে।
* এই সিন্ডিকেটের হাতে রয়েছে নিজস্ব ডিম উত্পাদন খামার যেখানে প্রতিদিন উত্পাদন হয় ৪০ লাখের মত ডিম।
* অর্থ্যাত এই সিন্ডিকেট বাচ্চা উত্পাদন থেকে শুরু করে খামারির কাছে থকে ডিম উত্পাদন পর্যন্ত সকল কিছু নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

এইখানে সাধারণ মাপের খামারি দের তেমন কোনও ক্ষমতা নেই। এই সিন্ডিকেট যা নির্ধারন করে তা সরকার ঘোষণা দিয়ে থাকে। সাধারণ খামারি বাচবে না মরবে তাতে তাদের কিছু যায় আসে না।

প্রিয় পাঠক, আপনারা যে ডিম ও মুরগির মাংস খাচ্ছেন এই গুলোর সঠিক উত্পাদন ব্যয় কত ? জানতে ইচ্ছা করে না ?

ধরুন ১০০০ টি লেয়ার মুরগির একটি খামার হিসেব। শুরু থেকে ডিম উত্পাদন পর্যন্ত খরচ (ছয় মাস) ধাপে ধাপে বিশ্লেষণ করলাম ।

* প্রাথমিক শেড নির্মাণ মিনিমাম পর্যায়ে (টিন ও নেটের বেড়া দিয়ে) বর্তমানে ৪৫০০০০/- (চার লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকা) (বাজার উঠা নামার ক্ষেত্রে পরিবর্তন যোগ্য)
* লেয়ার মুরগির ১ দিনের বাচ্চার মূল্য বর্তমানে ৮০ টাকা করে, সেই হিসেবে ১০০০ হাজার মুরগির বাচ্চার মূল্য-৮০০০০ /- (আশি হাজার টাকা)
* মুরগির খাচা তৈরিতে খরচ লাগে ১৩০০০০ /- (এক লক্ষ ত্রিশ হাজার টাকা)
* ১ দিন থেকে ৬ মাস পর্যন্ত একটি মুরগি প্রস্ততে খাবার লাগবে সর্বনিম ২৭০০০০ /- (দুই লক্ষ সত্তর হাজার টাকার)
* ঔষধ লাগে ডিম উত্পাদন পর্যন্ত ৬ মাসে সর্বনিন্ম (বড় ধরনের কোনও সমস্যা না হলে) ৫০০০০ /- (পঞ্চাশ হাজার টাকা)।

এইখানে এক হাজার লেয়ার মুরগির ডিম উত্পাদন পর্যন্ত সঠিক একটি হিসেব উপস্থাপন করা হলো। যা সর্বমোট টাকার অংকে আসে ৯৮০০০০/- (নয় লক্ষ আশি হাজার টাকা)

একটি ডিম উত্পাদন করতে বর্তমান বাজারে কত টাকা খরচ হয় এবং কীভাবে সেটা।

*প্রতিদিনের খাবার
*ঔষধ
*শ্রমিক খরচ
*বিদ্যুত্‍ ব্যয়

সর্বমোট ৬ টাকা লাগে একটা ডিম উত্পাদনে।

সাম্প্রতিক সময়ে একটা বিষয় খুব আলোচিত হচ্ছে, সরকার থাইল্যান্ড থেকে ডিম ও এক দিনের মুরগির বাচ্চা আমদানি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যা এই শিল্পের ভবিষ্যত উত্পাদন আরও খারাপ পর্যায়ে চলে যাবে বলে আমি মনে করি। যে হারে খামারি কমে যাচ্ছে, তাতে আমদানি করা ডিম ও মুরগির মাংস দিয়ে আমাদের দেশীয় চাহিদা পূর্ণ করা সম্ভব নয়।

এবার আসুন দেখে নেওয়া যাক এই শিল্পের আর্থিক সহযোগিতা কী

অত্যান্ত দুক্ষের সাথে বলতে হচ্ছে, সরকারী বা বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান গুলি যদি শুনে যে পোল্ট্রি খাতে টাকা বিনিয়োগ করতে হবে, তাহলে মাথা আর উপর নিচ হয় না, মাথা উপর এপাশ করে অর্থ্যাত না। তাহলে এইসব খামারি গুলো আর্থিক সহযোগিতা কোথা থেকে পেয়ে থাকে ?

*স্থানীয় পোল্ট্রি ফিড্স ডিলার ৫০% বাকিতে দীর্ঘ মেয়াদী খাবার দিয়ে থাকে।
*ঔষধ এর ও একই অবস্থা।
*স্থানীয় ডিমের আড়ত এক হাজার মুরগির ডিম পেতে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা দাদন দিয়ে থাকে।

স্থানীয় ব্যবসায়ীর এই বিনিয়োগে তেমন নিরাপত্তা নেই। উদাহরণ হিসেবে বলি, প্রথমেই যে সিন্ডিকেট এর কথা বলেছিলাম বাংলাদেশ এর পোল্ট্রি শিল্পের সকল প্রকার রোগের জন্মদাতা হলো তারা, কথিত আছে, বর্তমানে গাম্ব্র নামের রোগটি যে রোগে সর্বোচ্চ এক ঘন্টার ও কম সময়ে সকল মুরগি মারা যেতে পারে। এই রোগের ভাইরাস এই সব প্রভাবশালী সিন্ডিকেট, নিজেদের উত্পাদিত পণ্য আরও বেশি করে খামারি দের কাছে বিক্রি করার জন্য ছড়িয়ে দিয়ে থাকে। পাশাপাশি বার্ড ফ্লু র ভাইরাস ও ছড়িয়ে থাকে।

এইবার বলছি ব্রয়লার মুরগির কথা,

এক হাজার ব্রয়লার মুরগির হিসেব, মোট ৩২ থেকে ৩৫ দিনে উত্পাদন শেষ হয়। এর মধ্যে যদি এভারেজ ১.২৫ কেজি ওজন না হয় তাহলে পুজির টাকা উঠার সম্ভাবনা থাকে না। যেমন,
* এক দিনের প্রতি পিছ বাচ্চার ক্রয় মূল্য ৭০ টাকা- ৭০০০০ /- হাজার টাকা।
*খাবার লাগে মিনিমাম ১০০০০০ /- এক লক্ষ টাকার।
*ঔষধ ও তুষ বাবদ ১৫০০০ /- পনের হাজার টাকা

অর্থ্যাৎ প্রতি পিছ মুরগির উত্পাদন খরচ পড়ে ২৫০ /- টাকা।

আমি এই সব খামারির কষ্টের কথা জানি। এখনো যারা এই শিল্পে রয়েছে তাদের অনেকেরই অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নেই।

এই শিল্প টিকিয়ে রাখতে হলে এখন ই সরকার কে যা করতে হবে,

* সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে হবে (যদিও সরকার মুরগির বাচ্চার মূল্য নির্ধারন করে দিয়ে শেষ পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি)
* পোল্ট্রি ফিড্স ও ঔষধের মূল্য পুনরায় নির্ধারন করতে হবে।
* পোল্ট্রি শিল্পের সাথে যারা জড়িত রয়েছেন তাদের কে কম সুদে ব্যাংক লোনের ব্যবস্থা করে দিতে হবে।

উপরোক্ত বিষয় গুলো বাস্তবায়ন এর উপর নির্ভর করবে ভবিষ্যতে কী আবার ডিম বা মুরগির মাংসের জন্য অন্য কোনও দেশের উপর ধরনা দিতে হবে কী না। তবে আমি মনে করি যে শুধু মাত্র সরকারের একক ইচ্ছা এই শিল্পের ভবিষ্যত রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় নয়। যদি না এই শিল্পের লিডার তাদের যদি আন্তরিকতা না থাকে ।

*যাই হোক উপরের তথ্য গুলো কোনও কাল্পনিক ভিত্তিতে নয়। এই তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে মাঠ পর্যায়ে খামারি, ফিড্স ব্যাবসায়ী ও ডিম ব্যবসায়ী দের সাথে আলাপ আলোচনা করে।

ধন্যবাদ সবাইকে।

ছবিসুত্র: ইন্টারনেট

@সুলতান মির্জা
০৯/০৬/২০১২ ইং