সাংস্কৃতিক আগ্রাসন-১

নাজমুস চৌধুরি
Published : 14 July 2012, 11:08 AM
Updated : 14 July 2012, 11:08 AM

বিশ্বায়নের এই যুগে যে যত বর্তমান বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারবে সে ততই এগিয়ে থাকবে। এই দৌড়ে বাংলাদেশ ও পিছিয়ে নেই, বিশ্ব সংস্কৃতির সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশও এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই দৌড়ে সামিল হওয়ার সাথে সাথে আমরা কি আপন সংস্কৃতিকে ভুলে যাচ্ছি।

বিগত ৪০০ বছরের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ঔপনিবেশিক শাসক গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রনে ছিল এই অঞ্চলটি, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শাসক গোষ্ঠী শাসন করে গেছে এখানে। তার সাথে তাদের ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাতে চেয়েছে, স্বাভাবিক ভাবেই হোক আর জোরপূর্বক হোক। আর নিষ্পেষিত বাংলার মানুষ সেটাকেই মেনে নিয়েছে। কখনও কখনও আন্দোলন হয়েছে কিন্তু শাসক গোষ্ঠী অনেক শক্তিশালি থাকায় তা কোনটাই পূর্ণ রূপ পায় নাই।

যা হোক এতো গেলো ইতিহাসের কথা। এখন আসি আমাদের বর্তমান অবস্থার কথায়।

ভাষা, আমাদের বাংলা ভাষা, নিঃসন্দেহে বিশ্বের দরবারে আমাদের ভাষা আমাদের গর্বের বিষয়। বাংলা ভাষার চর্চা আমরা আমাদের সব ক্ষেত্রেই কম বেশি করে থাকি। বর্তমানে আকাশ সংস্কিতির প্রভাবে আর একটি ভাষা আমদের অতি আপন হয়ে যাচ্ছে, যা হল প্রতিবেশি দেশের একটি ভাষা। ঘরে ঘরে সেই দেশের প্রচারিত অনুষ্ঠান গুলো আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী ২৫ বছরে যেই ভাষা আমাদের দিয়ে বলাতে পারে নাই। অপর একটি কথিত বন্ধু রাষ্ট্র তার সংস্কৃতিকে স্লো পয়সনিং এর মত আমাদের ভেতরে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছে।

একটি উদাহরন দেইঃ

সেদিন এক বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম, সেই বাড়িতে ছোট ছোট দুটি বাচ্চা আছে যারা মাত্র স্কুলে ভর্তি হয়েছে, তাদের সাথে কথা বলতে গিয়ে প্রথমেই আমি হোঁচট খেলাম। আমি বাংলায় প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করায় সে হিন্দি তে উত্তর দেয়। অবাক কাণ্ড!!! আমি তার মা কে জিজ্ঞাসা করলাম, কেন এই অবস্থা। সে আমাকে একটি কার্টুনের উল্লেখ করে বলল যে তার বাচ্চা দুটা সেই কার্টুনের অন্ধ ভক্ত। সেটা না দেখে তারা খাবে না ,পড়বে না, ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি অবাক হলাম তার মায়ের এই অসহায় উক্তি শুনে । আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব কি পরিমান এই সমাজে ছড়িয়েছে।

এটাকে কি বলবো বাবা মায়ের মূর্খতা, না তাদের মধ্যে চেতনার অভাব, কোনটা??

এই প্রজন্মটি যখন বড় হবে বুঝতে শিখবে, তখন তারা কি করবে। শৈশবে যে শিক্ষা তারা পেয়েছে তারই তো প্রতিফলন ঘটবে নাকি? আর এ ধরনের পরিবারের অভাব নেই আমাদের দেশে।
তাহলে তো আমি বলতেই পারি আমদের ভাষা এখন হুমকির মুখে।

বিশ্বায়নের এই যুগে বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে বিশ্ব সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হতে হবে। পরিচিত হওয়া মানে এই না যে আমি আমার আপন সংস্কৃতি কে ভুলে গিয়ে অন্য সংস্কৃতির পালন করব। কিন্তু মনে হয় আমরা ভুলে গেছি আমাদের পরিচয়, আমাদের ইতিহাস।

সস্তা বিনোদনের মুখরোচক উপাদান দিয়ে ভরা বাজার আর মানুষ তা গোগ্রাসে গিলে খাচ্ছে। এতটুকু চিন্তা করছে না যে এটাই আমাদের অস্তিত্বের প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বাংলা অঞ্চলের যে আদিম আচার রিতি নিতি ছিল তার সিকি ভাগ টিকে আছে এবং বাকি গুলো বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কারন আমরা যারা এখন এই দেশে বসবাস করছি, খুব শক্ত ভাবে দাবি করতে পারব না যে হাজার বছর ধরে আমি এবং আমার পূর্ব পুরুষ এই তল্লাটে বসবাস করে আসছে, যদি সেটাই খুজতে যাওয়া হয় তাহলে এই অঞ্চলের আদিম অধিবাসী হচ্ছে সাঁওতাল রা। বাকি যারা সভ্য সমাজে বসবাস করছি তারা কেউ না কেউ কোন না কোন অঞ্চল থেকেই এই বাংলায় এসেছে। তাই বলে মিশ্র সংস্কৃতির একটা প্রভাব আমাদের মধ্যে দেখা যায়। যা বরাবরই উভয় সঙ্কটে পরতে হয়, হয় এটা নয় ওইটা।

যাই হোক এতো গেলো হাজার বছরের কথা, কিন্তু শতবর্ষের যেই বাঙালী সংস্কৃতি সেটা কি আমরা ধরে রাখতে পারছি। ধরলাম স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত মাইগ্রেসন চলেছে কিন্তু এর পরে তো আর হয় নাই।

আমরা ২১ শে ফেব্রুয়ারী পালন করি, পহেলা বৈশাখ পালন করি, আবার আমরা ভ্যালেনটাইনস ডে, ফ্রেন্ডশিপ ডে, মাদার ডে, ফাদার ডে এগুলোও পালন করি। পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ। প্রথম যে দুটা দিন এর কথা উল্লেখ করলাম, এই দিনগুলোতে আসলে কি হয়??

আমেরিকা তে প্রকাশ্যে চুমু খাওয়ার প্রতিযোগিতা হয়, তার মানে এটাও কি আমাদের দেশে সম্ভব?? আর আমাদের দেশে যা হয় তা তো আর বলার অবকাশ রাখে না। পাবলিক প্লেস গুলি তে যাওয়া যায় না এই দিনে বর্তমান তরুন প্রজন্মের উচ্ছৃংখল কার্যকলাপের জন্য। যা দেখছে শিশুরা, উঠতি বয়সের তরুন রা এবং এগুলা তাদের উপরে কি পরিমান নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে??
পরের দুটি দিনের কথায় আসি, পশ্চিমা বিশ্বে ছেলে মেয়ে রা তাদের ১৮ বছর হলেই বাবা মা কে ছেড়ে আলাদা থাকা শুরু করে, নিজের আয় নিজে করে নেয়। ওই দিন গুলিতে তারা তাদের বাবা মা কে দেখতে যায়, এমনকি অনেক সন্তানের বাবা মা রা ডিভোর্স নিয়ে আলাদা হয়ে গেলে তারা ওই দিনটি কে লক্ষ করে তাদের সন্তানের সাথে দেখা করে। আমাদের দেশের সংস্কৃতিও কি এটা বলে?? এগুলো পরোক্ষ ভাবে আমাদের সামাজিক ব্যবস্থার উপর প্রভাব ফেলছে না??

চলবে….