মামন উকিলের মসজিদ: প্রাচীন স্থাপত্যের এক অনুপম নিদর্শন

নাছির মাহমুদ
Published : 24 August 2012, 06:40 AM
Updated : 24 August 2012, 06:40 AM

গত ২৯/১০/২০১০ ইংরেজি তারিখ এক আত্মীয়ের অনুরোধে তাকে সঙ্গ দিতে সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার আশিঘর নামক গ্রামে যাওয়া। নাতি উঁচু টিলায় ঘেরা উপজেলার প্রায় প্রতিটি গ্রাম। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপরূপ লীলাভূমি এ উপজেলার প্রতিটি গ্রাম। হাকালুকি হাওরের তীর ঘেষা একটি গ্রাম আশিঘর। গ্রামের যে বাড়িতে আমাদের যাবার কথা সে বাড়িটিও একটি টিলার ওপর। পাশেই আরেকটি টিলা। চারদিকে সবুজের সমারোহ । মধ্যদুপুরের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে গাছে গাছে পাখির কলকাকলি। পাশের টিলায় একটি গাভী আনমনে ঘাষ খাচ্ছে। একটি পাখি (পেচুয়া) বারবার তার ওপর বসছে এবং গাভীটি তার লেজ দিয়ে পাখিটাকে তাড়াবার চেষ্ঠা করছে। নাতি উঁচু টিলায় গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে সোনালী আলোর খেলা দেখে মুগ্ধ হয়ে পড়লাম। সখের ক্যামেরাটা সাথেই ছিল। মনোরম এ প্রাকৃতিক সৌন্দয মিস করতে চাইনি । আমি ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। আমার আত্মীয় একটু বিরক্তিবোধ করে বলল, "আমি ঔ বাড়িতে যাচ্ছি। তুমি চলে এসো।"

হঠাৎ একজন বয়স্ক লুঙ্গিপরা ভদ্রলোক আমাকে এসে বলল, "আরেকটু সামনে গিয়ে ছবি তোলেন। আসেন আমার ‍সাথে"। আমি একটু অবাক হলাম। আমি কিছু না বলে তাকে অনুসরন করলাম। তিনি আমাকে টিলার ওপরে নিয়ে গেলেন। নিরব নিস্তব্দ টিলার ওপর ওঠে আমি প্রথমে কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম। শেওলা, লতাপাতায় ঘেরা একটি প্রাচীন পরিত্যক্ত ঘর দেখতে পেলাম। তিনি আমাকে এ ঘর দেখিয়ে বললেন, " এ ঘরের ছবি তুলুন"। আমি এ ঘরের স্থাপনা দেখে তাকে ঘরটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম । তার কাছ থেকে যা জানলাম তা শোনে আমি তো রীতিমতো অবাক। ছবি তোলার আগ্রহটা আরো বেড়ে গেল। তিনি ঘুরেঘুরে আমাকে পুরো ঘরটি দেখালেন। আর লোকমুখে তার জানা ইতিহাস আমাকে বলতে লাগলেন । তার কাছ থেকে যা জানলাম তা আপনাদের জন্য তুলে ধরলাম।

''৩/৪শ বছর আগে মামন উকিল নামে একজন মুসলিম জমিদার ছিলেন এ গ্রামে। তিনি বদমেজাজী হলেও ধর্মের প্রতি নাকি তার অনুরাগ ছিল। তাই তিনি সিলেটের শাহজালাল(র:) এর মাজারে মুল যে মসজিদ তার আদলে এ মসজিদটি নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। ছবিতে দৃশ্যমান কাজটুকু সম্পন্ন হবার পর তিনি এক ভিক্ষুকের সাথে খারাপ আচরন করায় তার অভিশাপে তিনি তার বংশধরসহ মারা যান । আর তাই মসজিদের কাজ আর সম্পূর্ণ হয়নি। লোকজন ভয়ে কখনো এ স্থানের আশেপাশেও ঘেঁষত না। তাই মসজিদটি সম্পূর্ণ করার উদ্যোগও আর কেউ নেয়নি"।
এতটুকু বলে তিনি চলে গেলেন। আমিও বেশকয়েকটি ছবি তুলে গন্তব্যস্থলে চলে গেলাম। সেখানে দুপুরের খাবার খেয়ে প্রয়োজনীয় কাজ সেরে ফেরার পথে এ বাড়ির (যে বাড়িতে আমরা গিয়েছিলাম) একজনকে জিজ্ঞেস করলাম এ মসজিদের কথা। তিনিও প্রায় একি কথা বললেন।

মসজিদ সম্পর্কে অধিকতর তথ্য জানার জন্য গেলাম ফেঞ্চুগঞ্জের বিশিষ্ট ফটোসাংবাদিক খালেদ আহমদের অফিসে। তিনি জানালেন এখানে এ রকম কোন মসজিদ আছে বলে তার জানা নেই । তবে ক্যামেরায় ছবি দেখে তিনি অবাকই হলেন । বললেন ফেঞ্চুগজ্ঞের ঐতিহাসিক প্রায় সকল স্থাপনা তার ক্যামেরায় ধারণ করার চেষ্ঠা করেছেন এবং ধারণ করেছেনও। কিন্তু এ মসজিদ নিয়ে তিনি কোন খবর পাননি। আমার কাছেই তার প্রথম জানা। বাড়িতে এসে ছবিগুলো পোস্ট করলাম আমার ফেসবুক ওয়ালে। দেশবিদেশ থেকে ফেঞ্চুগঞ্জের অনেকেই আমাকে অভিনন্দন জানালেন। দৈনিক প্রথম আলোর ফেঞ্চুগঞ্জ প্রতিনিধি জুয়েল খান লিখলেন, " আজ যেটা বতর্মান কাল সেটা অতীত। আর অতীত যেটা সেটাই তো ইতিহাস। নাছির ভাই আমার চোখ খুলে দিলেন"।

ভেবেছিলাম মসজিদটি নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করব। এর সঠিক ইতিহাস জেনে পাঠক সমাজে শেয়ার করব । কিন্তু পেশা ভিন্ন হওয়ায় এ নিয়ে আর এগুতে পারিনি। তাই দীর্ঘদিন পরে বিষয়টি এ ব্লগে শেয়ার করলাম, যদি কারো সঠিক ইতিহাস জানা থাকে তবে শেয়ার করবেন অথবা এ নিয়ে যদি কেউ গবেষনা করার সুযোগ পান তবে হয়তো প্রকৃত ইতিহাসটা জানা যাবে।

লেখক- শিক্ষক। Email : numahmud@live.com