রূপনগরের প্রকৃত রূপ

নুর ইসলাম রফিক
Published : 19 Dec 2016, 08:09 PM
Updated : 19 Dec 2016, 08:09 PM

রূপনগর বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার একটি জনবহুল বৃহৎ আবাসিক এলাকা। রূপনগর ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের জোন বা অঞ্চল-০২ এর অধীনস্থ। রূপনগর আবাসিক এলাকার অবস্থান মিরপুর, ঢাকা। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ, মিরপুর বিভাগের আওতাভূক্ত ৪৬তম থানা হিসেবে রূপনগর থানার কার্যক্রম শুরু হয় ২০১২ সালের ১৫ এপ্রিল।

রূপনগর ঢাকার একটি সুপরিকল্পিত আবাসিক এলাকা। যার এক দিকে রয়েছে রূপনগর খাল অন্য দিকে আরামবাগ ঝিল। এই দুটি খাল ও ঝিল রূপনগরের রূপকে রূপবতী করে রেখেছিল সুদীর্ঘ সময়। কালের বিবর্তনে আজ এই খাল ও ঝিল রূপনগরের রূপে ভাটা ফেলেছে। রুপনগরের এ খালটি এক সময় জলের চলমান কলতানে মুখর ছিল। এই খালটি অনেক দীর্ঘ ও প্রশস্ত ছিল কিন্তু এখন দখলদারদের কবলে পরে খালটি ছোট হয়ে গেছে। দেখলে মনে হয় কোন নালা বা ড্রেইন। এ খালটি তখন অনেক গভীর ও সুন্দর ছিল। কিন্তু আজ রূপনগর খালটি ময়লার বাগার। এ খালে ময়লার পরিমান এতো বেশি যে ঢাকার যে কোন বৃহৎ ডাস্টবিনকেও হার মানাবে। কথাগুলি বলেছিলেন রূপনগর আবাসিক এলাকার একজন পুরাতন স্থায়ী বাসিন্দা।

সরেজমিনে দেখা যায় খালটি ময়লায় এতোই ভরাট হয়ে গেছে যে খালে বিন্দুমাত্র স্বচ্ছ পানি দেখতে পাওয়া যায়নি। দেখতে পাওয়া যায় কালো নোংরা ময়লা পানি। খালের উপর রয়েছে অসংখ্য ঝুলন্ত পায়খানা। যা খালকে করে তুলেছে দূষিত এবং পরিবেশকে করেছে অসাস্থকর। খালের এক ধারকে দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে বিশাল লম্বা বস্তি। এই বস্তিতে রয়েছে আধা পাকা ও টিন বেড়া দিয়ে তৈরি শতশত ঘর। সেখান থেকে আদায় করে নিচ্ছেন লক্ষ লক্ষ টাকা সমাজের ক্ষমতাধর দখলদার গোষ্টি। যা বলছিলেন রূপনগর আবাসিক এলাকার আরেকজন স্থানীয় বাসন্দা।

রূপনগর আবাসিক এলাকার পার্শ্ববর্তী, আরামবাগ আবাসিক এলাকার বৃহৎ অংশ জুরে অবস্থান ছিল আরামবাগ ঝিলের। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে ছোট হয়ে গেছে সেই বৃহৎ আরামবাগ ঝিল বা আরামবাগ লেকটি। এই লেকের উপর নির্মিত কালভার্ট দিয়ে বয়ে গেছে আরামবাগ আবাসিক এলাকার পাঁচ নাম্বার রোড (মেইন রোড)। এই কালভার্ট এর উপর এবং আরামবাগ লেক সাইট রোডটি যেন ময়লা আবর্জনা ফেলার এবং প্রস্রাব করার উন্মুক্ত উপযুক্ত স্থান। এই উন্মুক্ত প্রস্রাব শুধু যে অত্র এলাকার বাসিন্দাদের স্বাস্থ্যের উপর ঝুকি ফেলছে তা নয়, নষ্ট করছে পরিবেশ ও দূষিত করছে আরামবাগ লেকটিকে। এই লেকটির তত্ত্বাবধান ঢাকা ওয়াসা কালভার্ট এর এক পাশে দেয়াল নির্মাণ করে দেয়া লেখা বিশেষ বিজ্ঞপ্তিটা যেন উপহাস। ভাবতে পারেন এটা একটা ঢাকা ওয়াসার দায়সারা কর্মকাণ্ড। কথাগুলো বলছিলেন অত্র এলাকার একজন বাসিন্দা।

কালভার্টের যেদিকে ঢাকা ওয়াসার বিশেষ বিজ্ঞপ্তি সম্বলিত দেয়া লেখা, ঠিক তার বিপরীত দিকে আরামবাগ লেক ময়লা আবর্জনায় পরিপূর্ণ। এটা যেন ময়লা আবর্জনা ফেলার নির্ধারিত স্থান। লেকের উপর এই ময়লা আবর্জনার ফেলে তৈরি করা হয়ছে বস্তি। এই বস্তিবাসীর চলাচলের জন্য ময়লা আবর্জনা ফেলে তৈরি করা হয়েছে মাটির রাস্তা ও বাঁশের সাঁকো। লেকটি অধিক অংশ দখল করে টিন বাশ কাঠ চাটাই চটি দ্বারা নির্মাণ করা হয়েছে অসংখ্য ঝুলন্ত ঘর আর ঝুলন্ত পায়খানা।

আরামবাগ লেকের উপর নির্মিত সাঁকোতে দাঁড়িয়ে বস্তিবাসীর সাথে কথা বলতে দেখা যায় রূপনগর আবাসিক এলাকার পরিচিত রিফাহ কিন্ডারগার্টেন এন্ড স্কুলের শিক্ষিকা জান্নাত ম্যাডামকে। উনার কাছে জানতে চাওয়া হয় কী নিয়ে আলোচনা করছেন? উনি জানান আমরা সুবিধা বঞ্চিত শিশুদেরকে শিক্ষার আলো পৌঁছে দেবার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। এরই ধারাবাহিকতায় আজ এখানে এই বস্তিবাসী ও তাদের সন্তানদের সাথে আলোচনা করছি।

জানতে চাওয়া হয় আপনাদের বেসরকারি স্কুল এই বস্তিবাসী ও সুবিধা বঞ্চিত ছাত্রছাত্রীদের কী ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকেন? উনি জানান আমরা সুবিধা বঞ্চিত শিশু এবং তাদের অভিভাবকদের পড়াশুনার প্রতি আগ্রহ জাগানোর জন্য মাঠ পর্যায়ে কাজ করছি। আমাদের প্রতিষ্টান বস্তিবাসী ও সুবিদা বঞ্চিত ছাত্রছাত্রীদের থেকে কোন প্রকার বাৎসরিক ভর্তি ফি আদায় করেনা, এবং মাসিক বেতন অর্ধেক করে দেয়।

উনার কাছে পুনরায় জানতে চাওয়া হয় অত্র এলাকা বা তার আশেপাশে কি কোন সরকারি স্কুল এবং এনজিও স্কুল নেই? উনি জানান অত্র এলাকায় কোন সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই। নেই কোনো এনজিও স্কুলও। তবে এখানে একটি শিক্ষা মন্ত্রনালয় নিয়ন্ত্রিত হাই স্কুল এন্ড কলেজ আছে। যার নাম রূপনগর মডেল হাই স্কুল এন্ড কলেজ। সেখানের শিক্ষা খরচ অনেক নামিদামি বেসরকারি স্কুল কলেজকে হার মানায়। তবে এখানে সুপ্রতিষ্টিত পরিবারের সন্তানদের শিক্ষা ব্যবস্থা যে খুব নাজুক তা কিন্তু নয়। অত্র এলাকায় রয়েছে অসংখ্য বেসরকারি স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়। যা মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, বস্তিবাসী ও সুবিধা বঞ্চিত অবিভাবক ও তাদের সন্তানদের নাগালের বাহিরে। আমি আগে একটি ব্র্যাক স্কুলে শিক্ষা বিস্তারের জন্য কাজ করেছি। ব্র্যাক স্কুলটি এখান থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে। সেখানে একটি সরকারী প্রাইমারি স্কুল ও আছে। অত্র এলাকার ছাত্রছাত্রীদের সেই ব্রাক ও সরকারী প্রাইমারী স্কুলে যাওয়া সম্ভব নয়। তবে আমি খুব শীঘ্রই আমার পুরাতন ব্র্যাক স্কুলের সাথে কথা বলবো উনারা যেন উনাদের একটি শাখা এখানে দেন।

উনার এবং উনার বর্তমান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মঙ্গল কামনা করে বিদায় নিতে গেলে উনি উনার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একটি লিফলেট এবং সাদা কাগজে লেখা উনার নাম এবং মোবাইল নাম্বার লেখা একটা চিরকুট দিয়ে বলেন এটা আমি অত্র এলাকার সকল মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, বস্তিবাসী ও সুবিদা বঞ্চিত অবিভাবকদের দিয়ে থাকি। যে কোন প্রয়োজনে যোগাযোগ করার জন্য। আপনার বেলাতেও তাই। উনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নেওয়া হয়।

রূপনগর আবাসিক এলাকা ঘুরে দেখা যায় মেইন রোড, অলি গলিতে নির্মাণাধীন সামগ্রী ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা। এতে বড় বড় সড়কগুলো সরু হয়ে পরেছে। বাড়ছে যানজট, ঘটছে ছোট বড় বিভিন্ন দুর্ঘটনা। হচ্ছে অহরহ হাতাহাতি, ঝগড়াঝাটি। কথাগুলি বলছিলেন স্থানীয় একজন মুদির দোকানি।

সুপরিকল্পিত রূপনগর আবাসিক এলাকায় নেই কাচা বাজারের কোন নির্ধারিত স্থান। মেইন রোডের দু-পাশে যত্রতত্র রাস্তা দখল করে যেখানে সেখানে বসে কাঁচা বাজার। মাছ-মাংস-শাক-সবজি ইত্যাদি বিক্রি করা হয় খোলা আকাশের নিচে, খোলা পরিবেশে। এই বাজারগুলোর ময়লা পানি, পলিথিন, পরিত্যক্ত ময়লা সামগ্রী রাস্থাঘাট করছে নোংরা ও কাদা মাখা। যা প্রকাশ্যে রূপনগরের রূপ ও পরিবেশ নষ্ট করছে, এবং বাড়াচ্ছে রূপনগরবাসীর স্বাস্থ্যের উপর ঝুঁকি।

গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের নিয়মে আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, বাণিজ্যিক ভবন সম্পূর্ণ অবৈধ হলেও রূপনগর সুপরিকল্পিত আবাসিক এলাকার অধিকাংশ ভবন জুড়ে রয়েছে অসংখ্য বাণিজ্যিক প্রতিঠান। জরুরি প্রয়োজনীয় মুদির দোকান, ফার্মেসি, রেস্টুরেন্ট ছাড়াও রয়েছে অসংখ্য সুপার সপ, ব্যাংক, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, কোচিং সেন্টার, বেসরকারি হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, বিউটি পার্লার, বুটিক হাউজ ইত্যাদি।

রূপনগর আবাসিক এলাকার অধিকাংশ রাস্তাঘাট ভাঙ্গাচোরা। রাস্তার পাশে নালার উপর কালভার্টগুলো ভাঙ্গাচোরা প্রায় সময় ঘটে বিভিন্ন দুর্ঘটনা । বিভিন্ন নির্মাণ সামগ্রী রাখা ও ফুটপাতের দোকানের ময়লা পানি এই ভাঙ্গা চুড়া রাস্তার জন্য সবচেয়ে দায়ী। কথাগুলো বলছিলেন ফুটপাত হাঁটারত একজন পথচারি।

মিরপুর সেকশন-২ শিয়ালবাড়ি মোড় দিয়ে রূপনগর মেইন রোড দিয়ে ঢুকলেই যে কারো নজর কাড়বে বৃহৎ আকারের তিনটি ভাঙ্গা পুরাতন ডাস্টবিন। সেখানে ডাস্টবিনে যতো ময়লা আবর্জনা নেই তার চেয়ে বেশি আবর্জনা ছড়িয়েছিটিয়ে থাকে রাস্তা ও তার পাশের ফুটপাতে। রাস্তার ঐ পাশ দিয়ে নাক চেপে পথ হাঁটা দায়। তাই রাস্তার উল্টা পাশেই হাঁটছি; বলছিলেন একজন ভূক্তভোগী পথচারী। দিনরাত ২৪ ঘন্টা এখানে যত্রতত্র ময়লা আবর্জনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। এটাই বর্তমান রূপনগরের প্রকৃত রূপ বলে উপহাস করেন  আরেক স্থানীয় পথচারী।