‍‌আওয়াজ আগ্রাসন!!

নুরুল ইসলাম খান
Published : 31 Jan 2012, 08:37 AM
Updated : 31 Jan 2012, 08:37 AM

অফিস করে বিকালে বাসায় ফিরার উদ্দেশে দীর্ঘ লাইনে দাড়িয়ে থেকে অবশেষে পাবলিক বাসে উঠেছি। তবে বাসে বসতে পারা তো দূরে থাক পায়ের পাতা দুটো রেখে দাড়িয়ে থাকাটাই ভীষণ কষ্টকর। পরবর্তী ষ্টেশনে যেতেই পাশের একটি আসন খালি হওয়ায় অশেষ রহমতে একটা আসন পেয়ে গেলাম। আসনে বসেছি, কিন্তু হায় এ কী নির্মম পরিহাস! পঞ্চাশোর্ধ বাবার বয়সী আমার আসনের পাশের ভদ্র লোকটি উচ্চ আওয়াজে মোবাইল সেটে ওয়াজের রেকর্ড বাজানো শুরু করেছেন। উপস্থিত সকলের এবং আমার চেহারায় এক চরম বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট হয়েছে । মানুষগুলো কিছু বলতে চাচ্ছে কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার সৃষ্ট ধর্মীয় জুজুর ভয়ে বলতে পারছেনা, স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। কিন্তু মহাশয়ের ভাবখানা এমন যেন তিনি খুবই লাভ (ছওয়াব)কামাই করছেন নিজে ওয়াজ (বক্তব্য) শুনে এবং অন্যকে অতি উচ্চ আওয়াজে জোর-জবরদস্তি করে শোনানোর মাধ্যমে ছওয়াব (লাভ) কামাই করাতে বাধ্য করে। তদুপরি বক্তব্য (ওয়াজ) টি যখন এমন শোনা গেল যে, কাঁদেন কাঁদেন, কাঁদতে না পারলে কাঁদার অভিনয় করেন। তখন নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না। ভদ্র (?) লোকটিকে বলতে বাধ্য হলাম ‍‌"চাচা আপনার মোবাইলে হেড ফোন আছে কী?"যদি থাকে,তবে এ মুহুর্তে নিজের মধ্যেই এর সীমাবদ্ধ রাখলে সকলের জন্য শান্তি (ইসলাম) বর্ষিত হয়। বলতেই লোকটি আমাকে ক্ষীন স্বরে বেঈমান বলে (বির বির করে) জিজ্ঞাসা করে কেন? কোন সমস্যা?? আমি বললাম জ্বী। অত:পর চরম বিরক্তি সহকারে রেকর্ডটি বন্ধ করে এবং আমার নাম ও পিতার নাম জেনে নেন। সাম্প্রদায়িকতার সৃষ্ট ধর্মীয় কোন দলটির পক্ষে আমার অবস্থান হতে পারে নাম জানার মাধ্যমে হয়ত সে সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে নিলেন।

বাড়ীতে ফিরলাম। শীতের রাত। শীতের ঋতুতে বাড়ীর চারপাশের পরিবেশও শব্দ দুষনে ভরপুর। কারণ, মানুষের চলাচলের রাস্তাঘাট বন্ধ করে রাস্তার মধ্যে চিৎকার-চেচামেচি, হাউ-মাউ প্রযুক্ত কথিত ওয়াজ (বক্তব্য) শুরু হয়েছে। জরুরী প্রয়োজনে অসুস্থ মুমুর্ষ রোগীগণ কীভাবে জরুরী স্বাস্থ্য সেবা নিবেন এ ব্যাপারে চিন্তাটিও করেনি, অথচ মানুষকে হেদায়েতের কথা বলা হয়। দেখা যায় জরুরী প্রয়োজনে রাস্তা ব্যবহার করতে না পেরে অনেক মুমুর্ষ রোগী মারা যান। ৮/১০ দিন করে দল-উপ দলীয় বিভিন্ন সংগঠনের নামে প্রায় পুরো শীতকাল ব্যাপীয়া মজুরীর বিনিময়ে অতি আওয়াজে কথিত ইসলামী (শান্তিবাদী) ওয়াজ (বক্তব্য) অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে। অথচ এ সময়টাতে শুরু হয়েছে প্রাইমারী স্কুলের বাচ্চাদের সমাপনী পরীক্ষা,অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীদের পরীক্ষা। এছাড়াও আছে অসুস্থ-রোগী, বৃদ্ধ বয়সী এবং শিশু বাচ্চা মানুষ। এসব মানুষের ভোগান্তির কথা একটি বারের জন্যও আমলে না এনে কীভাবে ইসলামী (শান্তিবাদী)দাবী করে ২০/২৫ টিরও অধিক মাইক ব্যবহার করে অতি আওয়াজে ওয়াজ (বক্তব্য) অনুষ্ঠান করতে পারে??? অথচ এভাবে অশান্তি (অনইসলামী)সৃষ্টি করে ২০/২৫ টির অধিক মাইক লাগিয়ে ধর্ম প্রচার বা এভাবে জোর-জবরদস্তি করা বা খবরদারি করার জন্য রাসুলগনও অনুমোদন পায়নি। কোরানে জোর-জুলুম হারাম! কোরান দেখুন:

[৩৯:যুমার-৪১] মানুষের জন্য আমি তোমার নিকট সত্য সনাতন বানী দান করেছি;অত:পর যদি সে সৎপথ ধারণ করে, সে তা নিজের জন্যই করবে; আর যদি অসৎ পথ ধারণ করে, তবে তা-ও সে নিজের জন্য করবে; কিন্তু তুমি (মোহাম্মদ) তাদের ওপর খবরদারি (জোর-জবরদস্তি) করার কেউ নও।

[২:বাকারা-২৫৬]ধর্মাধর্মে কোন প্রকার জুলুম জবরদস্তি নেই; যেহেতু সত্য মিথ্যা দু'টোই সুষ্পষ্ট।

[১৬:নাহল-১২৫] যুক্তিপূর্ন উপদেশ ও কলা- কৌশলের মাধ্যমে তুমি তাদের আল্লাহর পথে আহ্বান কর; তাদের সঙ্গে ভদ্র, নম্র ও অমায়িক ব্যবহার কর। কে পথে আসে আর কে বিপথগামী হয় সে সমন্ধে তোমার প্রতিপালক অবগত আছেন।

অর্থাৎ মানুষের সমান অধিকার, স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা বিধানই ইসলামী (শান্তিবাদী) মূলমন্ত্র।

পরিশেষে, এ প্রেক্ষিতে আমাদের ৪ বছরের ছোট্ট ছেলেটির একটি বাস্তবিক কথা মনে পড়ছে। তাকে তার আপা (দাদি)ও দাদা ভাই ওয়াজ বলাতে শিখাতে বহু চেষ্টা করেও ব্যর্থ, সে ওয়াজ (বক্তব্য) কে ওয়াজ বলতে চায় না বা বলে না, তবে যা বলে, যথার্থই বলে, তা হচ্ছে "আওয়াজ!"। এ ‍‌"আওয়াজ!" সংস্কৃতির আগ্রাসন থেকে গণ মানুষের তথা ভবিষ্যত প্রজন্মের মুক্তি চাই। বিনীত