এত ‘লীগ’ দিয়ে আমরা কী করিব!

রাশিদুল রাশেদ
Published : 14 Feb 2012, 01:00 PM
Updated : 1 August 2021, 01:50 AM

'বাংলাদেশ আওয়ামী চাকরিজীবী লীগ'- নামের একটি সংগঠনের নাম নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে আলোচনা, সমালোচনা, ঠাট্টা-বিদ্রুপ, হাসি-তামাশা চলছে। সেই সংগঠনের প্রধান হিসেবে দাবি করা দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর পরিচালক ও জয়যাত্রা গ্রুপের কর্ণধার হেলেনা জাহাঙ্গীরকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। তাকে দল থেকেও বহিষ্কার করা হয়েছে।

এ সংক্রান্ত খবরের বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম- এর গত কয়েকদিনের শিরোনামগুলো এরকম- 'বাড়িতে অভিযানের পর আটক হেলেনা জাহাঙ্গীর',  আওয়ামী লীগের পদ হারালেন হেলেনা জাহাঙ্গীর', 'হেলেনা জাহাঙ্গীরের বিপক্ষে ৫ মামলা হবে-র‌্যাব', সেফুদার সঙ্গে 'লেনদেন' ছিল হেলেনা জাহাঙ্গীরের: র‌্যাব। 

গণমাধ্যমে আসা তথ্য অনুযায়ী, হেলেনা জাহাঙ্গীর আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক উপ-কমিটিতে সদস্য ছিলেন। কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগেরও উপদেষ্টা পরিষদে ছিলেন। 'বাংলাদেশ আওয়ামী চাকরিজীবী লীগ'- নামের সংগঠনে তার সভাপতি হওয়ার খবর চাউর হলে সম্প্রতি তাকে দুই কমিটি থেকে বাদ দিয়েছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু আমাদের আলোচনার বিষয়, আওয়ামী লীগের এই সিদ্ধান্ত নয়, তাদের করণীয় এবং রাজনীতির মূল আদর্শ।

রাজনীতি করতে হয় অবশ্যই মেধা ও মননশীলতার উপর নির্ভর করে। এর বিকল্প কিছু রাজনীতিতে কোনকিছু নেই। মেধা-মনন, চিন্তা-চেতনা, আদর্শ ব্যতীত রাজনীতি তার নিজস্ব স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলে। দলীয় রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো হলো মেধা-মনন, চিন্তা-চেতনা আর আদর্শ আর সর্বোপরি দেশপ্রেম ও নাগরিকের প্রতি সেবা করার দায়বদ্ধতা।

গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় দলের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর এটা নিশ্চিত যে, পৃথিবীর প্রতিটি রাষ্ট্রে দলের অস্তিত্বের কারণে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও বাস্তবায়নের কৌশল অবলম্বন হয়ে থাকে খুব সহসা। বাংলাদেশের রাজনীতিতেও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একটি গুরুত্বপূর্ণ দল হিসেবে জনগণের কাছে সমধিক পরিচিত। বাংলাদেশের স্বাধীনতাসহ বহু উল্লেখযোগ্য অবদান এ দলের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে। এর আগে ১৯৪৮ সালের ২৩ জুন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরপরই জনস্বার্থরক্ষাকারী দল হিসেবে পূর্ববাংলার মানুষের কাছে যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল দলটি।

বর্তমানে দলটি দীর্ঘ সাড়ে বারো বছর ক্ষমতায় রয়েছে। কোথাও কোথাও ভালো দক্ষতা ও দায়বদ্ধতা নিয়ে দলটি বেশ ভালো করে যাচ্ছে। দলের সবশেষ গঠনতন্ত্র সংশোধন অনুযায়ী দলটির অবকাঠামো নিম্নলিখিত অবস্থায় আছে। যেমন-

মূল দল: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ

সহযোগী সংগঠন: ১. যুবলীগ, ২. স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ৩. কৃষক লীগ, ৪. মহিলা লীগ, ৫. যুব মহিলা লীগ, ৬. তাঁতী লীগ, ৭. মৎস্যজীবী লীগ, ৮. আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ।

এছাড়া ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন: ১. ছাত্রলীগ, ২. জাতীয় শ্রমিক লীগ ।

নীতিগত সংগঠন: ১. মহিলা শ্রমিক লীগ ও ২.স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ।

মূল দলের সাথে যেসব সম্পাদকমণ্ডলী রয়েছেন, তার প্রতিটি সম্পাদকের সাথে একটি করে উপ-কমিটি থাকবে সুনির্দিষ্ট কিছু সদস্য নিয়ে। এর বাইরে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আর কোনও সহযোগী, ভ্রাতৃপ্রতিম কিংবা নীতিগত সংগঠন নেই।

কিন্তু আমরা লক্ষ্য করছি যে, এর বাইরে বিভিন্ন নামের সাথে 'লীগ' শব্দটি ব্যবহার করে বিভিন্ন ধান্ধাবাজ, প্রতারক ও বাটপার সুবিধাবাদীরা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের চরিত্র হনন করে যাচ্ছে নিয়মিত। যে কারণে গত কয়েকদিন আগে হেলেনা জাহাঙ্গীরকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। পাশাপাশি দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা তার কার্যক্রমের জন্য বিব্রতবোধ করেছেন বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন গণমাধ্যমে। আর এসব ভূঁইফোড় সংগঠনের জন্য আওয়ামী লীগের সাধারণ ও ত্যাগী কর্মীরাও বিব্রতবোধ করছেন বলে আমি মনে করি।

আওয়ামী লীগের নামে যেসব সংগঠনের নাম খুঁজে পাওয়া যায় সেগুলোর একটা তালিকা দেওয়ার চেষ্টা করা হলো-

১. জননেত্রী শেখ হাসিনা কেন্দ্রীয় লীগ ২. জননেত্রী শেখ হাসিনা কেন্দ্রীয় সংসদ ৩. আওয়ামী প্রচার লীগ ৪. আওয়ামী সমবায় লীগ ৫. আওয়ামী তৃণমূল লীগ ৬. আওয়ামী ছিন্নমূল হকার্স লীগ ৭. আওয়ামী মোটরচালক লীগ ৮. আওয়ামী তরুণ লীগ ৯. আওয়ামী রিকশা মালিক-শ্রমিক ঐক্য লীগ ১০. আওয়ামী যুব হকার্স লীগ ১১. আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগ ১২. আওয়ামী পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা লীগ ১৩. আওয়ামী পরিবহন শ্রমিক লীগ ১৪. আওয়ামী নৌকার মাঝি শ্রমিক লীগ ১৫. আওয়ামী ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী লীগ ১৬. আওয়ামী যুব সাংস্কৃতিক জোট ১৭. বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও চেতনা গবেষণা পরিষদ ১৮. বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগ ১৯. বঙ্গবন্ধু একাডেমি ২০. বঙ্গবন্ধু নাগরিক সংহতি পরিষদ ২১. বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন ২২. বঙ্গবন্ধু লেখক লীগ ২৩. বঙ্গবন্ধু প্রজন্ম লীগ ২৪. বঙ্গবন্ধু যুব পরিষদ, ২৫. বঙ্গবন্ধু ছাত্র পরিষদ ২৬. বঙ্গবন্ধু স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ ২৭. বঙ্গবন্ধু বাস্তুহারা লীগ ২৮. বঙ্গবন্ধু আওয়ামী হকার্স ফেডারেশন ২৯. বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারা বাস্তবায়ন পরিষদ ৩০. বঙ্গবন্ধু ডিপ্লোমা প্রকৌশলী পরিষদ ৩১. বঙ্গবন্ধু গ্রাম ডাক্তার পরিষদ ৩২. বঙ্গবন্ধু নাগরিক সংহতি পরিষদ ৩৩. বঙ্গবন্ধু লেখক লীগ ৩৪. বঙ্গবন্ধু গবেষণা পরিষদ ৩৫. বঙ্গবন্ধু আদর্শ পরিষদ ৩৬. আমরা মুজিব সেনা ৩৭. আমরা মুজিব হবো ৩৮. চেতনায় মুজিব ৩৯. বঙ্গবন্ধুর সৈনিক লীগ ৪০. মুক্তিযোদ্ধা তরুণ লীগ ৪১. নৌকার সমর্থক গোষ্ঠী ৪২. দেশীয় চিকিৎসক লীগ ৪৩. ছিন্নমূল মৎস্যজীবী লীগ ৪৪. ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী লীগ ৪৫. নৌকার নতুন প্রজন্ম ৪৬. ডিজিটাল ছাত্রলীগ ৪৭. ডিজিটাল আওয়ামী প্রজন্ম লীগ ৪৮. ডিজিটাল আওয়ামী ওলামা লীগ ৪৯. বাংলাদেশ আওয়ামী পর্যটন লীগ ৫০. ঠিকানা বাংলাদেশ ৫১. জনতার প্রত্যাশা ৫২. রাসেল মেমোরিয়াল একাডেমি ৫৩. জননেত্রী পরিষদ ৫৪. দেশরত্ন পরিষদ ৫৫. বঙ্গমাতা পরিষদ ৫৬. বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব পরিষদ ৫৭. আমরা নৌকার প্রজন্ম ৫৮. আওয়ামী শিশু যুবক সাংস্কৃতিক জোট ৫৯. তৃণমূল লীগ ৬০. একুশে আগস্ট ঘাতক নির্মূল কমিটি ৬১. আওয়ামী প্রচার লীগ ৬২. সজীব ওয়াজেদ জয় লীগ ৬৩. বাংলাদেশ তথ্য-প্রযুক্তি লীগ ৬৪. আওয়ামী শিশু লীগ ৬৫. আওয়ামী তৃণমূল লীগ, ৬৬. আওয়ামী তরুণ প্রজন্ম লীগ, ৬৭. আওয়ামী চাকরিজীবী লীগ, ৬৮. বাংলাদেশ জনসেবা লীগ। ৬৯. বাংলাদেশ বয়স্ক লীগ।

'বাংলাদেশ আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগ' নামেই রয়েছে চারটি সংগঠন! অথচ নিয়ম হলো, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বা তার পরিবারের সদস্যদের নামে কোনও সংগঠন করতে হলে 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট' এর অনুমোদন নিতে হয়। তথাপি অনুমোদন ছাড়াই নামসর্বস্ব সংগঠন নামের মধ্যে বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতা, শেখ রাসেল ও বঙ্গবন্ধু পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের নাম দেদারছে ব্যবহার করা হয়েছে।

সুবিধাবাদীরা জানে এই বাংলায় নিজের অবস্থান পরিবর্তন করতে হলে একটা ট্যাগ দরকার। আর 'বঙ্গবন্ধু' ও বর্তমানে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আওয়ামী লীগের 'লীগ' ট্যাগ ব্যবহার হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। এ ট্যাগকে সময়োপযোগী সবচেয়ে বড় ট্যাগ হিসেবে মনেও করে তারা। কেননা এই ট্যাগ ব্যবহারে তারা যত রকমের তদবির, ডোনেশন পায়, আর কোনভাবেই তা পাওয়া সম্ভব নয়।

সুতরাং বাংলাদেশের প্রাচীনতম একটি দল হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকেই এ ব্যাপারটির ফয়সালা করতে উদ্যোগী হতে হবে। পরিকল্পনা করে এসব ভূঁইফোড় সংগঠনকে গুড়িয়ে দিয়ে জনস্বার্থরক্ষাকারী দল হিসেবে ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে হবে। না হলে ভূঁইফোড় লীগের তোড়ে আসল আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ যে ভেসে যাবে না, তার নিশ্চয়তা কে দিবে?