ফেসবুক ও আমাদের রুচি বিকৃতি

নূরুল ইসলাম
Published : 30 Sept 2012, 07:02 PM
Updated : 30 Sept 2012, 07:02 PM

বন্ধু-বান্ধবদের সাথে যোগাযোগ রাখা, প্রিয় মুহূর্তগুলো শেয়ার করা কিংবা হৃদয়ের শোক গাঁথা প্রিয়জনের মাঝে বিলিয়ে একচিলতে সুখের আশায় আমরা সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন সাইট ব্যবহার করি। তবে, আমাদের দেশের তরুন প্রজন্মের মাঝে ফেসবুকের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। প্রতিদিন ফেসবুকে ঢুঁ মারা যেন আমাদের প্রাত্যহিক কাজেরই অংশ। পুরনো দিনের বন্ধুকে ফেসবুকের মাধ্যমে খোঁজে পাওয়া কিংবা স্ট্যাটাসে সুখ-দুঃখের ফিরিস্তি তুলে ধরে পাওয়া আনন্দের কমতি নেই। তাছাড়া, দুরে কোথাও কোন ফেসবুক বন্ধুর দেখা পেলে অকৃত্রিম মমত্বের দেখাও মেলে প্রায়শ। সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে ফেসবুকের মাধ্যমে হওয়া সামাজিক আন্দোলনের কথাও আমাদের জানা। এটিই আসলে হওয়া উচিত, এটিই ভাল।

কিন্তু আমরা বাঙ্গালীরা যে কোন জিনিসের নেতিবাচক ব্যবহারগুলো হঠাৎ করেই রপ্ত করে ফেলি, আমাদের দুঃখ এখানেই। কারণে অকারণে অপ্রয়োজনীয় ছবি ট্যাগ করে অন্যের ওয়াল দখল করতে আমাদের জুড়ি মেলা ভার। আপত্তিকর ছবি আপলোড করতে এখন আমাদের বিবেকে বাঁধেনা। আমরা ভুলে যাই এসব ছবি প্রিয়জনের মাঝে আমাদের সম্পর্কে বিরূপ মনোভাবের জন্ম দেয়, আমরা সুশীল সমাজের কাছে বিকৃত রুচির মানুষ হিসেবে পরিগণিত হই। আর এসবে অভ্যস্ত হয়ে এক সময় অন্যের মেমোরি কার্ড থেকে আপত্তিকর ছবি হাতিয়ে নিই এবং নকল একাউন্ট খোলে সংশ্নিষ্ট ব্যক্তির জীবনের বারোটা বাজাতেও আমরা এখন পরিপক্ক। কয়েক মাস পূর্বে একটি ফেইক একাউন্ট খোলে একজন ব্যবসায়ীর আপত্তিকর ছবি আপলোড করার কথা আমরা অনেকেই জানি এবং আমাদের অনৈতিক চরিত্রের প্রকাশ ঘটাতে আমাদের বুক তখন একটুও কাঁপেনি। আপত্তিকর ছবির মানুষটিকে আমরা আলোচনার রসদ বানিয়েছি, জেল খাটিয়েছি, সুযোগ সন্ধানী সংবাদকর্মীরা যা পারি হাতিয়ে নিয়েছি। সাবাশ! তারুন্য (?)। এতেও কি আমরা ক্ষান্ত হয়েছি? হইনি, রিপুর তাড়নায় হয়ত ওঁৎপেতে ছিলাম। তাই গত সপ্তাহেও আমরা দেখেছি, নকল আইডি খোলে অপর এক ব্যবসায়ীর মান সম্মান ধুলায় মিশিয়েছি আমাদেরই কেউ না কেউ। আমরা এসব নিকুচি করি। ভাগ্য ভাল, বেশি জানাজানি হওয়ার পূর্বেই আমরা তিন বন্ধু মিলে ঐ আইডি ডিলিট করে দিতে সক্ষম হই। আহা রে! এমনও দেখা গেছে, ভিনদেশী মেয়ের সাথে ফেসবুকে বন্ধুত্ব হওয়ার সুবাদে তাকে নিয়ে আমরা দ্বৈত জীবনের স্বপ্ন দেখি, ঘরে থাকা প্রিয়তমা স্ত্রীর কথা আমরা ভুলে যাই, আমাদের সন্তানের স্বর্গীয় চাহনির কথাও তখন অনৈতিকতা থেকে আমাদের দুরে রাখেনা। তাই, ভিনদেশী মেয়ে বন্ধুকে আমরা অনেকে অবিবাহিত বলে শপথ করি! নিজের স্বত্তাকে ভুলুণ্ঠিত করি। অনেকে আবার ব্যবসা-বানিজ্য ছেড়ে দিয়ে মূল্যবান সময়ের বেশিরভাগই ফেসবুকে কাটায়, চোখে পড়ে এমনও। এসব আমাদের মতো গরীব দেশের জন্য বেমানান, তারুণ্যের অবমাননা, নৈতিক অবক্ষয়ের হাতিয়ার। তাছাড়া, কারো আপত্তিকর ছবি ফেসবুকে ছড়ালে আমাদের অনেক সংবাদকর্মী ভাইদের যেন পৌষ মাসের দেখা মেলে। আমাদের হীনমন্যতায় প্রযুক্তির শিকার হওয়া মানুষটির কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেওয়া থেকে আমাদের বিবেক আমাদের নিবৃত্ত করতে পারেনা। অথচ, আমাদের দেখতে হয় সেই সংবাদকর্মীদের কেহ কেহ জব্দকৃত ইলিশ মাছ পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে চুরি করে এবং পরিজনদের খাওয়ায়! আর আমরাও কেমন মানুষ, আপত্তিকর ছবি মোবাইলে ধারণ করতে আমাদের বিবেক কেমনে সায় দেয়! বুঝিনা। পৃথিবী এগুচ্ছে সুন্দরের দিকে, আমরা ছাগলের মতো পেছনে যাব কোন্ দুঃখে। তাই, আসুন নিজে বদলাই এবং অন্যকে বদলানোর পরিবেশ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখি। দেখবেন, সুশীল সমাজ আমাদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।

প্রিয়, সাবধানের মার নেই আমরা জানি, তাই চলেন একটু সাবধানী হই,
(১) আমরা ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলব এবং কখনো আপত্তিকর ছবি মোবাইলে ধারণ করার ধৃষ্টতা দেখাবো না।

(২) ফেসবুককে আমরা সুন্দরের কাজে ব্যবহার করবো, অন্যের ক্ষতি করার মানসে প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধে স্ব-অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখবো।

(৩) ছেলে হয়ে মেয়ে সাজার অর্থ নিজের পৌরুষকে অপমান করা। তাই ছেলেরা মেয়ে সেজে ফেসবুক ব্যবহার থেকে আমরা বিরত থাকবো।

(৪) নিজের সময়ের মূল্য দিয়ে নিজেকে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করবো। মূল্যবান সময়গুলো ফেসবুকের পেছনে ব্যয় করে নিজের সুন্দর ভবিষ্যতকে কণ্টকাকীর্ণ করা থেকে আমরা বিরত থাকবো।

(৫) অসুন্দর ও আপত্তিকর ছবি আমরা কখনো ফেসবুকে আপলোড করবো না।

(৬) মোবাইলে গান আপলোডের জন্য যারা দোকানে যান, তাদের স্মরণ থাকা উচিত যে, অনেক কম্পিউটার দোকানের অপারেটর নিজের ভান্ডার সমৃদ্ধ করার জন্য গ্রাহকের মেমোরি কার্ড চষে বেড়ান। কোন্ ফাঁকে যে তারা আপনার তথ্য চুরি করবেন তা আপনি টেরই পাবেন না। তাই, ব্যক্তিগত ডাটা আছে এমন মেমোরি কার্ড কম্পিউটারের দোকানে নিয়ে যাবেন না। প্রয়োজনে দু'টি মেমোরি কার্ড ব্যবহার করুন। একটি ব্যক্তিগত ডাটা রাখার কাজে এবং অন্যটি গান আপলোড করার জন্য কাজে লাগান।

(৭) নিজের ব্যক্তিগত ডাটা কখনো আমরা অপরের কম্পিউটারের দোকানে জমা রাখবো না।

(৮) অন্যের কম্পিউটার কিংবা মোবাইলে ফেসবুক ব্যবহার করার সময় কখনো রিমেম্বার পাসওয়ার্ড অপশনে ক্লিক করবো না, কারণ তখন পাসওয়ার্ড ব্রাউজারে রেকর্ড হয়ে যায়। আর কাজ শেষে লগ আউট দিতে আমরা ভুলবো না।

(৯) নিজের পাসওয়ার্ড আমরা কখনো অন্যের কাছে প্রকাশ করবো না, প্রকাশ হয়ে গেলে সাথে সাথেই পাসওয়ার্ড চেঞ্জ করে দেবো।

(১০) ফেসবুক সংক্রান্ত গুরুতর সমস্যা হলে ডালপালা গজানোর পূর্বে ফেসবুকের বিষয়ে ভাল জানা মানুষদের নিকট থেকে দ্রুত সহযোগিতা নেবো।
হে সবুজ, অন্যের আপত্তিকর ছবি প্রকাশের মাঝে বাহাদুরির কিছু নেই। ফেসবুকে অন্যকে হেয় করার মাধ্যমে তারুন্যের অপমান হয়, প্রযুক্তির অপব্যবহার হয়- এটি আমাদের মানা উচিত। চোখ মেলে তাকান, আমাদের মতো তরুণেরাই তো সিন্ধু সেচে মুক্তা আনেন, মানবিক সমাজের জন্য নিজেকে মেলে ধরেন, আর্ত মানবতার কল্যাণে নিজেকে সঁপে দেন। এসো হে তরুন, আমরাও শামিল হই তাঁদের কাতারে, অনন্য সুন্দরের পথে, আলোকিত জীবনের অভিযাত্রায়।