নৈসর্গিক নান্দনিক নরক নবোরিবেতসু, হোক্কাইডো, জাপান

নুরুন নাহার লিলিয়ান
Published : 23 June 2015, 08:54 PM
Updated : 23 June 2015, 08:54 PM

নৈসর্গিক নান্দনিক নরক নবোরিবেতসু! নরক ও আবার নান্দনিক হয় আমার জানা ছিলনা। এই নবোরিবেতসু নামক নরকের নৈসর্গিক নান্দনিকতায় আমার দুই চোখ মুগ্ধ হয়েছিল। তাই অনেক ভ্রমনের মাঝে নান্দনিক নরকে যাওয়ার অভিজ্ঞতাটা ভিন্ন অনুভুতি নিয়ে আমার স্মৃতিতে আছে। জীবনের অনেক নৈব্যক্তিক সুখ স্মৃতির মাঝে অন্য জায়গা করে নিয়েছে। বছর দুই আগে আমার জাপানিজ দাদি আমাকে মজা করে জানালেন নরকে যাবে? আমি তো অবাক। ভাবলাম বয়সের ভারে বুড়ি হয়তো আবল তাবল বলছে। আর নয়তো মজা করছে। বুড়ির নাম চিয় সাইতো  অবসর প্রাপ্ত প্রিন্সিপাল। এক সময়ের শিল্পপতির কন্যা । দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ এবং জাপান সংস্কৃতি নিয়ে আমার অনেক কৌতূহল । তাই তিনি আমাকে হোক্কাইডোর অনেক ঐতিহাসিক এবং প্রাচীন জায়গা ঘুরে ঘুরে দেখিয়েছেন। প্রায় ৭০ টি দেশ তিনি ভ্রমন করেছেন । বর্তমানে তিনি অনেক স্বেচ্ছামূলক সংগঠন এর দায়িত্ব ও পালন করছেন । এখানকার অনেক অনেক সংস্কার এবং সংস্কৃতি তিনি আমার কাছে পরিচিত করেছেন ।

এই বৃদ্ধার স্বামীর নাম রিউহে সাইতো। তিনি এক সময় বিপ্লবী নেতা ছিলেন । এই বৃদ্ধ দম্পতির সাথে আমার এক জাপানিজ মেয়ে বন্ধুর মাধ্যমে পরিচয় হয় । জাপানিজ সংস্কৃতিতে বিদেশিদের আত্মীয় বানানো এক ধরনের বিনয় । আর সারা বিশ্ব মানচিত্রে জাপান বিনয়ের জন্য বিখ্যাত। আর এই বিনয়ে আমি এবং আমার স্বামীও মুগ্ধ তাদের নাতি-নাতনি হতে পেরে। বাংলাদেশের প্রচলিত পারিবারিক নিয়মেই আমার বিয়ে হয় । বিয়ের আগে স্বামী সম্পর্কে পরিবারের লোক জনের খোঁজ খবর আর আমার সাথে সামান্য কথা কথা বার্তা । বিয়ের পর সরাসরি স্বামীর কর্মস্থল জাপান ।স্বামী তরুন বিজ্ঞানী হোক্কাইডো বিশ্ব বিদ্যালয়ে গবেষণা করছেন । তাই বিয়ের পর একজন নতুন মানুষ এবং পরিবেশ কে একটু একটু করে জানার মধ্যেও আলাদা রোমাঞ্চকর অনুভুতি কাজ করে । চিন্তার জগতে স্বপ্নদের এক রহস্যময় ভ্রমন । যাইহোক এই জাপানিজ দাদা দাদি নিয়ে আমরা প্রায় প্রতি ছুটির দিনে ঘুরতে যাই। সময়টা ছিল অক্টোবর মাস। সেদিন ভোর ছয়টার দিকে আমাদের দাদা দাদি গাড়ি নিয়ে এসে হাজির আমাদের বাসার নিচে । সব সময় ঘুরতে গেলে আমি কিছু বাংলাদেশি খাবার রান্না করি। কারন আমি চাই বাংলাদেশি জীবন সংস্কৃতির বিনিময় হোক। জাপানিজরা ঝাল খেতে পারেনা। সেদিকে খেয়াল রেখে বাংলাদেশি চিনি গুরা চালের বাদাম পোলাও ,মুরগির রোস্ট, ইলিশ মাছের দোপিঁয়াজো, ঘন দুধের পায়েস, কিছু ফল আর পানীয় । অনেক দুরের পথ । আমরা চারজন সাপ্পোরো শহর থেকে রওনা করলাম । গাড়ি চালাচ্ছেন আমাদের জাপানিজ তেষট্টি বছর বয়সী দাদা রিউহে সাইতো । ওরা একটু চিন্তা করছিল আমাদের নিয়ে । কারন এতো সকালে দুরের যাত্রায় আমাদের কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা । দূরের পথের একঘেয়েমি দূর করতে আমরা কথা শুরু করলাম । পরস্পরকে আরও একটু জানা শোনা ।

রিউহে সাইতো অরেঞ্জ ফ্লেভার এর চা বানিয়ে এনেছে । আর দাদি চিয় সাইতো অনেক ধরনের জাপানিজ কুকি,কেক,চকলেট আর গরম কফি । তিনি সবাইকে গাড়ির মধ্যেই যে যা খেতে চায় দিলেন । রিউহে সাইতো অনেক ধরনের ফ্লেভার এর চা খেতে পছন্দ করে । কথা হচ্ছিল চা নিয়ে । আমার চোখ তখন বাইরের আকাশের রঙ্গিন ছোঁয়ায় মুগ্ধ। উজ্জ্বল শীতের আকাশে সাদা আর নীলের অদ্ভুত খেলা । এ যেন ভিন্ন কোন দুনিয়া । সাদা রঙটাকে ঝাপটে ধরে নীল রঙের যেন বিলাসী আনন্দ । আমার মন গোপনে তখন জীবনানন্দ দাস এর কবিতায় এই হারিয়ে যায় । কতো রঙ কতো দেশ আর কতোই না মানুষ কিন্তু আকাশ কেবল একাকী একটা ।
যে-পাতা সবুজ ছিলো- তবুও হলুদ হ'তে হয়,-
শীতের হাড়ের হাত আজো তারে যায় নাই ছুঁয়ে;-
যে-মুখ যুবার ছিলো- তবু যার হ'য়ে যায় ক্ষয়,
হেমন্ত রাতের আগে ঝ'রে যায়,- প'ড়ে যায় নুয়ে;-
পৃথিবীর এই ব্যথা বিহ্বলতা অন্ধকারে ধুয়ে
পূর্ব সাগরের ঢেউয়ে,- জলে-জলে, পশ্চিম সাগরে
তোমার বিনুনী খুলে,- হেঁট হ'য়ে পা তোমার ধুয়ে,-
তোমার নক্ষত্র জ্বেলে,- তোমার জলের স্বরে-স্বরে
বয়ে যেতে যদি তুমি আকাশের নিচে,- নীল পৃথিবীর 'পরে

নীল পৃথিবীর পথ ধরে পাহাড়ি সুরে গাড়ি ভেসে যাচ্ছিলো আপন আনন্দে। গাড়ির ভিতরেই আমরা হালকা চা কফি আর কেক খেলাম । সাপ্পোরো শহরের দক্ষিন পশ্চিমে প্রায় দুই থেকে তিন ঘণ্টার এক টানা যাত্রা । কতো কতো পাহাড় আর দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে গাড়ি এসে থামল শিকোটশু টয়া ন্যাশনাল পার্ক । অতীত ইতিহাস থেকে জানা যায় ৯৯,৩০২ হেক্টর জমি আর কিছু পাহাড় নিয়ে ১৯৪৯ সালের ১৬ মে এই ভূমির রচনা অঙ্কিত হয়। এর সাথে কোলডেরা লেক অন্তর্ভুক্ত। জাপানিজরা পাহাড় পর্বত আগ্নেয়গিরি সব কিছুর নামের আগে মিস্টার শব্দ ব্যাবহার করে। তাই আমাদের জাপানিজ দাদি চিয় সাইতো পরিচয় করিয়ে দিল মিস্টার ঊশো ,মিস্টার শোয়াসিন জান মিস্টার তাড়ুমায়ে জান এবং মিস্টার এজো ফুজির সাথে। না । উনারা কোন মানুষ নয় । এগুলো সব পাহাড়ের নাম। অদ্ভুত সব ইতিহাস নিয়ে মহাকালের বুকে পাহাড়ি তকমা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ।

জাপানে সবাই মানুষ এবং প্রকৃতির কোন নামের আগে মিস্টার এবং নামের শেষে সান শব্দ ব্যাবহার করে । যেকোন নতুন মানুষ প্রথমে অবাক হবে । মিস্টার অমুক সান । মিস্টার তমুক সান । এমন সংস্কৃতি শুনে আমরা খুব মজা পেলাম । টয়া লেক আর এজো ফুজির সৌন্দর্যে আমরা আত্মহারা । টয়া লেক কে আলিঙ্গন করে এজো ফুজির অদ্ভুত মায়াময় সৌন্দর্য ।সবুজ পাহাড় আর টয়া লেকের পিছনে দাঁড়ানো এজো ফুজি মাথায় সফেদ তুষার পড়ানো মুকুট । এজো ফুজির রাজকীয় ঢং যেকোণ সাধারণ চোখ কে অভিভূত করবে । টোকিও ফুজি পাহাড়ের মতো দেখতে হলেও এর আলাদা ইতিহাস আছে । হোক্কাইডো তে সবাই এই পাহাড় কে এজো ফুজি বলে । এখানে আকর্ষণীয় একটি রোপ ওয়ে হল উশো জান । পাহাড়ের নিচে থেকে তারে টেনে বিশেষ লিফটে আমরা উঠে গেলাম অনেক উপরে । চারিদিকে প্রকৃতির এতো নীল পরিবেশ চোখ যেন সইতে পারছে না । সময় কে সঙ্গে নিয়ে ঘুরা যায়না ।তবে ক্যামেরা বন্দী করে স্মৃতিতে ধরে রাখা যায় । আর সে কাজটা করতে করতেই সকাল পেরিয়ে মধ্যাহ্ন ছুঁই ছুঁই করছে । আমাদের চোখ বিস্ময়ে সৌন্দর্যের পাহাড়ি সমুদ্রে সাতার কাটতে থাকে ।মধ্যাহ্ন ভোজের সময় হয়ে এলো । সৌন্দর্য অবগাহনে সময় ব্যাপারটা যেন নেহায়েত তুচ্ছ ঘটনা । আমরা তখন নবোরিবেতসু ন্যাশনাল পার্ক এর একটি পাহাড়ের উপরে পর্যটকদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা আছে । এই পাহাড়টি খুব বেশি উঁচু নয় ।এর উচ্চতা ৯৩০ মিটার । তবে বেশ অনেক গুলো পাহাড় আর পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে সেখানে পোঁছানোর মধ্যে ও আলাদা অনুভুতি কাজ করে । তারপর খোলা আকাশের নিচে আমার রান্না করা বাংলাদেশি মধ্যাহ্ন ভোজ । খেতে খেতে কথা হয় হোক্কাইডোর মানুষ ,জীবন আর প্রকৃতি নিয়ে । পাহাড় ,সমুদ্র আর দ্বীপের বিচিত্রময় জীবন সংগ্রাম এর গল্প শুনতে শুনতে মধ্যাহ্ন ভোজ শেষ হয়ে আসে।

এরপর আমরা গেলাম জিগোকুদানী ভেলী বা হেল ভ্যালি । নবোরিবেতসু অনসেন এর উপরেই এই হেল ভেলী ।হেল অন আর্থ হিসেবে পরিচিত এই নান্দনিক নরকের আগ্নেয়গিরির মুখের ইতিহাস দশ হাজার বছর আগের । সবচেয়ে মজার বিষয় হল এই ভেলী থেকে বিশ ত্রিশ মিনিট গেলেই অয়ুনুমা গরম পানির ঝরনা, সালফিউরাস পুকুর আর আগ্নেয়গিরির প্রাকৃতিক কার্যক্রম দেখা যায় । এই হট স্প্রিং বা গরম পানির ঝরনাধারা প্রতি মিনিটে ৩০০০ লিটার গরম পানি উৎপাদন করতে পারে । এই ভ্যালি ৪৫০ মিটার প্রস্থ । যা কিনা সারা বিশ্বে ভিন্নধর্মী হট স্প্রিং গুলোর মধ্যে অন্যতম । নবোরিবেতসুর এই হট স্প্রিং এর সাথেই বয়ে গেছে আকর্ষণীয় অয়ুনুমাগাওয়া নদী । যে দিকে তাকালে চোখ প্রশান্তিতে ভরে যায় । এই নরকের নিসর্গীয় সৌন্দর্যে স্বয়ং পিশাচ ও ভালবাসার গান গেয়ে উঠবে ।সৌন্দর্য আর নিসর্গ কাকে না টানে ! সেই সেক্সপিয়ার ,উইলিয়াম ওয়ার্ডস অর্থ থেকে শুরু করে রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর , কবি নজরুল ইসলাম ,জীবনানন্দ দাস সব দেশে সব কালেই কবি ,লেখকগন এই প্রকৃতি ,মানুষ আর ইতিহাস নিয়ে মন ডুবিয়েছেন । লেখার জগতে মনের বিস্তরন দেখিয়েছেন । মানুষের ভিতরের মানুষকে জাগিয়ে রাখতে প্রকৃতি আর মানব প্রেম অনেক বেশি জরুরী । তাই তো কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডস অর্থ ভালবাসা নিয়ে বলেছেন, লাভ, ফেইথফুল লাভ, রিকলড দি দি টু মাই মাইন্ড বাট হাউ কুড আই ফরগেট দি? থ্রো হোয়াট পাওয়ার ! একটু একটু করে আমরা চারপাশ দেখছিলাম । ইতিহাস আর প্রকৃতির সৌন্দর্য বার বার মনটা কে সময়ের অনেক পিছনে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল । এই জায়গাটা সুইসাইড জোন হিসেবে পরিচিত । অনেক আগে এখানে মানুষ কখনও একা কিংবা কখনও দল বেঁধে নাকি পাহাড় থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করতো।

এখানকার মাটিতে সালফার । তাই ঢুকতেই মাটিতে থেকে উঠে আসা পচা ডিমের গন্ধের মতো প্রচণ্ড গন্ধ । তবে কিছুটা সময় গেলে তা সয়ে যায় ।শুধু তা নয় চারিদিকে মাটির ভিতর থেকে উঠে আসা গ্যাসের ধোঁয়া কেমন যেন এক আলো আঁধার পরিবেশ । মনে হবে এই পৃথিবী ছেঁড়ে অন্য কোন দুনিয়া ।ঘুরতে ঘুরতে কোন এক সময় মনে হবে নিজের অস্তিত্ব এই সময় ছেড়ে শত বছর পিছনে । কখনও আবার নিজেকে আবিষ্কার করতে ইচ্ছে হবে চলচ্চিত্রের কোন নৈসর্গিক দৃশ্যে । সত্যি মন হঠাৎ করেই হারিয়ে যায় । এখানে অনি এবং ইনমা নামের বেশ বড় আকর্ষণীয় মূর্তি দেখা যায় । জাপানিজদের অতীত বিশ্বাস যে কোন অশুভ শক্তি থেকে অনি এবং ইনমা দেবতা রূপে নবোরিবেতসু কে রক্ষা করছে ।তারপর ঢোকার পথেই দেখা যায় পিচ্ছিল পথ । যেখানে লেখা আছে বিপদজ্জনক । সেখান থেকে একটু সামনেই আকর্ষণীয় একটি কুয়া । যেখান থেকে গরম পানির ধোঁয়া বের হচ্ছে । অনেক পর্যটক সেই কুয়াতে জাপানিজ কয়েন ফেলে । এখানে কথিত কিছু বিশ্বাস আছে যে মনের যে কোন সুপ্ত বাসনা করে কুয়াতে কয়েন ফেললে তার মনোবাসনা পূর্ণ হয় । কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে কুয়াতে কয়েন ফেলা নিষিদ্ধ করা হয়েছে । বৈজ্ঞানিক ভাবে এভাবে কুয়াতে কয়েন ফেলা বিপদজ্জনক এবং প্রাকৃতিক ভাবে ভারসাম্যহীনতা ডেকে আনে । এরপর হেল অন আর্থ থেকে ফিরে আমরা গেলাম এডো ওয়ান্ডার ল্যান্ড থিম পার্ক । যা কিনা এডো পিরিয়ড এর নিনজা ভিলেজ হিসেবে সমধিক পরিচিত । কিং সউগান এর রাজত্ব এবং সামুরাই সময়ের অবিকল চিত্র কে জীবন্ত তুলে ধরা হয়েছে । ঢুকতেই অনেক নিনজা বা গুপ্তচর কালো পোশাক পরা এবং মুখ কালো কাপরে ঢাকা । নিনজা স্টাইলে হঠাৎ লাফিয়ে পড়ে তাঁরা পর্যটক কিংবা দর্শক কে চমকে দেয় । সকল নারীরা কিমনো মানে জাপানীজ ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে সামুরাই সময়ের প্রেক্ষাপট চিত্রিত করেছে । একটু একটু করে নিনজা ভিলেজের ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে মনে হয় সামুরাই ইতিহাস যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে । যেন সময়টা ১৬০০ থেকে ১৮৬৮ পর্যন্ত আকিরা কুরসোয়া সিনেমার মতো । একটা সময় সামুরাই নিয়ন্ত্রন করতো কিং সউগান । পরে সম্রাট মিজি সিদ্ধান্ত নিলেন । ক্ষমতা পুনরায় দখল নিতে কিং সউগান কে পরাজিত করে ইতিহাসে নতুন অধ্যায় সূচনা করেন । অনেক রেস্টুরেন্ট , সুভেনিয়ার দোকান ,পুরনো ঐতিহাসিক দালান কোঠা , সামুরাই সময়ের ঢাল তলোয়ার , অস্ত্র ,এবং ঐতিহ্যবাহী বাদ্য যন্ত্র সব কিছুই জাদুঘরের আদলে খুব সুন্দর করে রাখা হয়েছে । আমরা যতটা সম্ভব বেশ কয়েকটা ঘরে এবং দোকানে ঢুকে ঢুকে জাপানিজ অতীত ইতিহাস এবং সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হলাম । তবে শেষ আকর্ষণ ছিল দাতে জিদাইমুরা কিং সউগান এর জীবন এবং নারী প্রেম নিয়ে জাপানিজ নাটক ।

থিয়েটারে ঢুকেই দেখা গেল অনেক দেশ থেকে আগত পর্যটক এবং দর্শক । এ এক অদ্ভুত আনন্দময় বিনোদন । অনেক রকমের মানুষ । রানী কে দেখবার জন্য অস্থির উৎসাহ নিয়ে আছে । কিন্তু না । এর আগে আরও অনেক ঘটনা । রানীর সঙ্গে সেই অভিসারে যেতে পারবে যে কিনা যুদ্ধে জয়ী হবে । জাপানের ওসাকা থেকে হোক্কাইডোতে আসা এক অতিথি এবং আমার স্বামী লটারি পর্বে জিতল । এই লটারি বিজয় শেষ নয় । এই দুজন কে তলোয়ারী যুদ্ধে অংশ গ্রহন করতে হবে । আর এই যুদ্ধে যে জয়ী হবে সে পাবে খুব দামি সিরই ওয়াইন বা সাদা মদ। এবং রানীর সাথে অভিসার । যুদ্ধে বাংলাদেশি রাজা হিসেবে জয়ী হল আমার স্বামী । তখন চারিদিকে ব্যাপক করতালি আর উচ্ছাস । যুদ্ধ জয়ী বাংলাদেশী রাজা কে দেখার জন্য দর্শকের অদম্য কৌতূহল । পুরস্কার হিসেবে পাওয়া সিরই ওয়াইন বা সাদা মদ আমার স্বামী নিলেন না । পরাজিত রাজা ওসাকা থেকে আগত ভদ্র লোক কে দিয়ে দিলেন । চারিদিকে দর্শক খুব আনন্দিত বিজয়ী রাজার সত্যিকারের মহত্ত্ব দেখে । এরপর শুরু হল ষ্টেজে রানীর সাথে অভিসার। রাণীর দেখা কী আর সহজে মিলে! অনুষ্ঠানের উপস্থাপক তাকে নিয়ে গেলেন ভিতরে কিং সউগান এর পোশাক পরাতে। তারপর দেখা হল রাজার পোশাকে বের হওয়ার পর রানীর সখীরা তাকে ঘিরে ধরলেন জাপানিজ সুর আর সঙ্গীতের মূর্ছনায় । রানী কে অভিসারে রাজী করানো তো আর সহজ নয় । প্রভাবশালী সামুরাই রাজা সউগান অনেক কিছুর প্রস্তাবের বিনিময়ে রানীর দেখা পান । এক সময় রানী এবং তার সখীরা বাংলাদেশী রাজা কে নিয়ে নাচ আর সঙ্গীতে মেতে উঠেন । তবে আমার স্বামী খুব স্বল্পভাষী এবং অন্তর্মুখী ।তাঁর সাবলীল অভিনয়ে জাপানিজ দাদা দাদি এবং দর্শক স্রোতা অভিভুত। অনুষ্ঠানের শেষে বাংলাদেশের পরিচয় তুলে ধরা হয় । আমাদের সাথে ছবি তোলা হয় । সারাদিনের দীর্ঘ ভ্রমন খুব সুন্দর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে শেষ হল । সময়ের নিয়ম খুব অদ্ভুত । সকাল যখন মহা আনন্দ নিয়ে দিন কে ডাকে মধ্যাহ্ন শেষ হতে সন্ধ্যা নিয়ে আসে আর রাত তখন অভিমানে বাড়ি ফিরে । আমরাও বাড়ি ফিরতে প্রস্তুতি নেই । না । নীল আকাশ যখন কাল হয়ে আসে অনেক স্বপ্ন তখন একটু একটু করে চোখের কোনায় ভিড় করে । আমরা এক জাপানিজ রেস্টুরেন্ট এ আবার বিকেলের খাওয়া পর্ব শেষে গাড়িতে উঠি । শুরু হয় জীবন নিয়ে আবার চলতি পথের আলাপচারিতা ।

দাদা নিজ মুখেই জানালেন তিনি হোক্কাইডো বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করেছেন । অনেক সামাজিক আন্দোলনে অংশ গ্রহন এবং সরকারের সমালোচনা করে নেতৃত্ব দিয়েছেন । আজ হতে অনেক বছর আগে তের বছর বড় বয়সী চিয় কে তিনি ভালবেসে বিয়ে করেছিলেন । তখন জাপান সমাজ ও খুব রক্ষণশীল । শুধু তা নয় চিয় সাইতোর দুটি সন্তান ছিল । সে সন্তানেরা বড় হয়েছে । তাদের ঘরের সন্তানেরাও বড় হয়ে যাচ্ছে । জীবনের অনেক বাঁক পরিবর্তন হয়েছে । কিন্তু ভালবাসার মানুষটির ভালবাসা আগের মতোই আছে । ভালবাসা এমনই দেশ কাল জাতি ধর্ম আর নিয়ম মানে না । অনেক যুগ পেরিয়ে তারা আজ ও একে অপরের হয়ে আছে । এই বৃদ্ধ আর বৃদ্ধার গভীর ভালবাসা ,ত্যাগ ,ধৈর্য সম্মানবোধ জীবন্ত কোন কিংবদন্তীর গল্প হয়ে আমাদের আবিষ্ট করে রাখল ।