জাপানি বৃদ্ধদের সেচ্ছা সেবক সংস্কৃতি এবং বাংলাদেশি চিন্তা

নুরুন নাহার লিলিয়ান
Published : 10 Sept 2015, 05:59 PM
Updated : 10 Sept 2015, 05:59 PM

জাপানি বৃদ্ধদের নিয়ে আন্তর্জাতিক খবরের দুনিয়ায় অনেক রকমের খবর প্রকাশিত হচ্ছে । এই বৃদ্ধদের নিয়ে অনেক রকমের দৃষ্টিভঙ্গি এবং চিন্তা ভাবনা প্রচলিত আছে । প্রতিযোগিতামুলক পৃথিবীতে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে জীবনের গল্প কম বেশি এক । হয়তো ধরনটা আলাদা । খুব ছোট থেকে যখন একটা মানুষ বড় হতে থাকে সে ভাবে কবে বড় হবে । নিজের স্বাধীন চিন্তা আর জীবন উপভোগ করবে। যৌবন হারানোর দুঃখ পৃথিবীর সব মানুষেরপৃথিবীর  আর সময়ের মায়াজালে মানুষের জীবন বড় অসহায় । জাপান আসার পর যা দেখলাম । পথে ঘাটে মাঠে ময়দানে অনেক বৃদ্ধ বৃদ্ধা । জাপানে অনেক প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করে টিকে থাকতে হয় । ব্যয়বহুল জাপান জীবনে সবাইকে কাজ করতে হয় ।

কঠিন জীবনে তাই হয়তো  অনেক সঠিক সময়ে বিয়ে বাচ্চা উৎপাদন করতে পারেনা । তাই এখানে বৃদ্ধ বৃদ্ধা বেড়ে গিয়েছে । তরুন ছেলে মেয়েদের জীবন যুদ্ধের অনেক গল্প আছে । কিন্তু বৃদ্ধারা কি এই দীর্ঘ জীবনটা নিয়ে ক্লান্ত হয় । অনেকেই তা মনে করেনা । কারন এই দেশে সব মানুষের জন্য সব রকমের ব্যবস্থা আছে । বৃদ্ধদের অন্যদের কাছে নির্ভর করতে হয়না । সব নিয়ম অনুযায়ী চলে ।  এখানকার বাস ,ট্রেন ,প্লেন সব কিছুতেই বৃদ্ধদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা আছে । কারন তারা এই যে অসহায় শ্রেণী তাদের মূল্য দিতে জানে । শুধু তা নয় এখানকার বৃদ্ধরা বিভিন্ন সামাজিক কর্ম কাণ্ডে ব্যস্ত থাকে । আপনি সব জায়গায় দেখবেন সামাজিক গঠনমূলক কাজ এ অনেক বৃদ্ধ মিলে সামাজিক সেচ্ছাবক দল গঠন করে । আমি প্রায় প্রতিদিন দেখি আমার বাড়িওয়ালা শুধু গাড়ী ঠিক করে । যখন সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামি দেখি সে কাজ করেই যাচ্ছে । আমার জাপানি বৃদ্ধ বাড়িওয়ালা বেশ ধনী । একদিন আমি জিজ্ঞেস করলাম ,তোমাকে শুধু গাড়ি ঠিক করতে দেখি । এতো সুন্দর সুন্দর গাড়ি । তুমি কি ইঞ্জিনিয়ার? সে লজ্জা পেল ।

জাপানি ভাষায় ইনিয়ে বিনিয়ে বলল ,আমার শখ ।আমি বৃদ্ধ কোন ব্যস্ততা নেই । আমি গাড়ি ভালবাসি । কিন্তু তবুও সে প্রকাশ করল  না যে সে ইঞ্জিনিয়ার ছিল । অনেক দিন পর । অনেক গুলো বৃদ্ধ এক সাথে । হয়তো ওদের মিটিং হচ্ছে । তাদের মধ্যে দুই একজন খুব ভাল ইংরেজি বুঝে জানে । আমার বাড়িওয়ালা তার বৃদ্ধ বন্ধুদের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল । তারপর আমি জানলাম অনেক কথা। আসলে এই ব্লকের সব বৃদ্ধ মিলে সেচ্ছাসেবকমুলক দল গঠন করেছে । তাদের কাছ থেকেই জানলাম আমার বাড়িওয়ালা এক সময় বড় ইঞ্জিনিয়ার ছিল । এখন সে সেবামূলক কাজ করে । তাদের সংগঠন থেকে নিজ এলাকায় কারও গাড়ি নষ্ট হলে তাদের সদস্যরা বিনা মূল্য ঠিক করে দেয় ।এর পর প্রথম বার যখন আমি ডাক্তারের কাছে যাবো , তখন জাপানি বুঝিনা ।হাসপাতালে গিয়ে কিছুই বুঝিনা ।

তখন হঠাৎ দেখি ইন্টারপ্রেটার চলে এসেছে । এটা ও ছিল বৃদ্ধদের দল ।বিদেশিদের সাথে নিজ ভাষা সংস্কৃতির বিনিময়ে অনেক অনেক বৃদ্ধ মিলে বিভিন্ন সংগঠন আছে । তারা নিজেরা নিজেরাই মিলে স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজ করে থাকে। কতোটা সততার সাথে করে তা নিজের অভিজ্ঞতা না থাকলে কেউ বুঝবে না। এরপর আমি ভাষা শিখবো । অনেক ভাষা স্কুল গুলোতে গিয়ে দেখি বেশির ভাগ বৃদ্ধ বৃদ্ধা । তারা বিভিন্ন সৃষ্টিশীল কাজ করে জীবন উপভোগ করে । প্রতিটা জায়াগায় বৃদ্ধদের পদচারনায় মুখর । এই দেশে বৃদ্ধরা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কাজ করে । মানুষের সেবায় এবং সামাজিক উন্নয়নে নিজেদের ভুমিকা রাখে । কারন তারা সচেতন তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে । জাপান অনেক সুন্দর । অত্যন্ত নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে চলে সব নাগরিক। জনগন যদি সচেতন থাকে নিজ দেশ মানুষ নিয়ে সেখানে অন্য কোন শক্তি খুব তুচ্ছ ব্যপার । পক্ষান্তরে আমাদের দেশের বৃদ্ধ বৃদ্ধারা অধিকাংশ সময়ে নানা হতাশা আর অবহেলা নিয়ে জীবন পার করে । আমাদের দেশের বাস্তবতায় ছেলে মেয়ের চাকুরি বিয়ে বাচ্চা এমন অনেক নানাবিধ সমস্যা নিয়ে ক্লান্ত। অবসর সময়ে ছেলে মেয়ের কাছ থেকে এতো বেশি প্রত্যাশা থাকে যে কোন প্রত্যাশাই পূরণ হয়না । আমাদের দেশের বৃদ্ধ বৃদ্ধা নিয়ে কোন গঠন মূলক চিন্তা ভাবনা নেই। সামাজিক উন্নয়নে অবসর প্রাপ্তরা তাদের অতীত অভিজ্ঞতা দিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সহযোগিতা করতে পারে । বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের নিয়ে কোন আনন্দ বিনোদনের আয়োজন নেই । তাদের জন্য নেই কোন ব্যবস্থা । তারা ও বিশ্বাস করে নেয় বৃদ্ধ হলে ছেলে কিংবা মেয়ের উপর গলগ্রহ জীবন যাপন করতে হবে। আমাদের দেশের কয়জন বৃদ্ধ বৃদ্ধা প্রত্যাশিত অবসর জীবন উপভোগ করতে পারে । যদি মধ্য বিত্ত সমাজ এর দিকে তাকাই অধিকাংস পরিবারেই ছেলে কিংবা মেয়ের পরিবার তাকে কিছু সাহায্য করবে সে প্রত্যাশা নিয়ে তার জীবন শেষ হয় ।

গ্রামে এর দিকে তাকাই  একজন ছেলে বিদেশ থেকে টাকা পাঠাবে সেই পরিবারের ছয় থেকে দশ জন ওই একজনের আয়ের উপর নির্ভর করবে । অথচ আমাদের গ্রাম গুলো উন্নয়ন হলে সেখানকার বৃদ্ধ বৃদ্ধারা নিজেদের সুন্দর জীবন খুজে পেতো । এটা তো অস্বীকার করার কিছু নেই । আমাদের দেশে কাজের জন্য নিরাপদ পরিবেশ কোন দিন কোন সরকারের পক্ষে একা সম্ভব নয় । চাই জনগনের সচেতনতা । এই দেশ আমাদের । এই দেশের  মানুষ আমাদের আত্মীয় । এই দেশের আলো বাতাস আমাদের বেঁচে থাকা । এই দেশের শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই কে একটি স্বাধীন আর স্বাবলম্বী হওয়ার নিরাপদ ধারনা দেই ।অন্য মানুষের উপর নির্ভর করার মানসিকতা দূর করি। সবাই নিজেদের মতো করে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করি ।  সমাজ সুন্দর রাখতে গঠনমুলক ধারনা গুলো জাগ্রত করি । সুখে দুঃখে সবাই সবার পাশে থাকি । আমাদের দেশ স্বপ্নের মতো সুন্দর থাকুক ।