আমরা বাংলাদেশিরা যখন প্রবাসি হই!

নুরুন নাহার লিলিয়ান
Published : 9 August 2016, 05:03 AM
Updated : 9 August 2016, 05:03 AM

আমরা বাংলাদেশিরা যখন প্রবাসি হই তখন আমাদের জীবনযাপন, চিন্তা ভাবনা, পোষাক, সংস্কৃতি অনেক কিছুই ধীরে ধীরে পরিবর্তন হয় কিংবা প্রভাবিত হয় সেই দেশের আবহাওয়া, পরিবেশ,সমাজ,মানুষ এবং আর্থ সামাজিক পরিস্থিতির উপর নিভর্র করে। কখনও সেই সংস্কৃতিতে কেউ কেউ দারুনভাবে অভ্যস্ত হয়ে যায়। কিন্তু সেই একই মানুষটা নিজের দেশের সমাজ ব্যবস্থায় যেন আরেকটা মানুষ। আর এজন্য কে দায়ী? সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি নাকি ব্যক্তি মানুষের মানসিকতা। দেশের বাইরের উন্নত দেশগুলোতে একটি শিশু ঘরের কাজ থেকে শুরু করে বাইরের সব কিছু সহজ ভাবে শিখিয়ে ছোটবেলা থেকে সাবলম্বী করে গড়ে তোলা হয়। নিজের উপর নিভর্র করার মানসিকতা পরিবার থেকে শেখানো হয়। আমরা বাংলাদেশিরা প্রবাসি হলে একইভাবে সাবলম্বি হতে চাই। সবাই নিজের কাজ নিজে করি। অথচ নিজের দেশের মাটিতে আমরা এর কিছুই মানতে চাই না।

প্রবাসে কোন বাংলাদেশি পরিবারে দাওয়াত খেতে গেলে যে বিষয়টা সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করে তা হলো ভাইয়া কে দেখা যাবে ভাবি/আপুকে কাজে সাহায্য করছে। যারা পড়াশুনা বা গবেষনার জন্য যায় তাদের বেশীর ভাগই বিশ্ব বিদ্যালয়ের সাথে তাদের কর্ম জীবন ও জড়িত থাকে। কেউ মাস্টার্স, পিএইচডি কিংবা পোস্ট ডক্টরাল।বলা যায় শিক্ষিত সমাজের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশে তারা অবস্থান করছে। সারা সপ্তাহে বিশ্ব বিদ্যালয়ের ব্যস্ততা, ল্যাবের বাড়তি অনেক কাজ, পারিবারিক, সামাজিক এবং নিজের স্বাস্থ্য। সব মিলিয়ে দেশ থেকে দেশের বাইরেই মানুষ বেশী ব্যস্ত থাকে। তবুও বাংলা সংস্কৃতি বলে কথা। মানুষ ছাড়া মানুষ থাকতে পারে না। প্রতি সপ্তাহের ছুটির দিনের নিজেদের মতো করে কাছের মানুষদের বাসায় ডাকা। নিজেদের ভাল লাগা মন্দ লাগা শেয়ার করা। সারা সপ্তাহের ব্যস্ততার পর ও অনেক অনেক খাবার তৈরী করা যেন বাঙালির চিরন্তন সাংস্কৃতিক সৌন্দর্য। বাসায় ঢুকলেই দেখা যাবে ভাই ভাবি অথবা আপু দুলাভাই খুব আন্তরিকতা নিয়ে বাসায় গ্রহন করবে। নিজের হাতে তুলে তুলে খুব আদর করে খাওয়াবে। আন্তরিকতার বহিঃপ্রকাশে কেউ বুঝবে না সারা সপ্তাহ এবং আপ্যায়নের জন্য তারা কতো সময় এবং পরিশ্রম করেছেন। কখনো কখনো ভাইয়া আন্তরিকতা নিয়ে বলবে, আমি রান্না করেছি এই খাবারগুলো।


ওদিকে আপু আর ও একটু আন্তরিকতা নিয়ে বলবে, ভাইয়ার হাতে তৈরী করা খাবার খেলেন। এবার আমার হাতের গুলো খেয়ে দেখেন। বিদেশের মাটিতে এমন করেই বেশির ভাগ প্রবাসীরা জীবন কাটায়। পরকে আপন করে ভালবেসে। অথচ ওই ভাইয়া ভাবিরা বাংলাদেশে আসলে নিজের দেশে কাজের মানুষ ছাড়া চলতে পারে না। সত্যি কথা কি আমাদের সিস্টেমে যতোটা সমস্যা তার চেয়ে ও সমাজের দৃষ্টি ভংগির ভিতর আরো বেশি সমস্যা। যে ছেলেটা বিদেশের মাটিতে অনেক আন্তরিকতা নিয়ে বউকে সংসারে সাহায্য করে সে ছেলেটাই যদি নিজ দেশে করে তাহলে প্রথমেই ছেলের মা বোনরা ফিস ফিস করবে। কখনো মা বাবা ছাদে, মাঠে কিংবা আড়ালে নিয়ে ছেলের কান ভারী করবে এই বলে যে, নবাবজাদীকে এখানে শুয়ে বসে খাওয়ানোর জন্য আনা হয়েছে। তুই সাহায্য করিস কেন? পুরুষ মানুষ না। মাইয়া মানুষের আর কি কাজ! বউকে সব সময় লাথির উপর রাখতে হয়।এতো গেল পারিবারিক রাজনীতির সামান্য পরিচয়। তারপর সমাজ মানে আশে পাশের মানুষ দেখেই কপাল কুচকিয়ে বলবে, বউয়ের আচঁলের তলে থাকে। বউ নেউটা। ছেলেটা লজ্জার ভয়েও বউয়ের কাছে যায় না। সারা দিন একটা মেয়ে সংসারের নানা ঝুট ঝামেলা নিয়ে কাটায় অনেক ছেলেই জানেনা কিংবা সে ঝামেলা ভালবেসে শেয়ার করার প্রয়োজন বোধ করে না। ঐ ছেলেটাই যখন বন্ধুদের / সমাজের সাথে মিশে সংসারের সমস্যা কথা প্রসংগ চলে আসলে অনেক ছেলেই তার পাশের বন্ধুকে কুবুদ্ধি দিবে," শোন বেটা তুই শালা পুৃরুষ মানুষ। বউ কিভাবে পালতে হয় শিখিস নাই। সব সময় বউ কে টাইট শিডিউলে রাখবি। মাথায় তুলবি না। সব দোষ মেয়েটার! এখনো গ্রামে, মফস্বল, শহর নগরে অনেক জায়গায় বউকে তুই বলে সম্বোধন করে। ব্যাপারটা এমন নয় যে মেয়েটাকে ভালবেসে তুই ডাকছে। অনেকটা তাচিছলের সুরেই ডাকে। অনেকটা কাজের বুয়াকে অবহেলার সুরে ডাকা হয়। যে ছেলেটা বিদেশের মাটিতে বউকে আন্তরিকতা নিয়ে সহযোগীতা করছে। সেখানকার সমাজ সেভাবেই অভ্যস্ত। সমাজ এমন ভাবেই চলে। অথচ সেই একই ছেলে যখন দেশে আসবে সম্পূর্ণ ভিন্ন চেহারা। সব কিছু মেয়েদের উপর।

আরেকটা দিকে মেয়েরা জীবন বাচাতেঁ চালাক হয়ে যাচেছ। বাসায় যে কয়জন লোক থাকুক কাজের বুয়া লাগবেই। মেয়েরা যখন একে অপরের সাথে কথা বলার বিষয় থাকে কাজের বুয়া নিয়ে। কার বাড়িতে কয়টা বুয়া বেশী। বাসায় অনেক কাছের মেহমান আসলেও নিজে হাতে তুলে দিবে না। কাজের লোক কে অর্ডার করবে।কখনও ধমক দিয়ে, " এই ওই মাছটা ভাবিকে দে তো "। দুকলম বিদ্যার সার্টিফিকেট আর দুইটা কাজের লোক বেশী বাসায় রাখাই যেন আজকালকার সামাজিক অবস্থান কে প্রকাশ করে। বিদেশের মাটিতে সবাই অনেক বেশী ব্যস্ত থাকে। সমস্ত ব্যস্ততার পর ও ঘরের এবং সমাজের মানুষকে সহযোগীতা করাও যেন নিজের দায়িত্ব মনে করে। খুব স্বাভাবিক নিয়মে। আমরা মনে হয় নিজ দেশ থেকে ও দেশের বাইরেই ভাল থাকি। নিজ দেশের মাটিতে আমরা ভীষন কর্মবিমূখ। কোন কাজের প্রতি আমাদের সম্মান নেই। কোন মানুষের প্রতি আমাদের সম্মান নেই। প্রতিনিয়ত একজন নারীর দোষ টেনে পুরুষকে আর একজন পুরুষের বিরুদ্ধে বলে নারীর স্বপ্নের একান্ত জগত গুলো নষ্ট করে দেয়া হচেছ। পারস্পারিক ভালবাসার অনুভূতি ক্রমান্বয়ে আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে যাচেছ। আজকের শিক্ষা ব্যবস্থা শুধু উদর পূর্তির জন্য একটা চাকরীর জন্য। গলায় শিক্ষিত লকেট ঝুলানোর জন্য। আজকের শিক্ষা কে কত তাড়াতাড়ি বাদর ঝুলে শীর্ষে থাকতে হবে। আজকের শিক্ষা একজন মানুষের একান্ত দুঃখ গুলো বুঝতে শিখায় না। বৃহৎ সুখ নিয়ে ভাবায় না। মা -বাবা; ভাই -বোন; বন্ধু -বান্ধবী ;প্রেমিক প্রেমিকা; স্বামী-স্ত্রী; শিক্ষক-শিক্ষিকা; ছাত্র ছাত্রী; শশুর- শাশুড়ি সম্পর্কগুলোর অন্তর্নিহিত অর্থ শেখায় না। মানুষ নিজের স্বেচছাচারি অনুভূতির মূল্য দিতে শিখছে। মানুষ থেকে প্রকৃত মানুষটার দূরত্ব এখন অনেক বেশি।