রহস্যময় শিকতসু লেক

নুরুন নাহার লিলিয়ান
Published : 10 August 2016, 05:48 AM
Updated : 10 August 2016, 05:48 AM

রহস্যে ঘেরা এই পৃথিবীতে কতোই না রহস্য ছড়িয়ে আছে। গত কিছুদিন আগে এক রহস্যময় লেক কে দুচোখ মেলে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল । অনেক দিন নানা ব্যস্ততার কারনে তেমন কোথাও যাওয়া হয়নি । জাপান এ সবাই কাজ করে ।সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত থাকে । তাই সবার সময় একসাথে মিল করা খুব কঠিন । যেকোন পরিকল্পনা করতে হলে অনেক আগে থেকেই সময় নির্ধারণ এবং সিদ্ধান্ত নিতে হয় । জাপানি বন্ধুদের কাছে এই রহস্যময় শিকতসু লেক এর অনেক গল্প শুনেছি। জাপানিজরা অত্যন্ত সংবেদনশীল জাতি । আত্মহত্যা নিয়ে পৃথিবীতে আলাদা পরিচয় আছে । এতো সুন্দর চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য আর নিসর্গ প্রকৃতির ভালবাসা রেখে কেন জাপানিজরা নিজেকে বিসর্জন দেয় । মাঝে মাঝে নিজের মনের কোনে উঠে আসে নানা রকম প্রশ্ন । নাকি পৃথিবীর পথে পথে লুকিয়ে থাকা অন্য কোন রহস্য ।

গত বছর থেকেই আমার অনেক বন্ধু এই রহস্যময় লেক নিয়ে অনেক গল্প করেছে । প্রচলিত আছে যখন এই লেক এ কেউ ঝাঁপিয়ে পরে কিংবা নিজের শরীরের সাথে পাথর বেঁধে লেক এ নেমে পরে আত্মহত্যা করে ।ঠিক মৃত্যুর পর সেই মৃত লাশ অতলে হারিয়ে যায় । আজ পর্যন্ত নাকি আত্মহত্যা করা লাশ উদ্ধার করা যায়নি । এমন হাজারও রহস্য ঘেরা গল্প ছড়িয়ে আছে মানুষের মুখে মুখে । কিংবা কেউ যদি এই লেক এ বোট নিয়ে ভ্রমনে যায় লেকটার ঠিক কিছু কিছু জায়গায় হঠাৎ কিছু রহস্যময় ঘটনা ঘটে । অনেক বিশাল জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে নানা রকম সৌন্দর্যময় বিষয় । এই লেকের আসে পাশে অনেক বারই নান কারনে আর উৎসবে যাওয়া হয়েছে ।

হোক্কাইডো দ্বীপ এর দক্ষিন পশ্চিম দিকে অবস্থিত এই শিকতসু লেক । গত সপ্তাহে ঘুরে এলাম এই রহস্যময় লেকে । আমি এবং আমার স্বামী বেশ অনেক দিন পর কোথাও ঘুরতে বের হলাম । আর সাথে ছিল বরাবরের মতো জাপানিজ দাদা দাদী চিয় সাইতো এবং রিউহে সাইতো । সকাল ছয়টা ।সাপ্পোরো থেকে একটু দুরের পথ ।প্রায় তিন ঘণ্টা । সাপ্পোরো থেকে ওতারু ।সেখান থেকে ছিতস এয়ারপোর্ট এলাকা । তারপর ধীরে ধীরে শুরু হয় শিকতসু লেকের যাত্রা । আমি কিছু বাংলাদেশি এবং জাপানিজ খাবার রান্না করে লাঞ্চ বক্স নিলাম । মুরগীর দো পিয়াজো , টুনা মাছের কাবাব , তফু আর মিক্সড সবজির খিচুড়ি , বেগুন ফ্রাই , পালং শাঁক এবং চিংড়ির ঝাল কারি । সেদিন আমার জাপানিজ দাদীর ও রান্না ছিল । গাড়িতে উঠতেই শুরু হল । প্রাচীন রহস্যময় সব জাপানিজ গল্প । সকালের পথ । রাস্তা একদম পরিস্কার ।ধারনা করা হয় চল্লিশ হাজার থেকে পঞ্চাশ হাজার বছর আগে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের কারনের অনেকটা জায়গা ধীরে ধীরে প্রকৃতির নিয়মে আপন অস্তিত্ব নিয়ে জেগে উঠেছে । এই লেকের গড় গভীরতা ২৬৫ মিটার এবং সর্বচ্চো গভীরতা ৩৬৩ মিটার ।জাপানের তাজাওয়া লেকের পরই এই লেক এর স্থান । লেকের দিকে যাওয়ার পথে বেশ অনেক গুলো জায়গায় থামলাম । কিছুদূর যাওয়ার পথেই হানা রোড নামের একটি অত্যন্ত সুন্দর জায়গা । যে জায়গাটা ফুলের জন্য বিখ্যাত । জাপানিজ শব্দ হানা অর্থ ফুল । এই রোডের নাম তাই হানা রোড ।অনেক দর্শনার্থী ফুলের সৌন্দর্য দেখে অভিভূত হয়ে যাবে । প্রকৃত পক্ষে এই জায়গাটা হল জাপানিজ আর্মিদের অবকাস যাপন কেন্দ্র । সেখানে সবজি অনেক সুন্দর উপস্থাপনে বিক্রি হচ্ছে ।আমরা ও বেশ কিছু সবজি কিনলাম । জাপানিজ সুইট ভুট্টা বিশেষ পদ্ধতিতে আমাদের দেওয়া হল । আমরা অত্যন্ত আনন্দের সাথে সুইট ভুট্টা খেতে লাগলাম । হোক্কাইডোর এই সুইট ভুট্টা অনেক বিখ্যাত । জাপানের প্রতিটা জায়গা এতো সুন্দর শিল্পের আর সৌন্দর্যবোধের ছোঁয়া

যেকোন মানুষের মন ফুলেল সৌন্দর্যে আপ্লুত হবে । হানা রোডের ফুলের সৌন্দর্য নিয়ে আমরা সামনের পথে ছুটে চললাম । এর পর গাড়ি থামল হাকুসেন ঝরনা ধারার কাছে । কি অদ্ভুত ভয়ঙ্কর কিংবা সুন্দর প্রাকৃতিক শব্দ । হাকুসেন ঝরনাধারার শব্দে পুরো জায়গা জুড়ে যেন এক অচেনা পরিবেশ । শুকনা পাতার মর্মর শব্দ নয় । মাটি ভেঙে যাওয়ার চৌচির শব্দ নয় । এই হাকুসেন ঝরনা ধারার শব্দ মানুষের কানের কাছে অদ্ভুত শিহরণ দিয়ে যায় । প্রকৃতির বুকে রহস্যময় শব্দ । অনেক দূর দূর থেকে অনেক দর্শনার্থী এসেছে এই হাকুসেন ঝরনা ধারার শব্দে নিজেদের বিলিয়ে দিতে । এর পর রারুমানাই ঝরনা ধারা । হাকুসেন ঝরনা ধারার থেকে একটু আলাদা । তবে এই দুই ঝরনা ধারার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল অদ্ভুত রহস্যময় শব্দ আর পানির রঙ । কলকল পানির মিছিল যখন নিচে নেমে যায় সাথে প্রকৃতির কাছ থেকে কিছু সবুজ উড়িয়ে নিয়ে নামে । আমি খুব মনোযোগ দিলাম প্রকৃতির রহস্যময় পরিবেশ তা ক্যামেরায় বন্দি করা নিয়ে । সেদিন আবহাওয়া ভাল ছিল ।ঝর বৃষ্টি নেই । কিংবা কাটফাটা রোদ ও নেই । আবার যে মেঘলা তা ও বলা যাবে না । কোন অভিমানে কোন চাপা কষ্টে আকাশ ভারী হয় মানুষের পক্ষে কি সম্ভব এই রহস্যভেদ করা ! বেশ অনেক গুলো ছোট ছোট পাহাড়ি এলাকা ঘুরে ঘুরে আমরা পৌঁছলাম শিকতসু ভিজিটর সেন্টার । সেখানেই আমরা দুপুরের মধ্যাহ্ন ভোজ করলাম ।

মধ্যাহ্ন ভোজ শেষে আমরা ভিজিটর সেন্টারে ঢুকলাম । তথ্য প্রযুক্তিতে এগিয়ে থাকা জাপান এতো সুন্দর করে জীবন্ত করে পুরো পরিবেশটা কে রেখেছে না দেখলে কোন মানুষ বিশ্বাস করতে পারবে না । তবে একটা মজার ঘটনা । সেখানে বেশ কয়েকজন ইংলিশ গাইড আছে । আমরা দুজন মনোযোগ দিয়ে পুরো সেন্টারটা দেখছিলাম আর ছবি তুলছিলাম । পিছন থেকে হঠাৎ এক জাপানিজ মেয়ে গাইড বলল , আসসালামুয়ালাইকুম , আপনি কেমন আছেন ?

আমি এমন সুন্দর বাংলা শুনে পিছনে তাকাতেই উনি হেঁসে দিলেন , আমি বললাম ওয়ালাইকুমআসসালাম , আমি ভাল আছি ।আপনি কেমন আছেন । আপনি বাংলা জানেন ?

তিনি বললেন এখন বাংলা অনেক জাপানিজ জানে । জাপান এবং বাংলাদেশ সুন্দর সম্পর্ক । তারপর জানা হল তার নাম আকিকো । এখানে অনেক বাংলাদেশি ভিজিটর ও আসে । দুই একটা ছবিও তুললাম । তখন চারপাশে মধ্যাহ্ন পার হয়ে বিকেলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে । বাইরের আকাশে অদ্ভুত ক্লান্ত রঙ । আমরা চারজন সিকতসু লেক এর পাশ দিয়ে হেটে এই পৃথিবীর হাজারও রহস্য খুঁজি । এই লেক ঘিরে আছে তিনটি পাহাড় ।এনিওয়া পাহাড় ,ফুপ্পুসি পাহাড় এবং তারুমায়ে পাহাড় । ফুপ্পুসি পাহাড়ের উচ্চতা ১১০৩ মিটার এবং তারুমায়ে পাহাড়ের উচ্চতা ১০৪১ মিটার । এর সাথে ছোট ছোট অনেক গুলো পিক আছে যে গুলোর উচ্চতা ৯৩২ মিটার এর মতো । স্থানীয় অনেক তরুন তরুনী নিজেদের একান্ত কিছু সুন্দর সময় কিছু ভাল লাগার মুহূর্ত উপভোগ করতে এই লেক এর ধারে আসে। এই লেকের পাশ দিয়ে হেটে যেতে অনেক অনেক গল্প শুনতে থাকি আমাদের দাদীর মুখে । এখানের পরিষ্কার পানির নিচে আর সুন্দর পরিবেশের আড়ালে ডুবে আছে হাজার অভিমান আর বেদনার গল্প । কোন কোন সময় প্রেমিক প্রেমিকারা অভিমানে ঝাঁপ দেয় এই লেকে । একেবারে নিস্তব্ধ আর নিভৃত সৌন্দর্য ।

প্রকৃতির বুক জুড়ে যেন কিসের মায়া । কেউ কেউ নাকি কোন এক বিশেষ সময় অভিমানী জাপানি মেয়ের কান্নার শব্দ শুনতে পায় । যদিও এগুলো মানুষের মুখের প্রচলিত কথা । আমরা অপার সুন্দর পরিবেশ উপভোগ করতে এগিয়ে যাই । সেখানে দেখি The Yamasen Railway Bridge . দুইশ ফুট এই আকর্ষণীয় ব্রিজের ও আছে অনেক গল্প । ১৮৯৯ সালে ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ার C.A.W Pownall এই ব্রিজের নকশা তৈরি করেন । লেক শিকতসু এবং তমাকমাই নামের জায়গার সাথে সামগ্রিক যোগাযোগ এর জন্য । পরবর্তীতে জাপানিজ অজি গ্রুপ এই ব্রিজটি ক্রয় করেন । এই ব্রিজের ভিতর দিয়ে হেটে যাওয়ার সময়ে চোখে পড়বে প্রকৃতির এক ভিন্ন সবুজাভ সৌন্দর্য । নিচে তাকালেই সবুজ পানি । কারন সে পানিতে আছে ৩০ রকমের ও বেশি সবুজ মস । অদ্ভুত সবুজের খেলা । আমরা দাদীর মুখে আরও পিছনের গল্প শুনতে শুনতে সামনে এগিয়ে যাই । প্রকৃত পক্ষে শিকতসু লেকের নাম এসেছে জাপানিজ উপজাতি আইনু ভাষা থেকে । আইনু ভাষায় Shikot meaning big depression or too much like dead bones .আর সেখান থেকেই আসে শিকতসু শব্দ । তবে জাপানের অনেক পুরনো শব্দ আইনু ভাষা থেকে আসলেও কোন এক অজানা রহস্য কিংবা ভিন্ন ইতিহাসে আইনু সংস্কৃতি ও বিলুপ্তির পথে । এই লেক ঘিরে ঋতুভেদে অনেক আয়োজন হয় । এই লেক ঘিরে জাপানিজ হানাবি কিংবা আতসবাজি উৎসব অনেক বিখ্যাত । জাপানিজ অয়াদাইকো ড্রাম পারফরমান্স অনেক বিখ্যাত । এমন হাজারও রহস্যময় গল্প শুনতে শুনতে আমাদের ফেরার সময় হয়ে আসে । ফেরার পথেও বেশ কিছু জায়গায় থামা হয় ।কিছু সময় হাল্কা খাওয়া পর্ব । একটি ছোট ঐতিহ্যবাহী আইসক্রিম ফ্যাক্টরির আইসক্রিম খেতে খেতে আমরা পৌঁছে যাই ঐতিহাসিক ইশিয়ামা রিউগুচি নামের একটি জায়গা সেখানে আছে প্রাচীন পাঁথরের ওপেন স্টেজ । অসাধারন সব ল্যান্ড স্কেপ । চোখ জুড়িয়ে যায় । পৃথিবীর বুকে কতো কতো রহস্য । ছোট এক জীবন । গাড়ি ফিরতি পথে চলছে । শিকতসু লেক এর রহস্য আর গল্প এর দূরত্ব বাড়তে থাকে । কিন্তু মনের ভিতর এক অদ্ভুত স্পর্শ হয়ে রয় অপূর্ব সুন্দর শিকতসু লেক ।