অফিসিয়াল পাসপোর্ট বনাম গভর্নমেন্ট অর্ডার(জিও) আর একটি স্বপ্ন ভঙ্গ

নুরুন নাহার লিলিয়ান
Published : 2 March 2017, 07:02 PM
Updated : 2 March 2017, 07:02 PM

আমি নিরব রক্ত ক্ষরণ দেখছি। যদিও এসব দেখেই বড় হয়েছি। কিছুই করার নেই। হয়তো এটাই বাংলাদেশ। এর কোন মানেই নাই। আমার প্রচণ্ড মন খারাপ। সামনে যদি কারও বিদগ্ধ চোখ আর আশা ভাঙ্গা চেহারা থাকে পুরো পরিবেশই তো ভারাক্রান্ত হবে। তাই আমারও হৃদয়ে রক্তক্ষরণ। কারণ আপনার মগজের এক অংশ যদি খারাপ থাকে আপনিও ভাল থাকবেন না। আর এটাই জীবন। আমাদের আশেপাশের ভালমন্দ নিয়েই আমাদের ভাল থাকা। আশেপাশের মানুষের ভাল থাকার উপরই আমাদের বেঁচে থাকা।

বাংলাদেশে কারও বিজ্ঞান বিষয়ে পড়ার কোন দরকার নেই। কারণ বাংলাদেশে বিজ্ঞান না পড়েও বিজ্ঞান মন্ত্রণালয়ের আর গবেষনাগারের নিয়ন্ত্রক হওয়া যায়। চিকিৎসা বিজ্ঞান থেকে শুরু করে সব জায়গায় কতো যে ঝামেলা। সব অভিজ্ঞতা প্রকাশ করা তো আর সময়ে কুলায় না। সময় হলে ধীরে ধীরে বলব।

খোঁজ নিয়ে দেখুন দেয়ালে হাতুরি মারার শিক্ষা নিয়ে গর্ভবতী মায়ের পেট সার্জারি করা হয়। তাহলে বোঝেন, কোনো রকম প্রাণটা নিয়েই তো বিকলাঙ্গ শিশুরই জন্ম হবে। এটাই স্বাভাবিক। আর এমন করে ধীরে ধীরে আমরা বিকলাঙ্গ জাতিতে পরিনত হচ্ছি। অফিসের পিয়ন থেকে উচ্চপদস্থ সবাই কেউ স্বাভাবিক নিয়মকানুন বোঝে না। সবাই কেমন করে অনিয়ম আর খামখেয়ালিটা বোঝে।

এভাবেই যে মানুষটা যে বিষয়টা বোঝেনা সে মানুষটাকে সেই বিষয়ের চেয়ারে বসানো হয়েছে। সাহিত্যের লোক আলু গবেষণাগারের নিয়ন্ত্রক, সমাজ কল্যান পড়েছে হাসপাতালের পরিচালক …। এমন অনেক আছে।

পরিবারের অনেকেই সরকারি দপ্তরে আছে। সরকারি দপ্তরে কিংবা বেসরকারি দপ্তরে খুব কম মানুষই আজকাল জাতীয় স্বার্থে কাজ করে। সবাই নিজের ব্যক্তি স্বার্থে কাজ করছে। এতো সূক্ষভাবে ঘুণপোকা কাটছে যে দেশটা হঠাৎ করে যে কোন সময়ে ভেংগে পড়তে পারে। কে ভাল আর কে খারাপ তা বোঝা কঠিন। সব শয়তানির প্রমাণ কী দেখাতে পারবেন?

যা হোক, যে কারনে মন খারাপ, কতো কঠিন সংগ্রামের জীবন আমার আর আমাদের। হয়তো অনেকেই জানে না। ঘুরে ফিরে সেই ঘরের মানুষের কথাই বলি। এই তো কিছুক্ষন আগে তার একটা স্বপ্ন ভেঙে গেল। আর ভেঙ্গে দিল এই দেশেরই কেউ। যারা সমাজ চালায়। দেশ চালায়। যার যথাযথ কারণ নেই। হয়তো কোথাও বুঝবার জ্ঞান কিংবা হৃদয় দিয়ে মানুষের প্রয়োজন বুঝবার হৃদয়ের অভাব আছে।

আমার স্বামী তার জাপানি প্রফেসরের একমাত্র বাংলাদেশি ছাত্র ছিলেন। পিএইচডি করার সময় তার প্রচণ্ড পরিশ্রম আর গবেষণায় ভাল করার কারনে প্রিয় বাংলাদেশি ছাত্রে পরিনত হয় । তার সাথে নিয়মিত গবেষণা কাজে যোগাযোগ এবং সহযোগিতা রাখতে বলে । পোষ্ট ডক্টরালের অফার পাওয়ার পরও সে দেশে ফেরে। একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান তো দেশেই নিজের মেধার বিকাশ আর প্রাপ্য খুঁজতে শান্তি পাবে। তাছাড়া প্রফেসর রিটায়ার্ড করবে। এই দিকে সঠিক সময়ে সরকারি চাকুরিজীবীদেরও দেশে ফিরতে হয় । তাই কিছু রিসার্চের কাজ বাকিও থাকে। এখান থেকে সে কাজগুলো করে। কিছুদিন আগে ডায়বেটিস এর উপর একটা আন্তর্জাতিক নিবন্ধন ও প্রকাশ হয় ।

যেহেতু এই বাংলাদেশি ছাত্র সরকারি চাকুরে এবং অফিসিয়াল পাসপোর্ট ধারি ।তার দেশে অনেক সমস্যা ।তাই তিনি নিজ খরচে ছাত্র কে ইনভাইট করে তার চাকুরির বিদায় অনুষ্ঠানে । সেখানে অনেক অনেক প্রফেসরদের সাথে মিটিং সেট করে পরিচিতি এবং নতুন রিসার্চের বিষয়ে আলোচনার জন্য। যেহেতু এই ছাত্র বিল এন্ড মেলিন্ডা গেটস এ্যাওয়ার্ড সহ অনেক গুলো আন্তর্জাতিক পুরস্কার জিতেছেন ।তাই তাকে নিয়ে প্রফেসরের একটু আশা আর গর্ব তো থাকতেই পারে । যদিও এই দেশে তার মূল্য কতোটুকু জানি না ।

এই দেশ গবেষণা না বুঝলেও জাপানিরা বুঝে । জাপান সরকার ভিসা দিয়ে দিয়েছে। লক্ষ লক্ষ ইয়েন এর মধ্যে জাপানিরা খরচ করে বসে আছে এই বাংলাদেশি ছাত্রের জন্য। প্রফেসররা অপেক্ষা করছে তার জন্য। কিন্তু এই দেশের সরকারি অফিস তাকে অনুমতি দেয়না । আগামিকাল তার ফ্লাইট ছিল। আজ তার জাপানে যাওয়ার অনুমতি বাতিল করল। একজন রিসার্চারের নাকি এই ভিজিট আবশ্যক নয় । আল্লাহ এদের মাফ করে দাও । এদের হেদায়েত কর ।একজন ইংরেজি অথবা বাংলা সাহিত্যের লোক কি এই বয়সে আর্সেনিক, ডায়বেটিসের গবেষণার গুরুত্ব বোঝে? বুঝলে কেন এতো জটিলতা? সরকারি দফতরে ক্ষমতা চিরদিনের নয়। কিন্তু একজন গবেষকের গবেষণার ভাল ফলাফল চিরদিনের । এই জাতি কিভাবে এগিয়ে যাবে বলুন তো … এই দেশে রাজনীতি ছাড়া দেশের মেধাবিরা অসহায় । যাদের মেধাই একমাত্র অবলম্বন তারা কার কাছে যাবে। আমার সামনে কারও বোবা কান্না আমার ভিতরের শব্দকেগুলোকেও বোবা করে দিল।

অথচ ছুটিটাও নিজের প্রাপ্য ছুটি। বলুন তো এই দেশে গবেষকরা ভাল মন নিয়ে কিভাবে কাজ করবে। কেন মেধাবিরা বিদেশে ভাল সুযোগসুবিধা পেয়েও স্বেচ্ছায় এই ঝামেলা নিতে দেশে ফিরবে। শুধু কি তাই পাঁচ বছর ডেপুটেশনে গর্বের সাথে উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়ার পর দেখে বেতন কমে গেছে। প্রাপ্য বেতন সমতা করা হয়নি। আসল বেতন থেকে দশ হাজার টাকা কম পেয়ে যাচ্ছে। নানা রকম জটিলতায় ফাইল থেমে আছে। বা ইচ্ছে করে করা হচ্ছে না। আপনি কার কাছে যাবেন? যারা বলে মেধাবীরা দেশে ফেরে না, তাদের বলি, কেন ফেরে না? ঠিক এই ধরনের অবহেলা, নাজেহাল করা, হয়রানি করা, খামাখা শত্রুতা করা। কেন চোখের সামনে একজন এগিয়ে যাবে? যারা এগিয়ে যাচ্ছে তারা অনেক কষ্ট জটিলতা আর যুদ্ধ করে এগিয়ে যাচ্ছে। এই যুদ্ধে কার জয় হবে? খামখেয়ালির নাকি বিবেকের? যদি এই জাতির বিবেক থাকে অবশ্যই প্রাপ্য ব্যক্তিদের যথাযথ সুযোগ এবং প্রাপ্য ফিরিয়ে দিবে । জাতির কাছে প্রশ্ন যথাযথ কারন আর কাগজ পত্র থাকার পরও যদি কাউকে এই ভাবে থামিয়ে দেওয়া হয় সে কি থেমে যাবে । কোন মানসিক সংকীর্ণতা বা জ্ঞান হীনতা কি মেধাবী আর সৃষ্টিশীলদের থামাতে পারে । এই দেশের মানুষের বিবেক কী বলে?

এই লেখার সকল কৈফিয়ত শুধু আমার । যে কোন জবাবদিহিতা আমার । সকল দায় দায়িত্ব আমার । আমিই একমাত্র সাক্ষী।