একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা: মিন্টু চেয়ারম্যান

ওমর ফারুক ইমন
Published : 8 Dec 2016, 05:01 PM
Updated : 8 Dec 2016, 05:01 PM

জগৎ সংসারে যুগে যুগে এমন কিছু মানুষ আবির্ভূত হন যাঁরা মৃত্যুর পরও মনুষ্য সমাজের আদর্শ হয়ে থাকেন শত শত বছর। সাধারণ হয়ে জন্মগ্রহন করে নিজ কর্মগুনে, ঔদার্য্যে অসাধারণ হয়ে উঠেন। জেগে থাকেন মানুষের হৃদয়ে। এমনি এক নির্লোভ নিরহংকারী ব্যক্তিত্ব ছিলেন চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ের বীর মুক্তিযোদ্ধা এটিএম ঈসমাঈল ( মিন্টু মিয়া )। যিনি 'মিন্টু চেয়ারম্যান' নামেই বেশী পরিচিত ছিলেন। সততা ও ন্যায় নিষ্ঠার সাথে আপোষহীন থেকে দীর্ঘ ২৭ বছর পালন করেছিলেন মীরসরাই উপজেলার ১নং করেরহাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব। আর তাই পুরো উপজেলা ব্যাপী 'মিন্টু চেয়ারম্যান' নামেই তিনি সকলের কাছে শ্রদ্ধাভরে সুপরিচিত।

এই সমাজ হিতৈষী ব্যক্তি ১৯৪২ সালে চট্টগ্রামের মীরসরাই উপজেলার পশ্চিম জোয়ার গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। বাবা ছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ আব্দুর রউপ বিএবিটি। গ্রামের বিদ্যালয়ে পড়ালেখা শেষ করে ভর্তি হন করেরহাট কে.এম উচ্চ বিদ্যালয়ে ও পরবর্তীতে ফেনী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে। এরপর থেকেই বিভিন্ন সামাজিক ও জনকল্যাণমূলক কাজে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৬২ সাল থেকেই সক্রিয়ভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যোগ দেন। ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুথ্যান ও ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে তিনি ছিলেন প্রথম সারির যোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই হানাদার বাহিনী যাতে মীরসরাই দিয়ে চট্টগ্রামে প্রবেশ করতে না পারে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেন।

'অপারেশন শুভপুর ব্রিজ' ছিলো তাঁর মুক্তিযুদ্ধের একটি সাফল্যময় অভিযান। বর্তমান গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এমপি, জাফর আহমদ সিএনসিসহ মুক্তিযোদ্ধারা মিলে বিটুমিনের সাহায্যে শুভপুর ব্রিজে আগুন ধরিয়ে দেন। ফলে ২৬ শে মার্চ পাক হানাদার বাহিনী চট্টগ্রাম প্রবেশ করতে পারেনি। মীরসরাইয়ে কিছুদিন যুদ্ধ করার পর তিনি চলে যান ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাবরুমে। এরপর হরিণা ক্যাম্পের সুপারভাইজার হিসেবে দুইমাস দায়িত্ব পর তাঁকে পাঠানো হয় দেরাদুনে ঠান্ডুয়া ট্রেনিং ক্যাম্পে। ট্রেনিং সমাপ্ত হওয়ার পর রাঙ্গামাটি সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। মারিশ্যা মডেল টাউনে তাঁর নেতৃত্বে প্রায় ১০০ মুক্তিযোদ্ধা পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৬ই জানুয়ারী তিনি নিজ এলাকায় প্রত্যাবর্তন করেন।

যুদ্ধ বিধ্বস্ত এলাকার অর্থনৈতিক ও শিক্ষার উন্নয়নে তিনি সংগ্রামে লিপ্ত হন। ১৯৭২ সালে তিনি স্থানীয়ভাবে ত্রান ও পুণর্বাসনের দায়িত্ব পান এবং পরবর্তীতে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। সফল কর্মকান্ড ও সততার জন্য তিনি ১৯৯৮ সালের পূর্ব পর্যন্ত একটানা ২৭ বছর করেরহাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। প্রচুর অর্থবিত্ত না থাকলেও মনোবল আর জনবলের কারণে তিনি অসাধারণ হয়ে উঠেছিলেন। শত প্রতিকূলতায়ও তাঁকে দমিয়ে রাখা যায়নি। নিজ উদ্যোগে তিনি অসংখ্য রাস্তা, ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণ করেছিলেন। এছাড়া বিদেশী অনুদানে নিজ এলাকায় দুটি দূর্যোগ আশ্রয় কেন্দ্র তৈরি করেন। সমবায় সংগঠক হিসেবে তিনি ১৯৮৪ সালে প্রেসিডেন্ট পুরষ্কার লাভ করেন।

শিক্ষা ক্ষেত্রে এই মহান ব্যক্তির ছিলো সফল পদচারণা। ১৯৯০ সালে তিনি নিজ এলাকার ওবায়দুল হক উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতি ও বারইয়ারহাট ডিগ্রী কলেজের গভর্নিং বডির সদস্য নির্বাচিত হন। মুক্তিযোদ্ধাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে স্থানীয়ভাবে গঠিত সমবায় সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এছাড়াও তিনি মীরসরাই উপজেলা চেয়ারম্যান সমিতি ও বাংলাদেশ চেয়ারম্যান সমিতি কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এককথায় এই সমাজ হিতৈষী ব্যক্তি সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কল্যাণের মাধ্যমে এলাকার সার্বিক উন্নয়নের মাধ্যমে যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ ও পরবর্তীতে সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন।

পারিবারিক জীবনে তিনি তিন পুত্র সন্তান ও এক কন্যা সন্তানের জনক। যারা উচ্চ শিক্ষিত ও নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। ২০০১ সালের ১৮ ই মার্চ এই বীর মুক্তিযোদ্ধা মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যু তাঁকে গ্রাস করলেও তিনি চিরদিন বেঁচে থাকবেন সাধারণ মানুষের হৃদয়ে।