সিটি লাইটস: চার্লি চ্যাপলিনের এক অসামান্য শিল্পকর্ম

অরণ্য প্রলয়
Published : 14 Oct 2016, 03:56 PM
Updated : 14 Oct 2016, 03:56 PM

'সিটি লাইটস' চলচ্চিত্রটি নিঃসন্দেহে চার্লি চ্যাপলিনের একটি অনবদ্য ক্ল্যাসিক। চার্লি চ্যাপলিনের এই চলচ্চিত্রটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৩১ সালের ৩০শে জানুয়ারি। এটি তৈরি করতে সেই সময়কার হিসাবে খরচ হয়েছিল ১৫ লক্ষ ডলার। অত্যন্ত জনপ্রিয়তা পেয়েছিল এই ছবিটি। এতো যুগ পরেও বলা যায় সেই জনপ্রিয়তা এখনও একটুও কমেনি। বরং বেড়েছে বলেই মনে হয়। 'সিটি লাইটস' চার্লি চ্যাপলিনের চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম বলেই বিবেচনা করা হয়। চার্লি চ্যাপলিন এই চলচ্চিত্রে দেখিয়েছেন প্রেম ও মানবিক মূল্যবোধ মানুষের জীবনে কতোটা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে। চার্লি চ্যাপলিন এই ছবিটির চিত্রনাট্য লিখেছেন, পরিচালনা করেছেন, প্রযোজনা করেছেন এবং 'ভবঘুরে' চরিত্রে অভিনয়ও করেছেন। শুধু তাই না, তিনি এই ছবির সংগীত পরিচালনাও করেছেন। ভবঘুরে চার্লি চ্যাপলিনের মানবিক অনুভূতি ও বাঁধভাঙা ভালোবাসার এক অসাধারণ শৈল্পিক প্রকাশ 'সিটি লাইটস'।

'সিটি লাইটস' নির্বাক চলচ্চিত্র। চার্লি চ্যাপলিন এটি নির্মাণের কাজ শুরু করেছিলেন ১৯২৮-এর ডিসেম্বরে। যদিও তার আগেই, অর্থাৎ ১৯২৩ সালেই বেশ কয়েকটি সবাক চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়ে যায়। কিন্তু চার্লি চ্যাপলিন তার এই চলচ্চিত্রে কথা সংযোজন করতে চাননি। ফলে এটিকে তিনি নির্বাক চলচ্চিত্র হিসেবেই নির্মাণ করেন। যদিও এই চলচ্চিত্রটি নির্বাক তবুও এটি যেসব কথা বলে যায় তার আবেদন চিরকাল অমলিন হয়েই থাকবে। দীর্ঘ তিন বছর ধরে চার্লি চ্যাপলিন এটি নির্মাণ করেছিলেন। এটির আর্ট ডিরেক্টর ছিলেন হেনরি ক্লাইভ। এই ছবির ঘটনাগুলো যদিও প্যারিসে ঘটছে, কিন্তু আর্ট ডিরেকশনের ক্ষেত্রে হেনরি ক্লাইভ বেশ কয়েকটি শহরের চিত্র অনুসরণ করেছিলেন। বিশেষ করে লন্ডন, লস এঞ্জেলেস এবং নেপলস, আর সেই সঙ্গে প্যারিস তো আছেই। এটি দেখে বিখ্যাত চিত্রনাট্যকার রবার্ট শেরউড বলেছিলেন, "এইরকম শহর আপনি পৃথিবীর অন্যকোথাও দেখতে পাবেন না। তবে এই শহরের মধ্যে আপনি সব শহরকেই পাবেন"। আর্ট ডিরেক্টর হেনরি ক্লাইভকে চার্লি চ্যাপলিন এই ছবিতে কোটিপতির চরিত্রটি দিয়েছিলেন। কিন্তু কোটিপতির সঙ্গে ভবঘুরে চ্যাপলিনের প্রথম দৃশ্যে তিনি ঠান্ডা পানিতে ঝাঁপ দিতে চাননি বলে চ্যাপলিন তাকে সঙ্গে সঙ্গে বাদ দিয়ে দেন এবং হ্যারি মায়ারসকে এই চরিত্রে নির্বাচন করেন।

এই ছবিটির অন্যতম প্রধান চরিত্র অন্ধ মেয়ের জন্য চার্লি চ্যাপলিন অনেক মেয়েরই অডিশন নিয়েছিলেন, কিন্তু কাউকেই তাঁর পছন্দ হয়নি। অবশেষে সান্তা মনিকার সৈকতে একটি শ্যুটিংয়ের সময় ভার্জিনিয়া শেরিলকে দেখে তাঁর ভালো লাগে। ভার্জিনিয়া শেরিল তাঁর কাছে জানতে চান তিনি তাঁর কোনো ছবিতে কাজে লাগবেন কিনা। চার্লি চ্যাপলিন তখন তাকে স্ক্রিন টেস্টের জন্য আসতে বলেন এবং এভাবেই স্ক্রিন টেস্টের পরে ভার্জিনিয়া শেরিলকে চ্যাপলিন অন্ধ মেয়ের চরিত্রে নির্বাচন করেন। ভার্জিনিয়া শেরিল তার চরিত্রে যথেষ্ট ভালো অভিনয় করছিলেন। কিন্তু তার কয়েকটি দৃশ্য ধারণের পর বাকি দৃশ্যগুলো ধারণ করতে চার্লি চ্যাপলিন কয়েক মাসের বিরতি নিয়েছিলেন, এই ব্যাপারটি ভার্জিনিয়া শেরিল একেবারেই পছন্দ করেননি এবং তিনি চ্যাপলিনের কাছে এটি নিয়ে আপত্তি জানান। ফলস্বরূপ চ্যাপলিন তাকে পুরো সিনেমা থেকেই বাদ দিয়ে দেন এবং তার জায়গায় জর্জিয়া হেইলকে নেন। জর্জিয়া হেইল চ্যাপলিনের গোল্ডরাশ চলচ্চিত্রে তার সহ-শিল্পী হিসেবে কাজ করেছিলেন। ফলে তার সঙ্গে বোঝাপড়াটা আগেই ছিল। কিন্তু এই বোঝাপড়া একেবারেই কাজে লাগেনি। জর্জিয়া হেইল অন্ধ মেয়ের চরিত্রটি মোটেই নিখুঁতভাবে ধারণ করতে পারছিলেন না। ফলে চ্যাপলিন নিরুপায় হয়ে ভার্জিনিয়া শেরিলকেই এই চরিত্রে ফিরিয়ে আনেন। চার্লি চ্যাপলিন ভার্জিনিয়া শেরিলের আচরণে যথেষ্ঠ ক্ষুব্ধ হলেও তার অভিনয় প্রতিভায় অত্যন্ত মুগ্ধই হয়েছিলেন।

১৯৩০-এর সেপ্টেম্বরে এই চলচ্চিত্রের কাজ চার্লি চ্যাপলিন শেষ করেন। আর অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করেন সম্পাদনার কাজ। চার্লি চ্যাপলিন এই সিনেমার জন্য শ্যুটিং করেছিলেন ৩ লাখ ১৪ হাজার ২৫৬ ফিট ফিল্ম। সেই সময়কার হিসাবে এটা ছিল অত্যন্ত ব্যয়বহুল। কিন্তু খরচের ব্যাপারে চার্লি চ্যাপলিন মোটেও কার্পণ্য করেননি। কারণ তিনি জানতেন এই ছবি তাকে কতোটা সাফল্য এনে দেবে। সম্পাদনার সময় অনেক কাট-ছাঁটের পরে এটি অবশ্য হয়ে পড়েছিল ৮০৯৩ ফিটের ফিল্ম। শ্যুটিংয়ের শুরু থেকে সম্পাদনার শেষ পর্যন্ত সময় লেগে গিয়েছিল প্রায় দুই বছর। এই দুই বছরে নির্বাক ছবিকে হটিয়ে সবাক ছবি দর্শকদের মধ্যে অত্যন্ত সাড়া ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু সিটি লাইটস তো নির্বাক ছবি! তাহলে চ্যাপলিন কি ভুল করেছিলেন?….না তিনি ভুল করেননি। সিটি লাইটস মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এটি চলে যায় দর্শকপ্রিয়তার শীর্ষে। দর্শকেরা দল বেঁধে সিনেমা হলে আসতে থাকেন এবং ফিরে যান একটি অন্ধ মেয়ে ও এক ভবঘুরের অসামান্য ভালোবাসার স্মৃতি বুকে নিয়ে। এই চলচ্চিত্রটি চার্লি চ্যাপলিনকে এনে দেয় বিপুল পরিমাণে আর্থিক এবং শৈল্পিক সাফল্য।

চার্লি চ্যাপলিন এই চলচ্চিত্রের জন্য অসংখ্য প্রশংসাবাণীতে সিক্ত হয়েছেন। এখনও হচ্ছেন। প্রশংসাধন্য হয়ে তিনি বেঁচে আছেন যুগ থেকে যুগান্তর ধরে।

(সিটি লাইটস-এর প্রিমিয়ারে আলবার্ট আইনস্টাইন এবং চার্লি চ্যাপলিন)