মঞ্চনাটক ’রিজওয়ান’ রিভিউ

অরণ্য প্রলয়
Published : 8 Sept 2017, 05:46 PM
Updated : 8 Sept 2017, 05:46 PM

কিছুদিন আগে শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল হলে একটি মঞ্চনাটক দেখলাম। নাটকটির নাম 'রিজওয়ান'। এটি মঞ্চস্থ করেছে 'নাটবাংলা'। আর এটির নির্দেশনা দিয়েছেন অধ্যাপক সৈয়দ জামিল আহমেদ। নাট্যনির্দেশনা এবং নাট্যশিক্ষার ক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত অভিজ্ঞ একজন মানুষ। আমি এর আগে তার নির্দেশিত বেশ কয়েকটি নাটক দেখেছি এবং নাটকগুলো আমার কাছে যথেষ্ট ভালোও লেগেছিল। সেই ভালোলাগাটার কারণেই আমি এবার তার "রিজওয়ান" নাটকটি দেখতে গিয়েছিলাম। তবে নাটকটি দেখে আমার আশাভঙ্গ হয়েছে এবং আমি অত্যন্ত মর্মাহত।

দলটির দেয়া ভাঁজপত্র অনুসারে এই নাটকটি নির্মাণ করা হয়েছে কাশ্মীরি বংশোদ্ভূত মার্কিন কবি আগা শাহিদ আলীর "দ্য কান্ট্রি উইদাউট আ পোস্ট অফিস অবলম্বনে"। এটির ভাষান্তর করেছেন ঋদ্ধিবেশ ভট্টাচার্য এবং নাটকটি লিখেছেন অভিষেক মজুমদার। নাটকটির প্রেক্ষাপটটি হলো যুদ্ধ ও সাম্প্রদায়িকতার আগ্রাসনে ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত কাশ্মীর। আর এই ব্যাপারটি বর্ণনা করা হয়েছে রিজওয়ান ও ফাতিমা নামের দুই ভাইবোনের মাধ্যমে। তবে এই নাটকে আসলে গোছানো কোনো গল্প খুঁজে পাওয়া যায় না। সবচেয়ে বড় কথা নাটকটির মধ্যে একটি গল্প খুঁজে পাওয়ার আশায় দর্শকেরা প্রায় দুই ঘন্টা ধরে মাথাকুটে মরেন।

আমার কাছে মনে হয়েছে নাটকটি বোঝার ক্ষেত্রে যথেষ্ট জটিল। তবে অভিজ্ঞ নাট্যনির্দেশক জামিল আহমেদ চেষ্টা করলে এই জটিলতাকে কাটাতে পারতেন। নাটকটির শুরুতেই অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্র ফাতিমা বেশ বড় একটি সংলাপ দেন। আর তাতেই নাটকটি শুরুতেই যথেষ্ট পরিমাণে ঝুলে যায় এবং এই ব্যাপারটি নাটকটির পুরোটা সময়জুড়েই থেকে যায়। আমি বলবো ফাতিমা চরিত্রে অভিনয়কারী মহসিনা আক্তার মোটেই ভালো অভিনয় করেননি। তার অভিনয় দেখে মনে হয়েছে তিনি বোধহয় এই প্রথমবারের মতো মঞ্চে উঠেছেন। তবে আমি পরে জানতে পারলাম তিনি নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগে পড়াশোনা করেছেন। সুতরাং বলতেই হচ্ছে, নাটক নিয়ে পড়াশোনা করা একজনের কাছ থেকে এতোটা দুর্বল অভিনয় মোটেই আশা করা যায় না। রিজওয়ান চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিতাস জিয়া। তার অভিনয়টিও আমার কাছে মনে হয়েছে যথেষ্ট পরিমাণে দুর্বল। আর তিনিও কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফর্ম্যান্স স্টাডিজ বিভাগে পড়াশোনা করেছেন। সত্যিই সেলুকাস!

এই নাটকে নৌকার কয়েকটি দৃশ্য আছে। নীল আলো এবং ধোঁয়ার মধ্য দিয়ে একটি নৌকা তার আরোহী সহ মঞ্চে প্রবেশ করে এবং বেশ কয়েকটি সংলাপের পরে বেরিয়ে যায়। এই দৃশ্যটি আমার কাছে অত্যন্ত ভালো লেগেছে এবং আমি একটি পরাবাস্তব অনুভূতি লাভ করেছি। এজন্য অধ্যাপক জামিল আহমেদকে ধন্যবাদ। তবে আরো কয়েকবার যখন নৌকাটি এই একইভাবে প্রবেশ করে তখন ব্যাপারটি একঘেয়ে হয়ে যায়। এই একঘেয়ে ব্যাপারটি পুরো নাটকজুড়েই ছিল, কারণ নাটকটি ছিল যথেষ্ট পরিমাণে ধীর গতির। আর এই একঘেয়ে ব্যাপারটি আরো বাড়িয়ে দিয়েছে মহসিনা আক্তার এবং তিতাস জিয়ার একঘেয়ে অভিনয়। তবে এই নাটকে আরো যারা অভিনয় করেছেন তারাও কিন্তু ভালো অভিনয়ের চেষ্টা করেও উতরে যেতে পারেননি।

এই নাটকটি দেখে নির্দেশকের প্রতি আমার মনে তিনটি প্রশ্ন জেগেছে।

১. কাশ্মীরের প্রেক্ষাপট নিয়ে আপনি যেহেতু নাটকটি মঞ্চস্থ করলেন তাহলে সেটা কি আমাদের দেশের কোনো ঘটনার সাথে মেলানো যেতো না? আমি কিন্তু এই নাটকে সেই যোগাযোগটি খুঁজে পাইনি। আর যোগাযোগটি যদি না-ই প্রতিষ্ঠা করলেন তাহলে এটি মঞ্চস্থ করলেন কেন?

২. নাটকের সংলাপগুলো কি আরো সহজ ভাষায় উপস্থাপন করা যেতো না? দর্শকের সাথে যোগাযোগহীন জটিল শব্দ কি পরিহার করা একেবারেই সম্ভব ছিল না? নাটকটি একঘেয়ে লাগার এটিও একটি কারণ। যে সংলাপ দর্শকেরা শুনছেন সেটিই যদি জটিল শব্দের সমন্বয়ে তৈরি করা হয় তাহলে দর্শকেরা নাটকটি বুঝবেন কিভাবে? যদিও এই দায়টি ভাষান্তরকারী এবং নাট্যকারের উপরেই বেশি বর্তায়।

৩. এই নাটকে প্রচুর ধোঁয়া ব্যবহার করা হয়েছে। ধোঁয়া সবসময়ই একটি মায়া সৃষ্টি করে। আর হয়েছেও তাই। ধোঁয়াপূর্ণ দৃশ্যগুলোর তুলনায় ধোঁয়াহীন দৃশ্যগুলো হয়ে গেছে নিষ্প্রাণ। ধোঁয়া ব্যবহারের রূপকটি আমি ধরতে পারিনি। বলবেন কি এতো ধোঁয়া ব্যবহারের তাৎপর্যটি কি?

এই নাটকটি সম্পর্কে ফেসবুকে দেখলাম অনেকেই বেশ সুন্দর সুন্দর এবং জ্ঞানগর্ভ কথা লিখেছেন। কেউ কেউ বলেছেন এই নাটকটির মতো মঞ্চনাটক বর্তমান সময়ে আর নেই। তবে আমি বলবো ভিন্ন কথা। এই একঘেয়েমিপূর্ণ ও মানুষের সঙ্গে যোগাযোগহীন নাটকের তুলনায় অনেক ভালো এবং সময়োপযোগী নাটক বর্তমান সময়ে মঞ্চস্থ হচ্ছে। আপনারা বোধহয় সেটি অনুধাবন করতে পারেননি। ফেসবুকে কেউ কেউ এই নাটকটির ধর্ষণ দৃশ্যের প্রশংসা করেছেন। আমি বলবো এটি কোনোভাবেই ধর্ষণের রূপক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এটি শিশুদের একটি খেলা হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কারণ রূপকটি বোঝানোর জন্য শিল্পসম্মত একটা কিছুর প্রয়োজন ছিল, যাতে দর্শকেরা বুঝতে পারেন এটি দিয়ে আসলেই ধর্ষণ বোঝানো হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন এটি প্রফেশনাল প্রযোজনা। আমি বলবো অভিনয় শিল্পীদের অভিনয় দেখে এটিকে মোটেই প্রফেশনাল প্রযোজনা মনে হয়নি।

আরো কয়েকজন বলছেন, এই নাটকের কন্টেটে তারা অত্যন্ত মুগ্ধ। আমি বলবো, যে কন্টেন্ট দর্শকদের বুঝতে সমস্যা হয় সেটি আপনাদের মুগ্ধ করে কিভাবে? কেউ কেউ বলছেন, এই নাটকের মাধ্যমে অধ্যাপক জামিল আহমেদ একটি নতুন ধরনের থিয়েটার উপস্থাপন করেছেন। আমি বলবো এই ধরনের থিয়েটার আমাদের দেশে অহরহই হচ্ছে। এই নাটকে অধ্যাপক জামিল আহমেদই যে শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল হলের পুরোটা ব্যবহার করেছেন তা নয়। আরো অনেকেই ব্যবহার করেছেন। তবে সিলিংয়ের গ্রীড এবং প্যাসেজগুলো তিনিই সার্থকভাবে ব্যবহার করেছেন এটা ঠিক।

ফেসবুকে আরো দেখলাম একটি দল এই নাটকটিকে খামোখা বিখ্যাত বানানোর চেষ্টা করছেন। তারা সমালোচনার জায়গাটিকে পুরোপুরি এড়িয়ে যাচ্ছেন। আমার কেন যেন মনে হয় এই তোষামোদকারী দলটির কারণেই বাংলাদেশের নাটক এখনো এগুতে পারছে না।

অধ্যাপক জামিল আহমেদ অনেক বছর পরে নাট্যনির্দেশনায় ফিরে এসেছেন। এজন্য তাকে সাধুবাদ জানাই। আশা করছি তার কাছ থেকে পরবর্তীতে এই নাটকটির তুলনায় আরো ভালো নাটক আমরা পাবো।