স্কুলের দিনগুলো: কামরুনসেসা স্কুলে

sanjida_khatun
Published : 3 March 2014, 07:41 AM
Updated : 3 March 2014, 07:41 AM

দেশবিভাগের ঝক্কি-ঝামেলা শেষ হলে কামরুননেসা স্কুলে পড়াশোনা শুরু হলো। নতুন স্কুলে ক্লাস নাইনে পড়া আরম্ভ করলাম। এই ক্লাসে `Cloister and the Hearth' নামের ইংরেজি র‌্যাপিড রীডার পেয়েছিলাম। ইংরেজি পড়ে ভালো বুঝতে পারতাম না। হঠাৎ একদিন এক সহপাঠীর বইয়ের দিকে চোখ পড়তে, অনুবাদে গল্পটা গড়গড় করে পড়ে ফেলা গেল। দারুণ লাগল গল্পটা।

এদিকে আমাদের বাড়িতে নোটবই স্পর্শ করবার চিন্তাই পাপ বলে গণ্য হতো। কিন্তু পাপ করেও উপন্যাসের রস পেয়ে যাবার ফলে আমার কাছে ইংরেজি বইটি সুবোধ্য হলে গেল। খুব আকর্ষণ জন্মালো ওই ক্লাসে। বলতে গেলে `Cloister and the Hearth'-ই আমাকে ইংরেজি ভাষা শিখিয়ে তুলল! সাহিত্যই যে আমাদের মানুষ করে, তার পরিচয় পেয়েছিলাম আগেও অসকার ওয়াইলডের তিনটি পাঠ্য গল্প `The happy Prince', The Nightingale and the Rose' আর `The Star Child' পড়ে সাহিত্যের আনন্দ উপভোগ করতে পেরেছিলাম। তখন আমরা ক্লাস সেভেনে পড়তাম। ইংরেজির ভয় দূর হওয়াতে লেখাপড়াতে উন্নতির সূত্রপাত হলো। কিন্তু অঙ্ক?

ছিলাম একেবারে ফেল্টুস্। আব্বুর মতন অতবড়ো অঙ্কবিদ আর স্ট্যাটিস্টিশিয়ানের মেয়ে হয়েও এই দশা। ওরকম হবার কারণ আছে। একে তো অঙ্ক ভয় পেতাম, তায় আব্বু সন্তানদের কাছ থেকে অনেক বেশি আশা করতেন বলে অঙ্ক করতে গিয়ে সহজেই ধৈর্য হারাতেন। রেগেমেগে দাঁত চেপে বলতেন–'ইয়ে টিয়ে করে . . . গাধা সব'! আর প্রাণ উড়ে যেত। মাথা নিচু হয়ে, চোখ দিয়ে টপটপ করে জল ঝরত। আর অঙ্ক হয়? কোনো মতে ম্যাট্রিকের বৈতরণী যে পার হয়েছিলাম– সেই যথেষ্ট। ব্যাস অঙ্কের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি! আর আমাকে পায় কে? তারপরে আর কিছুতে কখনো ঠেকতে হয়নি।

ফারসিতেও ম্যাট্রিকে বাজে নম্বর পেয়েছিলাম। না-বুঝে পড়া তো! মৌলবি সাহেবরা বুঝিয়ে পড়াবার ধারে কাছে ছিলেন না। ককখনো খারাপ নম্বর পাইনি কারণ, মৌলবি সাহেবরা সংস্কৃতের শিক্ষকদের চেয়ে বেশি নম্বর দেবার জন্যে পাল্লা দিতেন। একবার তো আরবির এক ছাত্রী হেসে আকুল–সে পরীক্ষা দিয়েছে আশি নম্বরের আর নম্বর পেয়েছে নম্বই! সংস্কৃতের মেয়েদের শিক্ষার মান অনুযায়ী বেশ ভালো নম্বর উঠত তো! এসবের ফলে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় বসে দেখি-প্রশ্ন যথেষ্ট কঠিন। ফারসি থেকে অনুবাদ করবার জন্যে যে-অংশ দেওয়া হয়েছিল তার অনেক শব্দের অর্থই জানি না। ফলে অনুবাদের ফাঁকে ফাঁকে কঠিন শব্দগুলোকেই বাংলা হরফে লিখে দিলাম। কত আর নম্বর পাব উপযুক্ত পরীক্ষকের হাতে!

কামরুননেসা স্কুলে কিছু মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা হয়েছিল। বাল্যবয়স থেকেই আমি উদার মানবতাবাদী হয়ে গড়ে উঠেছি। হিন্দু আর মুসলমান এই ভেদ-বোধ জন্মায়নি মনে। দেশভাগের পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসে পড়াশোনা করা কটি মেয়ে ঢাকায় এসে আমাদের ক্লাশে যুক্ত হয়েছিল। ওদের মনে সম্প্রদায়-চেতনা খুব লক্ষ করলাম। পূর্ববর্তী সহপাঠীদের সঙ্গেই আমার মেলামেশা ছিল। যেমন বেলা বোস। আশেকলেনে ওর বিধবা মা কাদের সর্দারের আশ্রয়ে একটি ছোটবাড়িতে মেয়েকে নিয়ে থাকতেন। বেলার হাঁটাচলা ছিল ব্যক্তিত্বপূর্ণ। ওর হাঁটা দেখেই আমি বলিষ্ঠভাবে হাঁটবার অভ্যাস করেছিলাম। সে স্কুলে আসত খালি পায়ে। অঙ্কে এত দক্ষ ছিল যে শিক্ষক বোর্ডে অঙ্কটা লিখতে শুরু করে একটু এগোতেই সবটুকু বুঝে ফেলে অস্থিরভাবে উঠে দাড়িয়ে অঙ্কটা কষে ফেলে লাফাতে লাফাতে ছুটে গিয়ে দিদির টেবিলে জমা দিত। অঙ্কের সবগুলো স্টেপ করত না বলে দিদি বিরক্ত হতেন। বকতেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা। রোজই বেলা ওই কান্ডই করতো, ধৈর্য ধরতে পারত ন না। বেলাকে আমি পছন্দ করতাম। ওর মনে কোনো কুটিলতা ছিল না। কিন্তু অন্যদের সম্পর্কে এমনটা বলা যাবে না। ক্লাসের ফাস্ট গার্ল ছিল জয়ন্তী। ওরা কয়েকজনে একদিন একটা ঘরে বসে কথাবার্তা বলছিল। আমি সে ঘরে যেতেই সবার চোখে চোখে ইশারা হয়ে গেল। জয়ন্তীর মুখে এমন একটা ভাব দেখলাম যে মনে হলো মুসলিম সম্প্রদায় নিয়ে কোনো বিরূপ আলোচনা হচ্ছিল, ঘৃণার ভাবটা ওর মুখে থেকে মিলিয়ে যায়নি। কথাবার্তা গেল থেমে। আমি আহত বোধ করে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে অন্য এক ঘরের দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ কেঁদে মনের কষ্ট লাঘব করলাম এতে জয়ন্তীদের অবশ্য কিছুই হলো না। আমারই লজ্জা হলো ওদের ঘৃণাটা দেখে ফেলে।

কিস্তি-১ আমার প্রথম স্কুল

কিস্তি-২ স্কুলের দিনগুলো: আনন্দময়ী স্কুলে