প্রকাশ্যে বলিতে নাই: আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ১৯৭১

সলিমুল্লাহ খান
Published : 16 Dec 2014, 05:07 AM
Updated : 16 Dec 2014, 05:07 AM

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন বিখ্যাত আবদুল মতিন ঐ বছরের কিছুদিন–হিশাব করিয়া বলিতে মোট এক বছর সাতদিন–ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে বসবাস করিয়াছিলেন। সেখানে যাঁহাদের সহিত তিনি ঘন হইয়াছিলেন তাঁহাদের মধ্যে বিবিধ রাজবন্দী–যথা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ চৌধুরী, অধ্যাপক অজিত গুহ এবং অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী। ২০০৩ সালে প্রকাশিত আত্মজীবনীতে আবদুল মতিন লিখিয়াছেন, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ চৌধুরী একবছর কারাগারে থাকিয়া ধৈর্যহারা হইয়াছিলেন, পৌঁছিয়াছিলেন অতিষ্ঠার চরমে। মাথাটা খারাপ হইতে কেবল বাকি ছিল। কারাগারে যাইবার আগে চৌধুরী সাহেব সক্রিয় বা সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন না। অজিত গুহ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য বা সমর্থক ছিলেন। তিনি আবদুল মতিনকে রবীন্দ্রনাথ পড়াইতে চাহিয়াছিলেন। মতিন পড়িতে শুরুও করিয়াছিলেন। আবদুল মতিন আরো জানাইতেছেন, মুনীর চৌধুরী তাঁহার খাতার ওপর মার্কসকে লইয়া ইংরেজিতে তাঁহার লেখা একটা কবিতা দেখিয়া তাঁহাকে বার্নার্ড শ পড়াইতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। দুঃখের মধ্যে, তিনি ১৪ মার্চ ১৯৫৩ তারিখে ছাড়া পাইয়া যাওয়ায় আর পড়া হয় নাই।

এই কথাটি পাড়িবার সামান্য আগে আবদুল মতিন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে মুনীর চৌধুরীর প্রাণদানের কথাও তুলিয়াছিলেন। তিনি লিখিয়াছিলেন, 'মুনীর চৌধুরী তো তাঁর স্ত্রীর বিরোধিতার কারণে প্রায় [কমিউনিস্ট] পার্টি বাদ দেয়ার অবস্থায়। তিনি ১৯৭১ সালে পাকবাহিনী ও তাদের দালালদের হাতে প্রাণ দিলেন।' এই উদাহরণ সাক্ষী রাখিয়া আবদুল মতিন ঘোষণা করিলেন, '১৯৭১ সালের অভিজ্ঞতায় দেখেছি যারা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগেছে, যারা লড়াই করেনি, যারা মনে করেছে এভাবে বাঁচা যাবে তারাই বেশি সংখ্যক মারা পড়েছে।' (মতিন ২০০৩: ৮২)
বলা হয়ত বাহুল্য নহে, এই মারা পড়ার দলে স্বয়ং আবদুল মতিনের জন্মদাতা অর্থাৎ বাবাও ছিলেন। তাঁহার বহির উৎসর্গপত্রে তাই তিনি লিখিয়াছেন, 'আমাকে রাজনীতি করতে যিনি সবদিক থেকে সহায়তা করেছেন এবং ১৯৭১ সালে পাক বাহিনীর হাতে প্রাণ দিয়েছেন সেই বাবাকে।'


এহেন দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগা, লড়াই না করা, এইভাবে বাঁচা যাইবে মনে করিয়া বসিয়া থাকা একটি চরিত্র হাতে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস 'রেইনকোট' গল্পটি লিখিয়াছিলেন। গল্পের নাম 'রেইনকোট' রাখিয়া ইলিয়াস ইশারা করিয়াছেন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের নায়কেরা হয়ত মানুষ নহেন–অন্য কিছু হইবেন। অন্য কিছু মানে ঘটনা। মানুষ নহে, ঘটনাই নায়ক। ইতিহাসে এমন সময়ও আসে যখন মানুষ ঘটনার সৃষ্টি ঘটায় না, ঘটনাই মানুষ সৃষ্টি করে। অথবা–কার্ল মার্কসের উক্তি ঘুরাইয়া বলিতে–মানুষ ইতিহাস সৃষ্টি করে বটে তবে নিজের যেমন ইচ্ছা তেমন নয়। মানুষ ইতিহাস সৃষ্টি করে অতীত হইতে বহিয়া আসা ঘটনাস্রোতের তোড়ে।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের 'রেইনকোট' গল্পের 'নায়ক' কে? এই প্রশ্ন না করিয়া পারা যাইতেছে না। এই গল্পের নায়ক কি ঢাকা শহরের সরকারী জগন্নাথ কলেজের মতন কোন এক কলেজের কোন এক শিক্ষক–দেশীয় ভাষায় অধ্যাপক–যাহার নাম নূরুল হুদা? নাকি তাহার গায়ে চড়িয়াছে যে 'রেইনকোট' সেই প্রায় অলৌকিক পরম পূজনীয় সামগ্রীটি? এই গল্পের কাহিনীটাকে কি আমরা ইতিহাসের উপকথা বলিব, না বলিব রূপকথা?

কলেজ অধ্যক্ষের বাড়ির গেটে মুক্তিবাহিনী গ্রেনেড ফাটাইয়াছে। তাহার পর কলেজ দাবড়াইতে আসিয়াছেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্নেল। তাহার সম্মুখে কলেজের অধ্যক্ষ আফাজ আহমদ এম.এসসি., পিএইচ.ডি., ইপিসিএসের ভাষায়, 'সরি, হি(মানে নূরুল হুদা) ইজ নট এ প্রফেসর, এ লেকচারার ইন কেমিস্ট্রি' অর্থাৎ 'ইনি অধ্যাপক নহেন, রসায়নশাস্ত্রের প্রভাষক।' এই নূরুল হুদা নামের অর্থটাও সামান্য নহে। নূরুল হুদা মানে পথের দিশারি বা দিশারির হাতের আলো। কুপোকাত নাম তাঁহার। তাঁহার নামটা মুহম্মদ নূরুল হুদাও হইতে পারিত। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস কি ভাবিয়া মুহম্মদ শব্দটা কাটিয়া দিয়াছেন জানি না। বাংলাদেশে এই রকম লোকের নামের আগে মোহাম্মদ নামটা থাকে। 'মুহম্মদ' আকারে না হউক অন্তত 'মোহাম্মদ' বানানে থাকে। এখানে বলিয়া রাখা ভাল, খোদ আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের নামের মধ্যেও একদা 'মোহাম্মদ' পদটা হাজির ছিল। সকলেই জানিবেন, আমাদের লেখকের পিতৃদত্ত আদ্যনাম ছিল আখতারুজ্জামান মোহাম্মদ ইলিয়াস। (ইলিয়াস ২০১২: ৪০৫)

নিজের নামের মত চরিত্রের নাম হইতেও আখতারুজ্জামান ইলিয়াস মোহাম্মদ নামটা কাটিয়া রাখিয়াছেন। তা রাখুন কিন্তু ইলিয়াস দুই কি চারি কথায় তাঁহার ছবি আঁকিয়াছেন চমৎকার। এই ছবিগুলিকে চারি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগে আছে তাহার ঘর বা সংসারের ছবি। দ্বিতীয় ভাগে রাস্তার বা পথঘাটের। তৃতীয় ভাগে তাঁহার কর্মস্থল বা কলেজের ছবি। আর পরিশেষে বন্দীশালায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্যাতনের ছবি।
ঘর-সংসারের ভিতরও ভয় তাহাকে পাইয়া বসিয়াছে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের পর বাংলাদেশের যে সকল শহর বন্দর গঞ্জ বা গ্রামে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর দখল কায়েম হইয়াছিল তাহার সামান্য ছবি মূর্ত হইয়াছে এই নূরুল হুদার বাসায়। ততদিনে হেমন্তের শেষ। চারিদিকে শীত শীত। কলেজের পিয়ন আসিয়াছে তাহার বাসায়। দরজায় প্রবল কড়া নাড়ার শব্দ শুনিয়া নূরুল হুদা ভাবিলেন, মিলিটারি! মিলিটারি আজ তাহার ঘরে। আল্লা গো। আল্লাহুম্মা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্নি কুন্তু মিনাজ জোয়ালেমিন পড়িতে পড়িতে তিনি দরজার দিকে আগাইলেন। আমাদের কথক কহিতেছেন, 'এই কয়েক মাসে কত সুরাই সে মুখস্ত করেছে। রাস্তায় বেরুলে পাঁচ কলেমা সবসময় রেডি রাখে ঠোঁটের ওপর। কোনদিক থেকে কখন মিলিটারি ধরে।' কথক যোগ করিতে ভোলেন নাই–তবু একটা না একটা ভুল হইয়াই যায়। ঐদিন দোয়াটা মনে পড়িল ঠিকই কিন্তু তিনি টুপিটা মাথায় দিতে ভুলিয়া গেলেন।

এমন সময় পিয়ন খবর আনিল–গত রাত্রে তাহাদের কলেজের দেওয়াল ঘেঁষিয়া কে বা কাহারা বোমা ফাটাইয়াছে। তাই কলেজের অধ্যক্ষ রসায়নের প্রভাষককে ডাকাইয়া পাঠাইয়াছেন। ইলিয়াস বয়ান করিতেছেন: ভয়াবহ কাণ্ড। ইলেকট্রিক ট্র্যানস্ফর্মার তো কলেজের সামনের দেওয়াল ঘেঁষিয়া। দেওয়ালের পর বাগান, টেনিস লন। তারপর কলেজ দালান। মস্ত দালান পার হইয়া ফুটবল ও ক্রিকেট খেলার মাঠ। মাঠ পার হইয়া একটু বাঁ দিকে প্রিন্সিপালের কোয়ার্টার। ইহার সঙ্গে মিলিটারি ক্যাম্প। কলেজের জিমন্যাশিয়ামে এখন মিলিটারি ক্যাম্প। প্রিন্সিপালের বাড়ির গেটে বোমা ফেলা মানে মিলিটারি ক্যাম্প অ্যাটাক করা।

পিয়নকে দেখিয়াও এখন নূরুল হুদার ভয় হয়। শুদ্ধ নূরুল হুদা কেন, 'মিলিটারির প্রাদুর্ভাবের পর' হইতে পিয়ন ইসহাক মিয়াকে দেখিয়া কলেজের সবাই, মানে অধ্যাপক মহোদয়গণ তটস্থ। এপ্রিলের শুরু হইতে সে বাংলা বলা ছাড়িয়া দিয়াছে। ইসহাক এখন কথায় কথায় 'জরুর' বলে। শেষ হেমন্তের এই বাদলাভরা সকালে ইসহাকের কড়া নাড়া আর জরুরি 'এত্তেলা' শুনিয়া নূরুল হুদার মতিভ্রম হইতে থাকে। কয়েক দিন আগে প্রিন্সিপাল সাহেবের কথায় ফোড়ন কাটিয়া এই ইসহাকের উচ্চারণ করা 'জরুর' শব্দটি আজ বৃষ্টিতে ভিজিয়া আরো টাটকা কানে বাজিল। বাজিতে না বাজিতে শব্দটি কোথায় যেন ফাটিয়া পড়িল। দুম শব্দ হইল। চমকাইয়া উঠিলেন নূরুল হুদা–এই বৃষ্টিতে ফের শুরু হইল নাকি? পরক্ষণেই হুঁশ হইল না, না, ইহা স্রেফ মেঘের গর্জন। বৃষ্টি বোধ হয় বাড়িতেছে। আজ বৃষ্টির বড় ডাঁট।

ভয় নূরুল হুদার পিছনে লাগিয়াছে। যুদ্ধ শুরু হইবার আগে তিনি থাকিতেন মগবাজারে। একটি দুই কামরার ফ্লাটে থাকিতেন স্ত্রী আসমা, একটি পাঁচ বছরের ছেলে আর একটি আড়াই বছরের মেয়েকে লইয়া। বৌয়ের ছোটভাইও–যাহার নাম মিন্টু–তাঁহাদের সঙ্গে থাকিত। ১৯৭১ সালের জুন মাসে–ঠিক বলিতে জুনের ২৩ তারিখে–মিন্টু চলিয়া গিয়াছে।

কথক জানাইতেছেন, জুলাইয়ের পয়লা তারিখে তিনি বাড়ি শিফট করিলেন। বলা যায় না, ওখানে যদি কেউ কিছু আঁচ করিয়া থাকে। মিন্টু চলিয়া যাইবার তিনদিন পরেই পাশের ফ্লাটের গোলগাল মুখের মহিলা তাহার বৌকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, ভাবী, আপনার ভাইকে দেখিতেছি না। ব্যস, এই শুনিয়াই নূরুল হুদা বাড়ি বদলাইবার জন্য হন্য হইয়া লাগিয়া গেলেন। 'মিলিটারি লাগার পর' এইবার লইয়া তাহার চারিবার বাড়ি পাল্টান হইল। এই সর্বশেষ বাসায় তিনি আসিয়াছেন নিরাপত্তার সন্ধানে। জায়গাটি দূরে, কলেজ হইতে দূরে, আত্মীয়স্বজন হইত দূরে। এমন কি–বলা যায়–শহর হইতেও দূরে।

এখানে আসিয়াও ভয় কিন্তু অন্য কোথায়ও যায় না। খাটের নিচে শুইয়া থাকে। নিচের ফ্লাটে থাকেন এক ওয়েলডিং কারখানার মালিক। তাহার শ্বশুর নিশ্চয়ই সর্দার গোছের রাজাকার। নহিলে ভদ্রলোক সপ্তাহে দুইদিন-তিনদিন মেয়ের বাড়িতে রেফ্রিজারেটর, টেপরেকর্ডার, দামি দামি সোফাসেট, ফ্যান, খাটপালংক এইসব চালান পাঠায় কি করিয়া? একদিন হিন্দুদের কোন দেবতার মূর্তি পর্যন্ত আসিয়াছিল, মূর্তিটা সোনার কিনা কে জানে! লোকটা যদি ঠাহর করিতে পারে যে তাহার জামাইয়ের ওপরতলায় যে 'প্রফেসার' থাকেন তাহার শালা হইল গিয়া 'মিসক্রিয়েন্ট' তো কি হইবে! তাহা হইলে গোলাগুলি চলিবে এই বাড়িতেই, এই ঘরের মধ্যে। সেই গুলির বোলে আসমাকে ঘুম পাড়িতে হইবে সারা জীবনের জন্য। তাই নূরুল হুদা বলেন এখানে কথাবার্তা বলার সময় হুঁশ ঠিক রাখা দরকার।

এই ভয়ের তোড়ে নূরুল হুদার সংসার ভাসিয়া যাওয়ার উপক্রম। কলেজে যাইবার উদ্দেশ্যে যখন নূরুল হুদা পান্তালুনের ভিতর পা গলাইতেছেন তখন রান্নাঘর হইতে বৌ বলিল, তাড়াতাড়ি চলিয়া আসিও। বৃষ্টি শুরু হইবার আগে মিরপুর ব্রিজের দিক হইতে গুলির আওয়াজ আসিতেছিল। বলা যায় না, কখন কি হয়। এই কথা শুনিয়াও ঘাবড়াইয়া গেলেন তিনি। গজ গজ করিলেন–'এসব কথা এখন বলার দরকার কি!' 'কোন কথায় কি বিপদ হয়, কেহ কি বলিতে পারে?'

এই ভয় তাঁহার দাম্পত্যের মধ্যপ্রদেশেও হানা দিয়াছে। নূরুল হুদা নিত্য আতঙ্কিত। সব কিছুতেই তাহার আতঙ্ক। তাহার জবানিতে, ইস্! আসমাটাকে লইয়া আর পারা গেল না। পরশু রাতে বিছানায় ছটফট করিতে করিতে সে বলে কি না, রাত্রে দুই চারিবার গুলিগালাজের আওয়াজ না শুনিলে তাহার ঘুম হয় না। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মত, আবার এই বৌটি যদি পলাতক ভাইটির কথা তোলে তো অস্ত্র ঢুকিয়া পড়ে তাহার ঘরের মধ্যখানে।

মিন্টু যে কোথায় গিয়াছে তাহা নূরুল হুদা যেমন জানেন, তেমনি তাহার বৌও জানে। কিন্তু তাহা লইয়া কথা বলেন না কেহ। দুঃখের মধ্যে, নিজের ভাইয়ের গৌরব প্রতিষ্ঠা করিতে গিয়া আসমা ছেলেমেয়েদের পর্যন্ত কথাটা বলিয়াছে। নিশ্চয়ই বলিয়াছে। নহিলে তাহারা পর্যন্ত কিভাবে বলিতেছে, ছোটমামা গিয়াছে খানসেনাদের মারিতে?

এই বৃষ্টি-বাদলার দিনে যখন যাইতেই হইবে, বৌ বলে, 'এই বৃষ্টিতে শুদ্ধ ছাতায় কুলাইবে না, গো, তুমি বরং মিন্টুর রেইনকোটটা লইয়া যাও'। মিন্টুর নামটাও তাহাকে বাড়তি ভয় দেখায়। বৃষ্টির দৌলতে আর আজ কিনা তাহাকে সেই মিন্টুর রেইনকোটটাই গায়ে চাপাইতে হইল। তাহাতেও রক্ষা নাই। 'দেখি তো, ফিট করে কিনা' বলিতে বলিতে আসমা আগাইয়া আসে। আর বলে, 'মিন্টু তো আবার অনেক লম্বা'। চিমটি কাটে, তোমার গায়ে হইবে তো। নূরুল হুদা খোঁচাটা ঠাহর করেন–ফের মিন্টুর সহিত তাহার তুলনা! এই ভাইকে লইয়া এরকম বাড়াবাড়ি করাটা কি আসমার ঠিক হইতেছে? মিন্টু গিয়াছে মুক্তিবাহিনীতে আর নূরুল হুদা যাইতে চাহেন নাই। এই তুলনাটাও কি নূরুল হুদার গায়ে লাগিতেছে না?


মিন্টুর ফেলিয়া যাওয়া রেইনকোট গায়ে চাপাইবার পর নূরুল হুদার মনে খানিক ভাবান্তর হইল। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়াইয়া নিজের নতুন রূপে তিনি ভ্যাবাচ্যাকা খাইলেন। রেইনকোটের রঙ্গ খাকি নহে, আবার জলপাই রঙ্গও নহে। মাটির মত রঙ্গটা একটু জ্বলিয়া গিয়াছে তবে তাহাতে জেল্লা কমিয়া যায় নাই। তাহাকে দেখিতে একটু মিলিটারির মত লাগিতেছে। পরক্ষণেই তিনি ভাবিলেন, মিলিটারির মত দেখা নিরাপদ নহে। রেইনকোট পরাকে মিলিটারিরা যদি মিলিটারির ছদ্মবেশ বলিয়া গণ্য করে!

রাস্তায় একটা রিকশাও নাই। এই নতুন পরিহিত বস্ত্রের বলে বলীয়ান হইয়া তিনি হাঁটিতেছেন। আর মনে মনে ভাবিতেছেন, তাহাকে কি মিলিটারির মতন দেখাইতেছে? পাঞ্জাব আর্টিলারি, বালুচ রেজিমেন্ট, কমান্ডো ফোর্স, প্যারা মিলিটারি, না মিলিটারি পুলিশ? এই রেইনকোটে কি তাহাকে নতুন কোন বাহিনীর লোক মনে হইতেছে? এই রেইনকোট পরিয়াই না তিনি বাস ধরিতে আসিয়াছেন।

বাসস্ট্যান্ডে জনপ্রাণী বলিতে নাই। তিনি একেলা। শেষ পর্যন্ত–অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর–যখন উত্তরদিক হইতে বাস আসিল ততক্ষণে একটা মিলিটারি লরি মাত্র দৃষ্টির আড়াল হইয়াছে। তিনি দেখিলেন বাসেও যাত্রী বলিতে তেমন নাই। অর্ধেকের বেশি সিট খালি। তিনি বাসে উঠিলেন। তাহার গায়ের রেইনকোটের পানি পড়িতে লাগিল। বাসের মেঝে ভিজিয়া গেল। এই বাবদ তাহার তো যাত্রীদের মুখে একটু খারাপ কথা–অন্তত একটা দুইটা টিটকারি–শুনিবার কথা। কিন্তু কই? তিনি অবাক হইয়া দেখিলেন কেহ তাহাকে কিছু বলিল না। তাহার রেইনকোটের পানিতে বাস সয়লাব হইয়া গেলেও কেহ টু শব্দটি করিল না। নূরুল হুদা ভাবিতেছেন, তাহার রেইনকোট সবাইকে ঘাবড়াইয়া দিল নাকি?

নূরুল হুদাকে দেখিয়া বাসের পিছনের দিক হইতে দুইজন যাত্রী সহসা সিট ছাড়িয়া দিল। তাড়াহুড়া করিয়া ঝুঁকি লইয়া প্রায় চলন্ত বাস হইতে নামিয়া পড়িল। নূরুল হুদা দেখিলেন এবং বুঝিতে পারিলেন, লোক দুইটা নিশ্চয়ই অপরাধী। ইহারা পলাইল ঠিক তাহাকে দেখিয়াই। তাহার ঠোঁটের কোণে একটুখানি আলগা হাসি ঝুলিয়া রহিল। তিনি বুঝিতে পারিলেন, মিন্টুর রেইনকোটে ভালো কাজ হইতেছে। চোর ছ্যাচড় পকেটমার সব কাটিয়া পড়িতেছে।

ঠোঁটের কোণায় ঝুলানো হাসি ছিঁড়িয়া পড়িবার আগেই নূরুল হুদা প্রিন্সিপালের কামরায় আসিয়া হাজির হইলেন। দেখিলেন প্রিন্সিপালের কামরায় তাহার সিংহাসনে বসিয়া আছেন একটি পাকিস্তানী মিলিটারী পাণ্ডা অর্থাৎ অফিসার। তাহার ভারিক্কি মুখ দেখিয়া অনুমান করা যায়, 'পাণ্ডাটি কর্নেল কিংবা মেজর জেনারেল, অথবা মেজর বা ব্রিগেডিয়ার'।

আজ সকালে বাসা হইতে বাহির হইবার আগে বৌ বলিয়াছিল, 'যাইতেই হইবে?' বৌ মনে করাইয়া দিয়াছিল, 'অসময়ের বৃষ্টিতে ভিজিয়া তোমার হাঁপানির টানটা আবার'। তবু তিনি বাহির হইয়াছেন। কারণ কলেজের প্রিন্সিপাল ডাকিয়া পাঠাইয়াছেন। তাহার উপর কলেজে আজ কর্নেল আসিয়াছেন। সাত সকালেই নূরুল হুদা ভাবিতেছিলেন, কপালে আজ কি আছে আল্লাই জানে! ভাবিতেছিলেন ফায়ারিং স্কোয়াডে যদি দাঁড় করাইয়াই দেয় তো কর্নেল সাহেবের হাতে পায়ে ধরিয়া ঠিক কপালে গুলি করার হুকুম জারি করানো যায় কিনা। তাঁহার জিজ্ঞাসা–প্রিন্সিপাল কি তাহার জন্য কর্নেলের কাছে এই তদবিরটুকুও করিবেন না?

আর আজ এই ভরদুপুরে–জাঁদরেল কর্নেল কি ব্রিগেডিয়ার কে তিনি জানেন না–মিলিটারি পাণ্ডার সম্মুখে দাঁড়াইয়া তিনি ঠাহর করিলেন রেইনকোটে আর কাজ হইতেছে না। চেনার জগত শেষ হইয়াছে। এখন শুরু হইয়াছে জানার জগতের। তাঁহার এক সহকর্মী আবদুস সাত্তার মৃধা আর নূরুল হুদাকে মিলিটারি গ্রেপ্তার করিল। মিলিটারি জিপে তুলিয়া লইয়া গেল। দুই জনেরই চোখ বাধিয়া দেওয়া হইয়াছিল। জিপ চলিতেছিল আঁকিয়া বাঁকিয়া। মস্ত উঁচু একটা ঘরে তাহাদের আনিয়া ফেলা হইল। চোখ খুলিয়া দেওয়া হইল। নূরুল হুদা দেখিতে পাইলেন ততক্ষণে সেখানে আবদুস সাত্তার মৃধা আর নাই। জায়গাটাও একেবারে অচেনা। একটা ডেক চেয়ারে তাহাকে যে কতক্ষণ বসাইয়া রাখা হইল তাহার কোন শুমার নাই। তাহার সামনে একটা চেয়ারে আসিয়া বসিলেন এক মিলিটারি অফিসার।

মিলিটারি অফিসার জানিতে চাহেন, কিছুদিন আগে তাহাদের কলেজে কয়েকটা লোহার আলমারি কেনা হইয়াছিল। ঐগুলি বহিয়া আনিয়াছিল কাহারা? প্রিন্সিপাল সাহেবের আদেশে আলমারিগুলির স্টিলের পাতের ঘনত্ব, দেরাজের সংখ্যা ও আকার, তালাচাবির মান, রঙ্গের মান প্রভৃতি পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছিলেন নূরুল হুদা। তিনি দায়িত্ব পালন করিতেছিলেন মাত্র। মিলিটারির অভিযোগ, মিসক্রিয়েন্টরা কলেজে ঢুকিয়াছিল কুলির বেশে। তাহারা আজ ধরা পড়িয়া নূরুল হুদার নাম বলিয়াছে। তাহাদের সঙ্গে নূরুল হুদার নিয়মিত যোগাযোগ আছে আর সে এই দুষ্কৃতিকারী দলের একজন সক্রিয় সদস্য। অভিযোগ শুনিয়া নূরুল হুদা যেন আকাশ থেকে পড়িলেন। তাহার পর শুরু হইল নির্যাতন। মিলিটারি অফিসার তাঁহাকে বার বার একই প্রশ্ন করিতে থাকেন। আর জবাব না পাইয়া প্রবল বেগে দুইটা ঘুষি লাগাইলেন তাহার মুখে। প্রথম ঘুষিতে তিনি কাত হইলেন। দ্বিতীয় ঘুষিতে পড়িয়া গেলেন মেঝেতে। মেঝে হইতে তুলিয়া মিলিটারি অফিসার তাহাকে আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, 'উহাদের আস্তানা কোথায়?' নূরুল হুদা কবুল করিলেন, উহাদের ঠিকানা তিনি জানেন।

আসলে ঠিকানা তো তিনি জানেন না। নিজেদের প্রশ্নের জবাব না পাইয়া মিলিটারি তাহাকে অন্য একটি ঘরে লইয়া গেল। তাহার বেটেখাটো শরীরটা ঝুলাইয়া দেওয়া হইল ছাদে লাগানো একটা আংটার সঙ্গে। নূরুল হুদা দেখিতে পাইলেন, তাহার গায়ের রেইনকোটটা ইহারা খুলিয়া ফেলিয়াছে। কোথায় রাখিয়াছে কে জানে।

বৃষ্টির মত চাবুকের বাড়ি তাহার রেইনকোটের মত চামড়ায় পড়ে আর তিনি অবিরাম বলিয়াই চলেন, মিসক্রিয়েন্টদের ঠিকানা তাহার জানা আছে। শুদ্ধ তাহার শালার নহে–উহার ঠিকানা জানার মধ্যে তো কোন বাহাদুরি নাই–তিনি ছদ্মবেশী কুলিদের আস্তানাও চেনেন। তাহারাও তাহাকে চেনে এবং তাহার উপর তাহাদের আস্থাও কম নহে। এই জায়গায় আসিয়া রেইনকোট আর চেনা-জানার জগত একাকার হইয়া গিয়াছে। সাকার ও আকারের পর শুরু হয় একাকার বা নিরাকার জগত। সেই জগতই শেষ ভরসা। এই জগতকেই মুসলমানরা আলাহ ভরসা বলিয়া জানেন।


'রেইনকোট' গল্পটি পড়িবার পর আমার মনে হইল–পরিণতির কথাটা বাদ রাখিলে–এই গল্পের সহিত আখতারুজ্জামানের জীবনকথার মিলও খানিক পাওয়া যাইবে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস রচনাসমগ্রের শেষে সংযুক্ত জীবনপঞ্জীটি পড়িলে জানা যায়–অনেক মধ্যবিত্ত দেশপ্রেমিকের মতন–তিনিও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সশরীরে যোগদান করেন নাই। নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করিয়াছিলেন মাত্র। ১৯৭১ সালে আখতারুজ্জামানের বয়স কত ছিল? মাত্র ২৭ কি ২৮। জীবনপঞ্জীতে সন্নিবেশিত তথ্য অনুসারে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হইয়াছিলেন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হইবার কমসেকম দুই বৎসর পরে। ১৯৭৩ সালের ১২ এপ্রিল। এই কথা তাহার পরও সত্য যে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস আখতারুজ্জামান শত্রুকবলিত বাংলাদেশে আটক ছিলেন। ছিলেন চাকরিতে উপরত।

জীবনপঞ্জীর তথ্য অনুযায়ী তিনি ১৯৬৫ সালের আগস্ট মাসে ঢাকার জগন্নাথ কলেজে প্রভাষক পদে যোগদান করেন। জীবনের এই পর্বে (১৯৬৫-১৯৭০) তিনি জিন্নাহ অ্যাভিনিউর 'রেক্স' রেস্তোরাঁ আর নবাবপুরের 'আরজু' হোটেলে আড্ডা দিতেন। বাংলাবাজারের 'বিউটি বোর্ডিং' এবং কাপ্তান বাজারের 'নাইল ভ্যালি' রেস্তোরাঁতেও কিছু কিছু আড্ডায় তিনি শামিল হইতেন। জীবনপঞ্জী লেখক জানাইতেছেন, ১৯৬৮-৬৯ সালের গণ আন্দোলন তিনি ঘনিষ্টভাবে প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন। 'প্রতিটি মিটিংয়ের মনোযোগী শ্রোতা! বিশেষত মওলানা ভাসানীর মিটিং কোনটাই বাদ যায় না।' আরও লেখা হইয়াছে, তিনি দৈবেসৈবে মিছিলেও যোগ দিতেছেন। আড্ডায়ও প্রতিদিনের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ হইতেছে। (ইলিয়াস ২০১২: ৪০৭)

মজার বিষয়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরও এই আড্ডায় বড় ছেদ পড়ে নাই। তাঁহার জীবনপঞ্জীর লেখক–কনিষ্ঠ সহোদর খালিকুজ্জামান ইলিয়াস–জানাইতেছেন, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পরিচিত মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে গোপন যোগাযোগ রাখিতেছেন, বাড়িতে আশ্রয় দিতেছেন। ' এ সময় কিছু প্রকাশ্য, কিছু গোপন আড্ডাও হয়। গুলিস্তান সিনেমা হল সংলগ্ন 'গুলিস্তান' রেস্টুরেন্টে নতুন আড্ডায় মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সহানুভূতিশীল দুয়েকজন অবাঙ্গালি (উর্দুভাষী) বন্ধুও যোগ দেন।' (ইলিয়াস ২০১২: ৪০৭)

এই কথা অন্য কেহ লিখিলে হয়ত ধরিয়া লইতাম কাজটা কোন চরিত্র-জিঘাংসুর। ১৯৭১ সালের মাঝামাঝি নাগাদ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস জগন্নাথ কলেজে তাঁহার সহকর্মী অধ্যাপক শওকত আলীর ৪২/বি হাটখোলা রোডে অবস্থিত বাসায় ভাড়া থাকা শুরু করেন। ঐ সময় জগন্নাথ কলেজে শওকত আলীও যে সার্বক্ষণিক চাকরি করিতেছেন তাহার সাক্ষ্য দিয়াছেন শফিউল আলম। ১৯৭০ হইতে ১৯৮১ পর্যন্ত জগন্নাথ কলেজে ইলিয়াসের অন্যতম সহকর্মী ছিলেন অধ্যাপক শফিউল আলম।

তিনি আরও সাক্ষ্য দিতেছেন: ১৯৭১ এর জুলাই-আগস্টে তাহাদের সেই দুঃসহ দিনগুলিতে বাংলা বিভাগে জমায়েত হইতেন তাহারা। ছাত্র নাই, ক্লাস নাই কিন্তু শিক্ষকদের হাজিরা চাই। চারদিকে পাকিস্তানের মিলিটারি আর রাজাকারদের আতঙ্ক। এ সময় দুইজন উর্দুর অধ্যাপক, যাঁহারা সম্পূর্ণত পাকিস্তানি কর্মকাণ্ডের বিরোধী, বাংলা বিভাগে আসিয়া যুদ্ধের নানা রম্য ঘটনার বর্ণনা করিতেন উর্দুতেই। তাঁহারা ছিলেন জনাব আজহার কাদরী ও হারুনুর রশিদ। ইলিয়াস বেশ ভাল উর্দু বলিতে পারিতেন। এ সময় তিনি ভার নিলেন অর্থনীতির অধ্যাপক সহজ সরল মানুষ শিশু সাহিত্যিক সাজেদুল করিমকে উর্দু শিখাইবার। সাজেদুল করিম দুই আনা দিয়া একটা রুলটানা খাতা কিনিলেন। ইলিয়াস প্রতিদিনের উর্দু সবক উর্দু বাতচিত বাংলা উচ্চারণে লিখিয়া দিতে থাকিলেন। মূল লক্ষ্য হইল পাকিস্তানী মিলিটারি ধরিলে কিভাবে কোন কথার জবাব উর্দু জবানে দিতে হইবে। অনেকটা মৃত্যুর পর কবরে মনকির-নকিরের সওয়াল-জওয়াবের ঢঙ্গে লেখা। দৃশ্যপটগুলি ভুলিবার নয়। এই বয়ান পড়িলে মনে হয় 'রেইনকোট' গল্পটার খসড়াই পড়িতেছি।

শফিউল আলম আরো বলিয়াছেন, ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের ১০ তারিখ কার্ফ্যুর মধ্যে তাহার ঢাকা ছাড়ার আগ পর্যন্ত অক্ষয় দাস লেনে ফরাশি দৈনিক লা মোঁদের ইংরেজি ভার্সন, ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর, দৈনিক গার্ডিয়ান ও টাইমসে কি লেখা হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের খবর সম্বলিত এসব পত্রিকার কাটিং, কখনো কখনো পুরা পত্রিকা ইলিয়াস তাহাকে সরবরাহ করিতেন। পড়ার পর এসব পত্রিকা কিভাবে মশারির ওপরে বা তোষকের নিচে ঠিক মাঝখানটিতে পিঠের নিচে লুকাইয়া রাখিতে হইবে সেই নির্দেশও দিয়া যাইতেন। (আলম ২০০১: ২৫)

১৯৭১ সালের আরো কয়েকটি কথা লিখিয়াছেন শফিউল আলম। ইহাতে মধ্যবিত্ত দেশপ্রেমিকের ছবি ভালই ফুটিয়াছে। তাঁহার বয়ান অনুসারে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জুন-জুলাইয়ের দিকে জগন্নাথ কলেজে পাকিস্তানি মিলিটারির কনসেনট্রেশন ক্যাম্প বসিয়াছে। এ ক্যাম্পের মিলিটারিদের সহচর দুই জন অবাঙ্গালি রাজাকার চেইনে বাঁধা বানর লইয়া তাহাদের বাংলা বিভাগের পাশ দিয়া ঘুরিয়া বেড়ায়। কলেজ গেটে ঢুকিতেই বামদিকে এক মেজরের অফিস। ছাত্র নাই, কলেজ খোলা, খাঁ খাঁ করিতেছে চারিদিক। এমন সময় একদিন ঢাকা কলেজ হইতে টিসি লইয়া আসিয়া বিএ প্রথম পর্বে স্পেশাল বাংলা লইয়া ভর্তি হইল দাউদ হায়দার। ডিপার্টমেন্টে আসিয়া বলিল–ও ক্লাস করিতে চায়। শওকত [আলী] ভাই ক্লাস লইলেন। ক্লাসের পর মুখটা তাঁহার ভারি। বলিলেন, দাউদ হায়দার ক্লাসে অশোভন কথা বলে। ইলিয়াস খুব ক্ষেপিয়া গেলেন। বলিলেন–তিনি তাঁহার ক্লাসে দাউদকে এলাউ করিবেন না। একে তো ছাত্র নাই, কলেজ খোলা, পুরা মিলিটারিতে ভরা। এই সময় ছাত্র ক্লাস করিতে চাহিয়াছে অথচ তিনি তাহাকে ক্লাসে ঢুকিতে দিবেন না। ইলিয়াস ছিলেন সবসময় ব্যতিক্রম। দাউদ হায়দার কয়েক মাস পর কলেজে আর আসে নাই। (আলম ২০০১: ২৮)

আরো লিখিয়াছেন শফিউল আলম। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে জগন্নাথ কলেজে অনার্স খোলা হইল। বইপত্তর তেমন কিছুই নাই, সেমিনার কক্ষ নাই। তারপর একদিন শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলী জগন্নাথ কলেজের দোরগোড়ার সামনে ইম্পিরিয়েল ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার সামনের বিশাল চত্বরে সভা করিলেন। ঘোষণা দিলেন এ কলেজে অনার্স কোর্স খোলা হইবে। দিবা বিভাগেও খোলা হইল বাংলা অনার্স। ইম্পিরিয়াল ব্যাংক ভবনের নিচতলায় বিশাল হলে খোলা হইল কলেজ লাইব্রেরি। আগে–স্বাধীনতার একবছর পরও–লাইব্রেরিটা মূল ভবনের নিচতলার উত্তরদিকে ছিল।

মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই ২৬ মার্চ পাকিস্তানি সৈন্যরা যখন ক্যাম্প গড়িল তখন তাহারা এ লাইব্রেরি লন্ডভন্ড করিয়া দেয়। লাইব্রেরিতে প্রচুর উর্দু বই ছিল। ছিল বহু পুরানা পাণ্ডুলিপি। পাণ্ডুলিপিগুলি ছিন্নভিন্ন করিয়া হায়েনার দল উর্দু বইগুলি লুট করে। দোতলায় উত্তরপূর্ব কোণে বাণিজ্য বিভাগের বিশ্ব মানচিত্র থেকে পূর্ব বাংলা অংশটি ব্লেড দিয়া কাটিয়া লয় তাহারা। জগন্নাথ কলেজের প্রতিষ্ঠাতার দুইটি অয়েল পেইন্টিং ছিল দোতলায়। ঐগুলিতে আঁকিবুকি করে তাহারা। ইলিয়াস বিধ্বস্ত লাইব্রেরিটা ঘুরিয়া ঘুরিয়া দেখান তাহাকে। তারপর বর্ণনা করেন কোথায় কি খোয়া গেল তাহার কথা। এ লাইব্রেরির প্রতিটি বই, বইয়ের বর্ণমালা ছিল তাঁহার নখদর্পণে। (আলম ২০০১: ২৪)


আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তাঁহার অল্পায়ু জীবনের একেবারে উপান্তে পৌঁছিয়া 'রেইনকোট' গল্পটা লিখিয়াছিলেন। ততদিনে ১৯৯৫ সাল আসিয়া গিয়াছে। আমি অনেক দিন ধরিয়া ভাবিয়াছি, এই গল্পটা লিখিতে এতখানি সময় লইলেন কেন তিনি। সময় যে লইয়াছেন তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। আমার মনে হইতেছে ইহাতেই প্রমাণ এই গল্পের প্রাণ ইতিহাস বা উপকথা নহে। গল্পটি ইতিহাস বা উপকথা (অর্থাৎ ফ্যাবল) জ্ঞানে পড়িলেও লাভ আছে। তবে যদি ইহাকে রূপকথা (অর্থাৎ অ্যালেগরি) জ্ঞানে পড়িতে পারি আরো গুরুতর লাভ। ইতিহাস তো শত শত লেখা হইতেছে। তাহাতে যে যাহার মত হাতি দেখিতেছেন, কেহ শুড়, কেহ দাঁত, কেহ বা কান, কেহ বা পায়া। ইলিয়াসের গল্পের মধ্যে পুরা হাতিটাই দেখা যাইবে বলিয়া আমার বিশ্বাস।

সম্প্রতি আমাদের পুরাতন বন্ধু জাহিদুর রহিম অঞ্জন এই গল্পের ছায়া ধরিয়া একটি উত্তম চলচ্চিত্র বানাইয়াছেন। নাম রাখিয়াছেন বড় কোমল–'মেঘমল্লার'। ছবিটা এখনও ছাড়া পায় নাই। সেই চলচ্চিত্র বার দুই দেখিয়া আমার মনে দৃঢ় প্রতীতি জন্মিয়াছে–আখতারুজ্জামান ইলিয়াস 'রেইনকোট' গল্পের মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর রূপকথা বড় রূপাঢ্য ভাষায় লিখিয়াছেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মুহূর্তে–পাকিস্তানী দখলদার শাসনে–বাংলাদেশকে কি রকম দেখাইত তাহা উপকথার বিষয়। কিন্তু বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষিত মধ্যশ্রেণী এই যুদ্ধে কিভাবে শরিক হইয়াছিল তাহার গল্প রূপকথাকে ছাড়াইয়া গিয়াছে। মনে রাখিতে হইবে, ইংরেজি 'অ্যালেগরি' শব্দটি আদপে গ্রিক। ইহার অর্থ গোপন কাহিনী। মানে অপরের গল্প। এই গল্প প্রকাশ্যে বলিতে নাই।

১০ নবেম্বর ২০১৪

দোহাই
১. আবদুল মতিন, জীবন পথের বাঁকে বাঁকে (ঢাকা: সাহিত্যিকা, ২০০৩)।
২. আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, 'রেইনকোট', আখতারুজ্জামান ইলিয়াস রচনাসমগ্র ১, পুনর্মুদ্রণ (ঢাকা: মাওলা ব্রাদার্স, ২০১২), পৃ. ৩৯২-৪০৪।
৩. খালিকুজ্জামান ইলিয়াস, 'জীবনপঞ্জী', আখতারুজ্জামান ইলিয়াস রচনাসমগ্র ১, পুনর্মুদ্রণ (ঢাকা: মাওলা ব্রাদার্স, ১০১২), পৃ. ৪০৫-৪১২।
৪. শফিউল আলম, 'অনতিক্রম্য, অনন্য: আখতারুজ্জামান ইলিয়াস,' মুজিবুল হক কবীর ও মাহবুব কামরান (সম্পাদিত), আখতারুজ্জামান ইলিয়াস: ফিরে দেখা সারাজীবন (ঢাকা: ম্যাগনাম ওপাস, ২০০১), পৃ. ২৩-৩০।