শাহবাগের নতুন ভাষা: আমরণ অনশন

Published : 28 March 2013, 03:08 PM
Updated : 28 March 2013, 03:08 PM

ঢাকার জাতীয় জাদুঘরের গেটের পাশে সামিয়ানা টাঙানো ছোট একটু জায়গা। ব্যক্তিগত জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কাজকর্ম ও আরাম-আয়েশের মুহুর্তগুলো বিসর্জন দিয়ে সেখানে নতুন প্রতিবাদের ক্ষণ নির্মাণ করছে ক'জন ভিন্নধর্মী তরুণ-তরুণী। যাদের আবেগের বিষয়টি এখনও বুঝে উঠতে পারেনি এদেশের মানুষ- সে তরুণরা ওই ছোট্ট জায়গাটিতে বসে জানান দিতে চাচ্ছে তাদের প্রতিবাদের কঠোর ভাষা- আমরণ অনশনের প্রতিজ্ঞা। প্রাণচঞ্চল এ তরুণরা গত ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে একত্রিত হয়েছিল শাহবাগে। শহীদ রুমি স্মরণে তাদের এ মিলিত উদ্যোগের নাম দিয়েছিল 'শহীদ রুমি স্কোয়াড'। রুমি স্কোয়াড শাহবাগ আন্দোলনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছিল তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে। জাহানারা ইমামের প্রতিকৃতি নির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছিল এ স্কোয়াডের তরুণরাই। আর এখন স্কোয়াডের তরুণরা শাহবাগের চলমান আন্দোলনের অন্যতম দাবি হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করে এতে একটি নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। তাদের ভাষা যেমন সহজ, তেমনি কঠোর।

ক্ষোভ প্রকাশের ভাষা মানুষ-ভেদে যেমন ভিন্ন, তেমনি গোষ্ঠী-ভেদে, দেশ-ভেদেও ভিন্ন হতে পারে। একই অবিচার ও অন্যায়ের শিকার হয়ে কেউ হয়তো অস্ত্র ধরে, কেউ আঁকড়ে ধরে সামাজিক আন্দোলন, কেউ যায় অনশনে, কেউ হয় ঘরকুনো। এর যেকোনো একটি সম্বল করার অধিকার মানুষের আছে। কিন্তু এটি প্রশ্নসাপেক্ষে। কে তাকে অস্ত্র দিচ্ছে, কে তাকে ধৈর্য দিচ্ছে, কে তাকে শক্তি দিচ্ছে, আর কে তাকে নির্লিপ্ততা শেখাচ্ছে- সেটা জানা দরকার। অস্ত্র, ধৈর্য, শক্তি এর যেকোনো একটির সরবরাহের পিছনে যদি থাকে কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তি বা দলের উদ্দেশ্য অর্জনের লক্ষ্য- তখন জনগণের সেখান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকে অনেক বেশি। কিন্তু ধৈর্য ও শক্তির উৎস যদি হয় জনগণ তাহলে তার ফল হয় সুদূরপ্রসারী।

সব প্রশ্ন শেষে একটি কথাই সত্য- মানুষের ক্ষোভ ক্ষোভই। নিপীড়ন নিপীড়নই। শুধু তীব্রতা-ভেদে নিপীড়নের বিরুদ্ধে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশের ভঙ্গি বদল হয়। আর এ প্রকাশভঙ্গি কেন্দ্র করে নির্মিত হয় তাদের সামাজিক পরিচয়। তাই একই গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী হয়েও বিভিন্ন মাত্রায় ক্ষোভ লালন করে আসছে একেকজন কর্মী। এ ক্ষোভের তীব্রতার নির্ধারক দেশপ্রেমের তীব্রতা দিয়ে যেমন নির্ণয় করা যায় না, তেমনি বয়স বা অভিজ্ঞতা দিয়েও সম্ভব নয়। ২৬ মার্চে আলটিমেটাম দেওয়ার পরও সরকার যখন জামায়াতে ইসলামী নামক যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন নিষিদ্ধ করা তো দূরের কথা, তাদের বাজেয়াপ্ত করার ন্যূনতম পদক্ষেপ পর্যন্ত নেয়নি তখন অনেক তরুণ আশা করেছিল গণজাগরণ মঞ্চ কিছু কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করবে।

কিন্তু তাদের আকাঙ্ক্ষার কোনো প্রতিফলন যখন ঘোষণায় আসেনি তখন উদ্যোগী ও কর্মঠ একদল তরুণ তাদের ছোটো সংগঠন রুমি স্কোয়াডের ছায়ায় একত্রিত হয়ে তাদের নিজস্ব কর্মসূচি ঘোষণা করে। শহীদ রুমি স্কোয়াডের তরুণদের আমরণ অনশনের ঘোষণায় প্রথমে কেউ বিস্মিত, কেউ ক্ষুব্ধ, কেউ তরল, কেউ শীতল অনুভূতি নিয়ে বাড়ি ফেরে। অনশনকারীদের নিয়ে শুরু হয় চুলচেরা বিশ্লেষণ।

ঠিক যেমনটি শুরু হয়েছিল ৫ ফেব্রুয়ারি রাতে। ফেব্রুয়ারির শুরুতে বেশ কিছুদিন লেগেছিল মানুষের বুঝতে যে, কে বা কারা এত ক্ষোভ লালন করে এসেছে, এর প্রকাশ দেখে বিস্মিত হয়েছে জনগণ। ৫ ফেব্রুয়ারির সঙ্গে ২৬ মার্চের তফাত হচ্ছে- ৫ ফেব্রুয়ারিতে গণজাগরণ মঞ্চের কোনো পরিচয় ছিল না, তকন তা তৈরি হচ্ছিল নানা কর্মসূচি ও বাদ-প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে। কিন্তু ২৬ মার্চে শহীদ রুমি স্কোয়াডের নতুন করে পরিচিত হওয়ার প্রশ্ন আসেনি, বরং প্রশ্ন উঠেছে তাদের কর্মসূচির কঠোরতা নিয়ে। সে অর্থে শহীদ রুমি স্কোয়াডের কঠোর অবস্থান অনেক মানুষের আরামের আন্দোলনকে চ্যালেঞ্জ করে বসেছে।

প্রশ্ন উঠেছে একই মঞ্চ থেকে দু'ধরনের কর্মসূচি হয় কী করে? একই উদ্দেশ্যে যারা মাঠে নেমেছে তারাই বা কী করে দু'ধরনের কর্মসূচি একই সঙ্গে পালন করবে? এখানে এ আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে যে, আন্দোলনটি তৈরি হয়েছে সামষ্টিক নেতৃত্বের মধ্যে দিয়ে। যদিও পরবর্তীতে নেতৃত্বের স্থানে দেখা গেছে অনেক ধরনের সংগঠনের মুখপাত্রদের, কিন্তু প্রথমদিকে শাহবাগে তরুণেরা যে যার মতো এসে নিজস্ব ভাষায় তাদের দাবি প্রকাশ করতেন। বাস্তবিক কারণেই একটা নির্দিষ্ট সময় পর যখন আন্দোলনের কর্মসূচি সবার আলোচনার প্রেক্ষিতে নির্ধারণ হয় তখন ধীরে ধীরে তার প্রকৃতি পরিবর্তন হতে থাকে। নতুন কর্মসূচি ঘোষণার পর শাহবাগে মানুষের সমাগম কম হওয়ার মানে এই নয় যে মানুষের সমর্থন কমে গেছে। কর্মসূচির ধরন বদলানোর মানেও এ নয় যে যেসব মানুষেরা শাহবাগে এসেছিলেন তারা যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির দাবি থেকে বিচ্যুত হয়েছেন।

শহীদ রুমি স্কোয়াড আন্দোলনের একটি নতুন দিকের সূচনা করেছে। এ দিকটি কঠোর। এতে উত্তেজিত শ্লোগান নেই, গান নেই, রয়েছে কেবল কিছু অনশনকারী যারা তাদের সহযোগী গণজাগরণ মঞ্চের অন্যান্য কর্মীদের কর্মসূচির সঙ্গে একাত্ম কিন্তু একই সঙ্গে তারা তাদের নিজেদের প্রতিবাদের ভাষাটাও বর্জন করতে রাজি নন।

গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন শুরু হয়েছিল সামষ্টিক নেতৃত্বের নতুন ধারা তৈরির মধ্য দিয়ে। এরই ধারাবাহিকতায় আজকে শহীদ রুমি স্কোয়াড তাদের নিজেদের প্রতিবাদের ভাষা অক্ষুণ্ন রেখে মিলিত হয়েছে শাহবাগে। প্রজ্বলিত এ তরুণদের ভাষা ভিন্ন হতে পারে, হতে পারে তাদের এ উদ্যোগ আত্মঘাতী- কিন্তু রুমি স্কোয়াডের এ তরুণরা যদি বিশ্বাস করে একমাত্র কঠোর কর্মসূচির মাধ্যমে আন্দোলনের অন্যতম দাবি জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধকরণের দাবি আদায়ে তাদের দৃঢ়তা প্রকাশ করবে- তাহলে তাদের মতামতের প্রতি সম্মান জানিয়ে শাহবাগের আন্দোলনকে অগ্রসর হতে হবে।

গনজাগরণ মঞ্চ নিয়ে জনমনে তীব্র উত্তেজনার ঢেউ তুলতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে দেখা গিয়েছিল গণমাধ্যমগুলোকে। ২৬ মার্চের পর যখন দাবি অপূর্ণ রয়ে গেল তখন গণমাধ্যমকে ততটুকু সরব থাকতে দেখা যায়নি। এমনকি রুমি স্কোয়াডের তরুণদের আমরণ অনশনের কর্মসূচির খবরও খুব বেশি গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করেনি। সামষ্টিক নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন রেখে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিবাদের ভাষা, ভিন্ন ভিন্ন মতকে এতদিন ধরে যেই জাগরণ মঞ্চ ধারণ করে আসছে তাদের সামনে এ স্কোয়াডের প্রতিবাদের ভাষা একটি নতুন দিক উন্মোচন করেছে।

শহীদ রুমি স্কোয়াড ও গণজাগরণ মঞ্চ একে অপরের পরিপূরক ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়ে যখন এগুচ্ছে তখন আমরা যেন ভুলে না যাই যে এ ভাষা নিয়ে আবির্ভূত তরুণরা কঠোর আত্মত্যাগের মধ্য দিয়েই আমরণ অনশনের কঠোর কর্মসূচি বাস্তবায়নে ব্রতী হয়েছে। এখানে জনগণই হতে পারে ওদের সবচেয়ে বড় শক্তি।

মোশাহিদা সুলতানা ঋতু : সহকারী অধ্যাপক, ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।